দীর্ঘদিন ধরে ‘তুরস্কে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগের ঠিকানায় লিখতে হবে ‘শহীদ নিজামী স্ট্রীট।’ অর্থাৎ বাংলাদেশ দুতাবাসের সামনের সড়কটির নাম রাখা হয়েছে ‘শহীদ নিজামী স্ট্রীট।’ মানে হলো, তুরষ্কে বাংলাদেশ দুতাবাস রাখতে হলে নিজামী সাহেবকে শহীদ বলতেই হবে এবং তার নাম স্মরণ করতেই হবে।‘ শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে।
২০১৬ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে।
২০২১ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে।
২০২২ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, তুরস্কে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনের সড়কের নাম শহীদ নিজামী স্ট্রীট নয় এবং তুরস্কে বাংলাদেশের দূতাবাস রাখতে হলে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীকে শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করতে হবে শীর্ষক কোনো বাধ্যবাধকতার দাবিটি ভিত্তিহীন।
গুজবের সূত্রপাত
দীর্ঘদিন ধরে ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসা এই তথ্যটির উৎস অনুসন্ধানে দেখা যায়, তথ্যটি ২০১৬ সালের ২২ মে Mk Zaman (আর্কাইভ) নামে একটি ফেসবুক একাউন্ট থেকে সর্বপ্রথম পোস্ট করা হয়।
পোস্টটিতে দাবি করা হয়, ‘তুরস্কে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগের ঠিকানায় লিখতে হবে ‘শহীদ নিজামী স্ট্রীট।’ অর্থাৎ বাংলাদেশ দুতাবাসের সামনের সড়কটির নাম রাখা হয়েছে ‘শহীদ নিজামী স্ট্রীট। মানে হলো, তুরষ্কে বাংলাদেশ দুতাবাস রাখতে হলে নিজামী সাহেবকে শহীদ বলতেই হবে এবং তার নাম স্মরণ করতেই হবে।’
পরবর্তীতে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রকাশিত LosAngeles BanglaTimes নামের একটি অনলাইন পোর্টালে ২০১৬ সালের ২৮ মে ‘তুরস্কে নিজামী ও কাদের মোল্লা’র নামে সড়কের নামকরণ‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, “যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির বিরুদ্ধে তুরস্কের যুব ফাউন্ডেশন (TUGVA) তুরস্কে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। তুরস্ক যুব ফাউন্ডেশনের আঙ্কারা প্রধান আব্দুল কাদির কোজাত্তেপের প্রতিনিধিত্বে যুব প্ল্যাটফর্মের সমর্থন নিয়ে জাতীয় তুর্কি ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্য ফাউন্ডেশন এই প্রতিবাদ সমাবেশ এর আয়োজন করা হয়।”
এসময় তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের রোড নং ৩৯১ এর স্থলে “শহীদ রাহমান নিজামী” সড়ক এবং তার অপর পাশে রোড নং ৪০১ এর স্থলে “শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা” সড়ক নামে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া হয়।
প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, যুব ফাউন্ডেশন এর প্রধান খোজাত্তেপে সড়ক দুইটির নামফলক যেন আনুষ্ঠানিকভাবে “শহীদ রহমান নিজামী” এবং “শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা” দ্রুত স্থাপন করা হয় সেজন্য আঙ্কারা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।”
পরবর্তীতে তুরস্কের সংবাদমাধ্যম Anadolu Agency তে ২০১৬ সালের ১৯ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনে একই তথ্য পাওয়া যায়।
অর্থাৎ, ২০১৬ সালের সেসময় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির বিরুদ্ধে তুরস্কের কিছু সংগঠন তুরস্কে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করে এবং দূতাবাসের সামনের সড়কের নাম ‘শহীদ রাহমান নিজামী সড়ক” ও ‘শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা সড়ক’ নামকরণ করে এবং নামকরণ স্থায়ী করার জন্য কর্তৃপক্ষকে আবেদন জানানোর ঘোষণা দেয়।
পরবর্তীতে রিউমর স্ক্যানার টিম সড়ক দুইটিতে স্থাপিত “শহীদ রাহমান নিজামী” ও “শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা” সাইনবোর্ড দুইটির স্থায়ী নামকরণ করা হয়েছিলো কি না তা নিয়ে অনুসন্ধান করে।
অনুসন্ধানে তুরস্ক কিংবা দেশীয় কোনো গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য খুঁজে না পাওয়ায় গুগল ম্যাপে সাইনবোর্ডে উল্লেখ করা ‘SEHIT RAHMAN NIZAMI’ ও SEHIT ABDUL KADIR MOLLA’ নামদ্বয় দ্বারা অনুসন্ধান করলে, এতে তুরস্কে ৩৯১ ও ৪০১ রুট দুইটি খুঁজে পাওয়া গেলেও গুগল ম্যাপসে ‘SEHIT RAHMAN NIZAMI’ ও SEHIT ABDUL KADIR MOLLA’ নামে কোনো সড়ক খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে আমরা ২০১৬ সালের যে জায়গাটিতে প্রতিবাদের সময় TUGVA কর্তৃক শহীদ নিজামী সড়ক এবং শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা নামে সড়ক স্থাপন করা হয় সেই জায়গাটি গুগল ম্যাপসে অনুসন্ধান করি। অনুসন্ধানে দেখা যায় দুই বছর আগে গুগলের নেয়া স্ট্রিট ভিউ ফুটেজে সেই স্থানে বর্তমানে TUGVA এর দেয়া সাইনবোর্ড দুটি নেই। অর্থাৎ অনেক আগেই সাইনবোর্ড দুটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। গুগল ম্যাপে সেই স্থানটি দেখুন – এখানে।
অর্থাৎ এর মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় সেই সড়কদ্বয়ের নাম স্থায়ীভাবে শহীদ নিজামী সড়ক কিংবা শহীদ কাদের মোল্লা সড়ক হয়নি। তাই বর্তমানে তুরস্কের বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে সড়কে উক্ত নামের কোন সড়ক নেই।
এছাড়া ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসা পোস্টগুলোতে আরো দাবি করা হয় যে, বাংলাদেশ দুতাবাসের সামনের সড়কটির নাম রাখা হয়েছে ‘শহীদ নিজামী স্ট্রীট’ এবং বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগের ঠিকানায় এটি উল্লেখ করতে হবে৷
পোস্টে উল্লিখিত এসব তথ্যের সূত্র ধরেও তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় ও ইস্তাম্বুলে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের ঠিকানায় এমন কোনো সড়কের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে তুরস্কে সড়কের এই নামকরণ সম্পর্কে অধিকতর সত্যতা যাচাইয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম বাংলাদেশে অবস্থিত তুরস্ক দূতাবাসে ইমেইল করে৷
ইমেইলের উত্তরে দূতাবাসটি জানায়, তুরস্কে বা বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে এমন নামে কোনো সড়ক নেই।
অর্থাৎ, তুরস্কে উক্ত নামে কোনো সড়ক নেই।
পাশাপাশি পোস্টগুলোতে বাংলাদেশ দূতাবাস রাখতে হলে নিজামীকে শহীদ বলতেই হবে এবং তার নাম স্মরণ করতেই হবে বলে দাবি করা হলেও তুরস্কের সরকার কর্তৃক এরুপ কোনো বাধ্যবধকতার প্রমাণ নেই।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ১১ মে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসি দেয়ার ঘটনায় তুরস্ক বাংলাদেশ থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে। তবে প্রত্যাহারের তিন মাস পরেই আগস্টে তিনি আবার ঢাকায় যোগদান করেন৷ এরপর থেকে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিবাচক কূটনৈতিক সম্পর্কই রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে উঠে আসে। এর মধ্যে আছে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে তুরস্কে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পরপরই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিঠি, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পরপরই বাংলাদেশকে সমর্থন জানাতে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোয়ানের কক্সবাজার সফরের মতো ঘটনা।
মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি প্রসঙ্গে তুরস্কের প্রতিক্রিয়া:
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালের ১১ মে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকর করে। এই রায়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এক টেলিভিশন ভাষণে বলেন,
“আপনারা যদি সত্যিই রাজনৈতিক হত্যার বিরোধী নন? আপনারা এখন চুপ, কারণ হত্যার শিকার ব্যক্তিটি একজন মুসলিম।
পাশাপাশি এই ঘটনায় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালের ১১ মে তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া একটি বিবৃতিতে মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির ঘটনায় শোক প্রকাশ করে জানায়, তারা বিশ্বাস করে, নিজামী এই ধরনের শাস্তি প্রাপ্য ছিল না।
এছাড়া এই ফাঁসিকে কেন্দ্র করে দেশটির রাজধানী আঙ্কারায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে ও ইস্তাম্বুলের একটি পার্কে তুরস্কের বিভিন্ন এনজিও ও সংগঠন বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল।
তবে ২০২১ সালে দেশটির বর্তমান রাষ্ট্রদূত মুস্তাফা ওসমান তুরান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সময় যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনের এ বিষয়টিকে তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের ভুল–বোঝাবুঝি ছিল বলে মন্তব্য করেন।
মূলত, ২০১৬ সালের ১১ মে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকর করে। এই রায়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবং বাংলাদেশ থেকে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করেন। পাশাপাশি দেশটির বিভিন্ন এনজিও ও সংগঠনও এ রায় বাস্তবায়ন নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় তুর্কি ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্য ফাউন্ডেশন আঙ্কারায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের রোড নং ৩৯১ এর স্থলে “শহীদ রাহমান নিজামী” সড়ক এবং তার অপর পাশে রোড নং ৪০১ এর স্থলে “শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা” সড়ক নামে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয় এবং আঙ্কারা জেলা প্রশাসকের কাছে এই সাইনবোর্ডগুলো দ্রুত স্থাপনের আবেদন জানায়। পরবর্তীতে এই ঘটনাটিই বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনের সড়কটির নাম ‘শহীদ নিজামী স্ট্রীট’ অর্থাৎ তুরস্কে বাংলাদেশ দূতাবাস রাখতে হলে মতিউর রহমান নিজামীকে শহীদ বলতেই হবে এবং তার নাম স্মরণ করতেই হবে দাবিতে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে এসব দাবির কোনো পক্ষে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, তুরস্কে মতিউর রহমান নিজামীর নামে সড়কের নাম ‘শহীদ নিজামী স্ট্রীট’ রাখা ও দেশটিতে বাংলাদেশ দূতাবাস রাখতে হলে মতিউর রহমান নিজামীকে শহীদ আখ্যায়িত করার বাধ্যবাধকতার দাবিটি সঠিক নয়; এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Los Angeles Bangla Times: তুরস্কে নিজামী ও কাদের মোল্লা’র নামে সড়কের নামকরণ
- Google Map (1): https://maps.app.goo.gl/a8osZFNiHPkAZ1te9
- Google Map (2): https://maps.app.goo.gl/tG2rQKX3gHcB93ut5
- Turkey Bangladesh Embassy (Ankara): https://ankara.mofa.gov.bd/en/site/page/Contact
- Turkey Bangladesh Embassy (Istanbul): https://istanbul.mofa.gov.bd/en/site/page/address-and-contact-number
- Email to Turkey Bangladesh Embassy
- BBC Bangla: নিজামীর ফাঁসি: বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করলো তুরস্ক
- Bdnews24: Turkey sends back ambassador to Bangladesh three months after recalling him for ‘consultations’
- Daily Prothom Alo: দুই ঘটনায় বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্ক বদলেছে: তুরস্কের রাষ্ট্রদূত
- Banglanews24: যেভাবে কার্যকর নিজামীর ফাঁসি
- Daily Sabah (1): Turkey recalls ambassador to Bangladesh after execution of Nizami
- Turkey Ministry of Foreign Ministry: Press Release Regarding the Execution of the Death Sentence of Motiur Rahman Nizami
- Daily Sabah (2): Bangladeshi Jamaat-e-Islami party leader Nizami’s execution protested in Turkey