চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তান থেকে আসা জাহাজ ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে অপতথ্যের ছড়াছড়ি

স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের করাচি থেকে কনটেইনার বহনকারী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে। গত ১৩ নভেম্বর পানামার পতাকাবাহী এই জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করেছে। গত কয়েকদিন ধরেই এই বিষয়টিকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।

এর মধ্যে গত ১৫ নভেম্বর কিছু ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভেরিফাইড এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশে পাঠানো অস্ত্র ও গোলাবারুদের তথ্য প্রকাশ করে পরে সেটি মুছে দিয়েছে। সরকার বিষয়টি গোপন রাখলেও অনুমান করা হচ্ছে, এসবের একটি অংশ চট্টগ্রাম বন্দরেই এসব অস্ত্র খালাস হবে। 

পাকিস্তান
Screenshot: Facebook.

এই দাবির সঙ্গে ‘Defence Pakistan’ নামের একটি ব্লু ব্যাজধারী ভেরিফাইড টুইটার অ্যাকাউন্টে গত ২৯ আগস্ট ও সম্প্রতি প্রচারিত দুটি পোস্টের স্ক্রিনশট জুড়ে দেওয়া হয়। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, অ্যাকাউন্টটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসিয়াল কোনো অ্যাকাউন্ট নয়। এর বায়ো অনুযায়ী, এটি একটি ব্যক্তিগত প্রোফাইল যা একজন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও সাংবাদিক পরিচালনা করেন। অ্যাকাউন্টটি প্রতিরক্ষা, ভূরাজনীতি, বৈশ্বিক সংঘাত এবং আফগানিস্তান সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে পোস্ট করে। অ্যাকাউন্টটির নামের পাশে ভেরিফাইড চিহ্ন থাকলেও এটি এক্স প্ল্যাটফর্মের পেইড সাবস্ক্রিপশন মডেলের মাধ্যমে অর্জিত। ২০২১ সালে চালু হওয়া এই মডেলে নির্দিষ্ট একটি মাসিক ফি প্রদান করে যেকোনো ব্যবহারকারী ব্লু টিক ভেরিফিকেশন পেতে পারেন। তাই ভেরিফাইড চিহ্ন থাকলেও এটি কোনো সরকারি বা অফিসিয়াল সংস্থার প্রতিনিধিত্ব করে না। এছাড়া, পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর তথ্য ও জনসংযোগ অধিদপ্তরের অফিসিয়াল এক্স অ্যাকাউন্টে এ ধরনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

তাছাড়া, প্রচারিত পোস্টগুলোতে দাবি অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্টটি মুছে ফেলা হয়েছে, তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পোস্টটি এখনও অ্যাকাউন্টটিতে দৃশ্যমান। গত ২৯ আগস্ট প্রকাশিত ওই পোস্টে দাবি করা হয়, পাকিস্তান বাংলাদেশকে ৪০,০০০ আর্টিলারি শেল, ৪০ টন আরডিএক্স এবং ২,৯০০ হাই-ইনটেনসিটি প্রোজেক্টাইল সরবরাহ করবে। তবে এই দাবির পক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হয়নি। দাবির সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিগুলোও অনলাইন থেকে সংগৃহীত পুরোনো ছবি। পোস্টে ব্যবহৃত সামরিক যানের ছবিটি অন্তত ২০১৭ সাল থেকে অনলাইনে রয়েছে এবং এর উপরের বাম কোণে থাকা জলছাপ অনুযায়ী, এটি শাহরিয়ার সোনেট নামের একজন ফটোগ্রাফার ২০১৬ সালে তুলেছেন। গোলাবারুদ ও বিস্ফোরকের ছবিটিও উইকিপিডিয়া থেকে সংগ্রহ করা, যা ২০০৮ সালে আপলোড করা হয়েছিল বলে উইকিপিডিয়ায় উল্লিখিত তথ্য থেকে জানা যায়।

Screenshot Collage: Rumor Scanner.

এদিকে ভারতীয় গণমাধ্যম রিপাবলিক বাংলা দাবি করেছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের ‘সোয়াত’ নামে যে সামরিক জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এসেছিল, ওই জাহাজই আবারও ভিড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। তবে এই দাবিরও কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়া জাহাজটির নাম ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’, যা একটি বাণিজ্যিক জাহাজ।

Screenshot: Facebook.

পাকিস্তান থেকে আসা এই জাহাজে কী কী পণ্য আছে তা নিয়েও সামাজিক মাধ্যমে বেশ আগ্রহ দেখা গেছে। কিছু পোস্টে (,,, , ) দাবি করা হয়েছে, পাকিস্তান বাংলাদেশে জাহাজ ভর্তি অস্ত্র পাঠিয়েছে। তবে এই দাবির পক্ষেও কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র পাওয়া যায়নি। দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, পাকিস্তান থেকে আমদানি হওয়া ৬,৩৩৭ টন পণ্যের মধ্যে রয়েছে শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আনা হয়েছে সোডা অ্যাশ, যা টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহার হয়। ১১৫ কনটেইনারে সোডা অ্যাশ এসেছে। এছাড়া ডলোমাইট (৪৬ কনটেইনার), চুনাপাথর (৩৫ কনটেইনার), ম্যাগনেশিয়াম কার্বোনেট (৬ কনটেইনার), ভাঙা কাচ (১০ কনটেইনার) এবং পোশাকশিল্পের কাঁচামাল (২৮ কনটেইনার) রয়েছে। ভোগ্যপণ্যের মধ্যে পেঁয়াজ ৪২ কনটেইনারে ৬১১ টন এবং আলু ১৪ কনটেইনারে ২০৩ টন এসেছে, যা হিমায়িত কনটেইনারে পরিবহণ করা হয়েছে। আকিজ গ্লাস, নাসির ফ্লোট গ্লাস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, প্যাসিফিক জিনসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য আমদানি করেছে। একই জাহাজে করে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে খেজুর, জিপসাম, পুরোনো লোহার টুকরা, মার্বেল ব্লক, কপার ওয়্যার, রেজিন এবং একটি কনটেইনারে হুইস্কি, ভদকা ও ওয়াইনও এসেছে।

গণমাধ্যমগুলো আরও জানাচ্ছে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে এই কনটেইনার জাহাজসেবা চালু করেছে দুবাইভিত্তিক ফিডার লাইনস ডিএমসিসি। বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান রিজেনসি লাইনস লিমিটেড। এই সেবা ছয়টি দেশের – বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত – বন্দরগুলোর মধ্যে পণ্য পরিবহণ করবে। এক পূর্ণ যাত্রা সম্পন্ন করতে সময় লাগবে ৭৬ দিন। বর্তমানে সেবাটি ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ নামের জাহাজ দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।

রিপাবলিক বাংলার প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়, কোনো তল্লাশি ছাড়াই জাহাজের সকল সামগ্রী খালাস হয়েছে। এই দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দ্বিতীয় সচিব মো. আবদুল কাইয়ুম স্বাক্ষরিত একটি আদেশের ছবিসহ।

Screenshot: Facebook.

তবে এই বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২৯ অক্টোবরের এই আদেশপত্র মূলত পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পণ্যগুলো ‘লাল তালিকামুক্ত’ করার। এর আগে নিরাপত্তার অজুহাতে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা অধিকাংশ পণ্য ‘লাল তালিকাযুক্ত’ ছিল।

এই বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের এডিশনাল কমিশনার মোহাম্মদ তফছির উদ্দিন ভূঁঞা রিউমর স্ক্যানারকে জানান, সাধারণত বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পণ্য সরাসরি চেক করা হয় না, কারণ এটি বাস্তবিকভাবে সম্ভব নয়। কাস্টমস ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার (Risk Management Analysis) ভিত্তিতে পণ্য যাচাই করে। তবে, পাকিস্তান থেকে আসা প্রতিটি চালানে আগে বাধ্যতামূলক চেকিং চালু ছিল, যা এখন প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে পাকিস্তানের পণ্য আর কখনো যাচাই করা হবে না। অন্যান্য দেশের মতোই পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে যাচাই কার্যক্রম প্রয়োগ করা হবে।

পাকিস্তানের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়া নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত দাবি হচ্ছে, পাকিস্তান থেকে আসা কনটেইনার তল্লাশি করতে চাওয়ার কারণে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কর্মকর্তা ওয়ালিদ হোসেন এবং মোঃ রাসেলকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে বদলি করা হয়েছে।

Screenshot: Facebook.

তবে, এই দাবিরও সত্যতা মেলেনি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের তালিকায় উল্লিখিত নামের কোনো কর্মকর্তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। একইসঙ্গে, কাস্টম হাউসের ওয়েবসাইটেও এই বদলির বিষয়ে কোনো নোটিশ প্রকাশিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এডিশনাল কমিশনার মোহাম্মদ তফছির উদ্দিন ভূঁঞা জানান, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন গুজব। করাচি থেকে আসা জাহাজকে ঘিরে বদলির কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি আরও বলেন, এই নামে রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) বা তার ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা এ দপ্তরে কর্মরত নেই।

তথ্যসূত্র

হালনাগাদ/ Update

২৫ নভেম্বর, ২০২৪ : এই প্রতিবেদন প্রকাশ পরবর্তী সময়ে একই দাবি সম্বলিত ফেসবুক ও এক্স পোস্ট আমাদের নজরে আসার প্রেক্ষিতে উক্ত পোস্টকে প্রতিবেদনে দাবি হিসেবে যুক্ত করা হলো।

আরও পড়ুন

spot_img