সম্প্রতি, ভারতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এক নারীর কান্নার ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হয়, বরিশালের গৌরনদীতে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুসলিমরা একজন হিন্দুর ওপর হামলা করেছে। পোস্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, মনির মিয়া নামের একজন মুসলিম ব্যক্তি ও তার দলবল ওই হিন্দু ব্যক্তিকে নির্যাতন করেছে এবং বর্তমানে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
উক্ত দাবিতে এক্সে ভাইরাল কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বরিশালের গৌরনদীতে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে কোনো সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেনি বরং উক্ত উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত রাজনৈতিক হামলার ঘটনাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে সাম্প্রদায়িক হামলা দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। ভিডিওতে কান্নারত এক নারীকে উক্ত হামলার বিষয়ে কথা বলতে দেখা যায়। এ সময় তিনি বলেন, “ওরে হারিছের লোক ধরছে (হামলা করেছে)। এই উপজেলা নির্বাচন নিয়া সব ঝামেলা। ওরে বাঁচতে দেবে না। ওরে মারতে পারলে সব ক্লিয়ার”
অনুসন্ধানের মাধ্যমে কান্নারত এই নারীর পরিচয় শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার টিম। তিনি গৌরনদীর মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহত সৈকত গুহ’র স্ত্রী বিপাশা গুহ।
পরবর্তীতে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে গত ০২ মে ‘গৌরনদীতে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ইউপি চেয়ারম্যানকে কুপিয়ে জখম’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বরিশালের গৌরনদী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈকত গুহকে কুপিয়ে জখম করেছেন প্রতিপক্ষের লোকজন। গত বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলার বাটাজোর বাসস্ট্যান্ডে এই সংঘর্ষে আরও চারজন আহত হয়েছেন। সে সময় গুরুতর আহত দুজনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
গৌরনদী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মনির হোসেন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান সৈকত গুহসহ ১০-১৫ জন সমর্থক নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের এক কর্মীর জানাজায় যাচ্ছিলেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে বাটাজোর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছানোর পর কিছু সমর্থকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করছিলেন। এ সময় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আরেক চেয়ারম্যান প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হারিছুর রহমানের সমর্থক দেলোয়ার হোসেন হাওলাদার সেখানে উপস্থিত হন। দেলোয়ার উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। সেখানে ছবি তোলাকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
মনির হোসেন আরও বলেন, একপর্যায়ে যুবলীগ নেতা দেলোয়ারের সমর্থকেরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে মাহিলাড়া ইউপি চেয়ারম্যান সৈকত গুহ, সমর্থক পলাশ হোসেন (২৭) ও মামুন খানকে (৩২) কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করেন।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত যুবলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেনের সমর্থক ও বাটাজোর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক কালু তালুকদার। পাল্টা অভিযোগ করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পিতভাবে মাহিলাড়া ইউপি চেয়ারম্যান সৈকত গুহ দেলোয়ার হোসেনকে লক্ষ্য করে পিস্তল দিয়ে গুলি করেন। এতে দেলোয়ার হোসেন ও তাঁর ছেলে ইমতিয়াজ মাহমুদ আহত হন।
তবে সেখানে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি কিংবা স্থানীয় লোকজন গুলির কোনো শব্দ পাননি বলে জানিয়েছেন গৌরনদী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মাজাহারুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মনির হোসেন মিয়া ও মাহিলাড়া ইউপি চেয়ারম্যান সৈকত গুহ সমর্থকদের নিয়ে একটি জানাজায় যাওয়ার পথে বাটাজোর বাসস্ট্যান্ডে ছবি তোলা নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। এ সময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সৈকত গুহসহ তিনজন আহত হন। গুরুতর আহত সৈকত গুহ ও দেলোয়ার হোসেনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এছাড়াও মূলধারার গণমাধ্যম দ্য ডেইলি স্টারের অনলাইন সংস্করণে গত ০৩ মে ‘গৌরনদীতে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে ইউপি চেয়ারম্যানসহ আহত ৪’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদনে স্থানীয়দের বরাতে জানানো হয়, গৌরনদী উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী মনির হোসেন মিয়ার পক্ষে কাজ করছেন মাহিলারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু। এতে আরেক চেয়ারম্যান প্রার্থী ও গৌরনদী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও হারিসুর রহমান পিকলুর ওপর ক্ষুব্ধ হন।
গত ০২ মে রাতে পিকলু বাটাজোর বাজারে মনির হোসেন মিয়ার পক্ষে গণসংযোগে গেলে বাটাজোর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রব হাওলাদারের ভাই দিলু হাওলাদার, রাসেল ও তাদের অনুসারীরা পিকলু ও তার সমর্থকদের কুপিয়ে আহত করে।
উক্ত প্রতিবেদনে আহত সৈকত গুহ’র স্ত্রী বিপাশা গুহ’র বক্তব্য পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান প্রার্থী হারিসুর রহমান নিজেও হামলায় অংশ নেন। আহতদের যেন বরিশাল না নেওয়া যায়, সেজন্য অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয়।’
অর্থাৎ, আলোচিত পোস্টগুলোতে সৈকত গুহ’র ওপর মনির মিয়া হামলা করেছেন বলে দাবি করা হলেও সৈকত গুহ’র স্ত্রী বিপাশা গুহ’র বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হারিসুর রহমানের নেতৃত্বে এই হামলা হয়েছে। তাছাড়া সৈকত গুহ উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী মনির মিয়ার পক্ষের এবং হামলার শিকার হওয়ার সময়ে তারা একসাথে ছিলেন। এর সাথে সাম্প্রদায়িক কোনো ইস্যু সম্পর্কিত নয়। এটি সম্পূর্ণ একটি রাজনৈতিক ঘটনা।
মূলত, গত ০২ মে বরিশালের গৌরনদীতে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ইউপি চেয়ারম্যান সৈকতে গুহ সহ অম্তত ৪ জন আহত হন। গৌরনদী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এবার চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদ্য সাবেক পৌর মেয়র হারিছুর রহমান, তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে বর্তমান চেয়ারম্যান সৈয়দা মনিরুন নাহার মেরী, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মনির হোসেন মিয়া রয়েছেন। গত ০২ মে গৌরনদীর বাটাজোর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের এক নেতা মৃত্যুবরণ করেন। তার জানাজার নামাজে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে বাটাজোর বাসস্ট্যান্ডে যান চেয়ারম্যান প্রার্থী ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মনির হোসেন মিয়া ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান পিকলু। সেখানে হারিছুর রহমানের সমর্থকরাও এলে দুইপক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে দুই পক্ষের তিন-চারজন আহত হন। আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের এ রাজনৈতিক সংঘর্ষে গুরুতর জখম হওয়া সৈকত গুহ’র স্ত্রী বিপাশা গুহর হাসাপাতালে বিলাপ করার একটি ভিডিও যুক্ত করে এ ঘটনাকে এক্সের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতন হিসেবে প্রচার করা হয়েছে৷ তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে মনির মিয়া এবং তার দলবল সৈকত গুহকে নির্যাতন করেছে দাবি করা হলেও প্রকৃতপক্ষে সৈকত গুহ উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী মনির মিয়ার পক্ষে কাজ করছেন এবং হামলার শিকার হওয়ার সময়ও তারা একসাথে ছিলেন।
সুতরাং, বরিশালের গৌরনদীতে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংগঠিত রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক হামলা দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Prothom Alo: গৌরনদীতে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ইউপি চেয়ারম্যানকে কুপিয়ে জখম
- The Daily Star: গৌরনদীতে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে ইউপি চেয়ারম্যানসহ আহত ৪
- Rumor Scanner’s Own Analysis