প্রচারিত ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় এবং ঘটনাটিও তালেবান শাসনামলের নয়

সম্প্রতি “আফগানিস্তানে দোররা ফিরেছে! নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এবং চাকুরী করার স্বাধীনতা হারিয়েছে। তালেবান শৃঙ্খলে আটকে গেছে নারীর জীবন। ছবিতে দেখুন পুরুষেরা চেয়ার বিছিয়ে এক নারীকে দোররা মারা দেখছে (ছবিটি আজকের প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে নেওয়া)” শীর্ষক শিরোনামসহ বভিন্ন শিরোনামে ছবিসহ একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

পোস্টটি দ্বারা সাধারণ ব্যবহারকারীরা যেভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছে

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে “Kamrul Hassan Mamun” নামের একটি ভেরিফাইড প্রোফাইল (যিনি নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হিসেবে উল্লেখ করেছেন) থেকে গত ২৯ ডিসেম্বর একটি পোস্ট করা হয়।

পোস্টে তিনি উল্লেখ করেছেন “আফগানিস্তানে দোররা ফিরেছে!”। পোস্টের সাথে একটি ছবি ব্যবহার করে সে ব্যাপারে উল্লেখ করা হয় “ছবিটি আজকের প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে নেওয়া”। এই বাক্য দ্বারা মনে হতে পারে ছবিটি এবং ছবির ঘটনাটি আজকেরই অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ এর। কিন্তু প্রথম আলো ছবির সাথে ক্যাপশনে “ফাইল ছবি” বা “পুরাতন ছবি” উল্লেখ করেছে। কিন্তু পোস্টকারী “Kamrul Hassan Mamun” তার লেখায় সে বিষয়টি উল্লেখ করেননি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী যারা  “ফাইল ছবি” দ্বারা কি বোঝায় তা জানেননা তারা বিভ্রান্ত হতে পারেন।

এই একই পোস্টে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন “তালেবান শৃঙ্খলে আটকে গেছে নারীর জীবন”। এর দ্বারা অনেকেই ধারণা করবেন যে ছবি ও ছবির ঘটনাটি বোধহয় তালেবান শাসনের সময়কার। এছাড়াও, তার পোস্ট এর সারমর্ম অনুযায়ী মনে হতে পারে ছবির এই ঘটনায় কেবলামাত্র মহিলাটিকে দোররা (বেত্রাঘাত) করা হয়েছে বা শাস্তি দেওয়া হয়েছে। বাকি সকল পুরুষরা সেটা চেয়ারে আরাম করে উপভোগ করছেন।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রচারিত ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় এবং ঘটনাটি তালেবান শাসনামলের সময়কারও নয়। এছাড়াও যিনার কারণে এই ঘটনায় শুধুমাত্র একজন মহিলাকে শাস্তি প্রদান করা হয়নি বরং ছবিটি এবং ছবির ঘটানাটি ২০১৫ সালের, সেসময় আফগানিস্তানে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় ছিল। এছাড়াও, যিনার কারণে এই ঘটনায় ছবির নারীর সাথে অভিযুক্ত একজন পুরুষকেও শাস্তি দেয়া হয়েছিল।

রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্সে ২০১৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর “Afghan man and woman given 100 lashes in public for adultery” শীর্ষক শিরোনামে আলোচিত ছবিসহ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায় (প্রথম আলোতে উল্লিখিত ছিল)। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “ব্যভিচারের জন্য দোষী সাব্যস্ত একজন আফগান পুরুষ এবং মহিলাকে তাদের শাস্তির ১০০টি বেত্রাঘাত দেয়া হচ্ছে (অনুবাদিত)।”

আরও উল্লেখ করা হয়, “আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় ঘোর প্রদেশের এই শাস্তি ঘোর প্রদেশে সরকার সমর্থন করেছিল। স্থানীয় একজন বিচারক বলেছেন, এই শাস্তি সংবিধান ও ফৌজদারি আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।”

পাশাপাশি, আয়ারল্যান্ড ভিত্তিক গণমাধ্যম আইরিশ টাইমস-এ ২০১৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর “Afghan man and woman given 100 lashes in public for adultery” শীর্ষক শিরোনামে আলোচিত ছবিসহ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “ব্যভিচারের জন্য দোষী সাব্যস্ত একজন আফগান পুরুষ এবং মহিলা সোমবার তাদের শাস্তির ১০০টি বেত্রাঘাত পেয়েছেন।” 

অর্থাৎ, ছবি ও ছবির ঘটানাটি ২০১৫ সালের। এছাড়াও, যিনার কারণে এই ঘটনায় ছবির নারীর সাথে অভিযুক্ত আরো একজন পুরুষকেও শাস্তি দেয়া হয়েছিল।

২০১৫ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন কারা

অনুসন্ধানে দেখা যায় ২০১৫ সালে আফগানিস্তানে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট “আশরাফ ঘানি” ক্ষমতায় ছিলেন। “আশরাফ ঘানি” এর উকিপিডিয়া পেজ অনুযায়ী তিনি  ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ১৫ই আগষ্ট পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন।

অনুসন্ধানে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি-তে ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর “আফগানিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন আশরাফ ঘানি” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন পাওয়া যায়। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর।

মূলত, গত ২৯ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় দেশীয় গণমাধ্যম প্রথম আলোতে ফাইল বা পুরনো ছবি উল্লেখ করে সেই ছবিসহ “দোররা ফিরেছে, তালেবান শৃঙ্খলে আটকে গেছে নারীর জীবন” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে একই ছবি ব্যবহার করে এই বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে নিজের ভেরিফাইড প্রোফাইলে একটি পোস্ট করেন “Kamrul Hassan Mamun” নামের একজন ব্যবহারকারী, তবে ক্যাপশনে তিনি ছবিটি যে পুরোনো (২০১৫) সালের সেটা উল্লেখ করেননি। এছাড়াও সেসময়ে তালেবান ক্ষমতায় ছিলনা এবং ছবির ঘটনায় (যিনার অভিযোগে) নারীর পাশাপাশি একজন পুরুষকেও শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি এসব কিছু উল্লেখ না করেই বেশকিছু সমালোচনা করেছেন, যা বিভ্রান্তিকর।

উল্লেখ্য, দ্বিতীয় মেয়াদেও ২০১৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও “আশরাফ ঘানি” নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তালেবান আফগানিস্তানে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রকাশ্যে শাস্তি কার্যকরের পদ্ধতি চালু করে। ২০২১ সালের ১লা মে থেকে আফগানিস্তানে থাকা মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ৩০ আগস্ট সর্বশেষ মার্কিন সেনাটিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর আগে ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালেবান। ঐদিন-ই রাজধানী কাবুল থেকে বিমানে করে বিদেশে পালিয়ে যান আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি।

স্ক্রিনশটঃ বিবিসি

প্রসঙ্গত; প্রথম আলোর আলোচিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নভেম্বরের শুরুর দিকে সাদাফ (ছদ্মনাম) নামের ২২ বছর বয়সী এক তরুণীকে ‘নৈতিক অপরাধে’দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি পুরুষ অভিভাবক (মাহরাম) ছাড়া এক পুরুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। শাস্তি হিসেবে তাঁকে দোররা মারার সিদ্ধান্ত হয়। ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে প্রচারিত ভূলতথ্য নিয়ে ইতোপূর্বে বেশ কয়েকটি ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।

সুতরাং, ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ে তালেবান কর্তৃক জনসম্মুখে বেত্রাঘাতের নয় সেই বিষয়টি উল্লেখ না করার কারণে; ছবিসহ ফেসবুক পোস্টটি বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img