চট্টগ্রামের মুরাদপুরে জলাবদ্ধতার ভুয়া দাবি, ছড়ানো হচ্ছে পুরোনো ছবি-ভিডিও

চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নতুন কোনো সমস্যা নয়। প্রায় দুই দশক ধরে বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টিতেই নগরীর বহু এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যায় ভোগা এলাকাগুলোর মধ্যে মুরাদপুর অন্যতম। গত বছরও সেখানে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি জমেছিল।

এ বছরের ২৯ মে রাত থেকে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে টানা ভারী বৃষ্টি শুরু হয়, যা ২ জুন পর্যন্ত থেমে থেমে অব্যাহত রয়েছে। এই সময় চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকায় পানি জমেছে দাবি করে একাধিক ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। রিউমর স্ক্যানার টিম দেখতে পায়, এই দাবির সঙ্গে অন্তত তিনটি ভিন্ন ভিডিও, তাদের কিছু স্থিরচিত্র এবং একটি আলাদা ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। এসব কনটেন্ট লক্ষ লক্ষবার দেখা হয়েছে এবং পেয়েছে হাজারো প্রতিক্রিয়া।

প্রথম ভিডিওসহ ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন: এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

এই ভিডিও ইউটিউব (,,), ইনস্টাগ্রাম, টিকটকএক্স-এও ছড়িয়েছে।

দ্বিতীয় ভিডিওসহ ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন: এখানে, এখানে, এখানে

এই ভিডিও-ও ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামটিকটকেও ছড়িয়েছে।

তৃতীয় ভিডিওসহ ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন: এখানে

মুরাদপুরে সাম্প্রতিক জলাবদ্ধতার দাবিতে প্রচারিত ছবি সম্বলিত ফেসবুক পোস্ট দেখুন: এখানে, এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে কোমরসমান জলাবদ্ধতার দাবি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, গত বছরের তিনটি ভিডিও এবং ২০২৩ সালের একটি ছবি ব্যবহার করে এই ভুয়া দাবি প্রচার করা হয়েছে।

প্রথম ভিডিও যাচাই

প্রথম ভিডিওটিতে দেখা যায়, এক রিকশাচালক প্রায় কাঁধ সমান পানির মধ্যে যাত্রীসহ রিকশা টেনে নিচ্ছেন। তাকে উচ্চস্বরে বলতে শোনা যায়, ‘এটা কি পানি!’

এই বিষয়ে অনুসন্ধানে, ‘Shimanta Barua’ নামের একটি ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ২০২৪ সালের ২৩ আগস্ট একটি ফেসবুক গ্রুপে প্রকাশিত একই ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ক্যাপশনে দাবি করা হয়, এটি চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকার দৃশ্য। একই দিনে ‘Shohug Ctg’ নামের আরেকটি প্রোফাইল থেকেও ভিডিওটি অন্য এক গ্রুপে পোস্ট করা হয়।

মুরাদপুরে জলাবদ্ধতা
Comparison: Rumor Scanner.

দ্বিতীয় ভিডিও যাচাই

দ্বিতীয় ভিডিওতেও জলাবদ্ধ রাস্তায় মানুষের দুর্ভোগের চিত্র দেখা যায়। ভিডিওতে দেখা যায়, পানিতে আটকে থাকা একটি বাস ধরে মানুষ রাস্তা পার হচ্ছেন, কাঁধসমান পানিতে এক রিকশাচালক যাত্রী টেনে নিচ্ছেন, আর কিছু মানুষ ভ্যানে উঠে পানি পার হচ্ছেন।

এই ভিডিওটিও ২০২৪ সালের ২২ আগস্ট ‘MD Momin’ নামের একটি ফেসবুক প্রোফাইলে পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয় এটি মুরাদপুরের দৃশ্য। পরে ‘Arif Bin Karim’ নামের আরেকটি প্রোফাইল থেকেও ২৪ আগস্ট একই ভিডিও প্রকাশ করা হয় এবং ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয়, এটি ২২ আগস্ট (২০২৪) মুরাদপুরে ধারণকৃত।

Comparison: Rumor Scanner.

তৃতীয় ভিডিও যাচাই

তৃতীয় ভিডিওতে দেখা যায়, জলাবদ্ধ রাস্তায় পথচারী ও রিকশাচালক যাত্রী নিয়ে চলাচল করছেন। ভিডিওটির ওপর ‘Oppo A92’ মোবাইলের ওয়াটারমার্কসহ ৩০ মে তারিখ দেখা যায়, যা দেখে ধারণা করা হয় এটি এ বছরের ৩০ মে ধারণকৃত।

তবে অনুসন্ধানে, ‘Nazma Begum’ নামের একটি ফেসবুক প্রোফাইলে গত বছরের ২৩ আগস্ট প্রকাশিত একই ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘পানির নিচে মুরাদপুর’। অর্থাৎ, পুরোনো ভিডিওর ওপর নতুন তারিখ বসিয়ে সেটিকে সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।

Comparison: Rumor Scanner.

ছবি যাচাই

‘চট্টগ্রাম হবে সিঙ্গাপুর, পানির নিচে মুরাদপুর’ ক্যাপশনে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে জলাবদ্ধ রাস্তায় বাস, রিকশা ও ছাতা হাতে কিছু পথচারীকে দেখা যায়।

তবে ছবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে ‘আর. কে. জ্যান’ নামের একটি ফেসবুক প্রোফাইলে ২০২৩ সালের ৭ আগস্ট প্রকাশিত একই ছবি খুঁজে পাওয়া যায়।

Comparison: Rumor Scanner.

চট্টগ্রামের মুরাদপুরের এ বছরের পরিস্থিতি

চট্টগ্রামের মুরাদপুরে এ বছর বৃষ্টিপাতের পর জলাবদ্ধতার অবস্থা জানতে গিয়ে ১ জুন ‘Abrar Fahad’ নামের একটি ফেসবুক প্রোফাইলে একটি পোস্ট পাওয়া যায়। সেখানে দাবি করা হয়, এবার টানা ভারি বৃষ্টিতেও মুরাদপুর বা বহদ্দারহাটে কোথাও পানি জমেনি। পোস্টের সঙ্গে ৩০ মে বিকেল ৪টার সময়-তারিখসহ কিছু ছবি যুক্ত রয়েছে। পোস্টে অভিযোগ করা হয়, পুরোনো ভিডিও ব্যবহার করে কেউ কেউ মুরাদপুরে কোমরপানি থাকার গুজব ছড়াচ্ছেন।

একই দিন ‘Campus Timeline’ নামের একটি ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়। ক্যাপশনে দাবি করা হয়, টানা পাঁচ দিন বৃষ্টি হলেও মুরাদপুরের রাস্তায় পানি জমেনি। ভিডিওটি ১ জুন সকাল ৯টায় ধারণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় এবং সেখানে মুরাদপুরে জলাবদ্ধতার কোনো চিত্র দেখা যায়নি।

চট্টগ্রামের স্থানীয় গণমাধ্যম চট্টগ্রাম পোস্টের ফেসবুক পেজে গত ১ জুন প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের তুলনায় এবার বেশি বৃষ্টিপাত হলেও মুরাদপুর এলাকায় পানির কোনো চিহ্ন নেই।  ভিডিও প্রতিবেদনে একাধিক পথচারী ও একজন রিকশাচালক জানান, রাস্তায় পানি জমেনি।

অন্যদিকে, জাতীয় পর্যায়ের কিছু গণমাধ্যমে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার খবর উঠে আসে।

২ জুন ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জিইসি, কাতালগঞ্জ ও অক্সিজেন মোড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। তবে মুরাদপুরের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

১ জুন প্রকাশিত ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, জিইসি, আগ্রাবাদ ও ইস্পাহানি এলাকায় হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি জমে। এই প্রতিবেদনেও মুরাদপুরের নাম আসেনি।

তবে বিডিনিউজ২৪-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই দিন আগ্রাবাদ, চকবাজার, এনায়েত বাজার, জিইসি, কাতালগঞ্জ, পাঁচলাইশ ও মুরাদপুরে মূল সড়কে জলাবদ্ধতা হয়।

বাংলাদেশ জার্নালের প্রতিবেদনে জানানো হয়, তিন দিনে প্রায় ৪৯৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। প্রথম দুই দিনে জলাবদ্ধতা না থাকলেও ১ জুন টানা ভারি বৃষ্টিতে ও জোয়ারের প্রভাবে কিছু এলাকায় পানি জমে। তবে ভাটা শুরু হলে পানি নামতে শুরু করে।

সরেজমিনের তথ্য জানতে চট্টগ্রামের কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা বলে রিউমর স্ক্যানার টিম। প্রথম আলোর রিপোর্টার ফাহিম আল সামাদ জানান, সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তিনি ঘটনাস্থলে যান, তবে সেখানে জলাবদ্ধতা দেখেননি।

আজকের পত্রিকার সবুর শুভ জানান, এবার মুরাদপুরে পানি জমেনি। বর্ষা মৌসুমে সাধারণত এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি পানি ওঠে, তবে এবার যতক্ষণ বৃষ্টি থাকে বা জোয়ার আসে, তখন কিছুটা পানি দেখা গেলেও তা দ্রুতই নেমে যায়। আগের বছরের তুলনায় পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো।

সুতরাং, গত বছরের তিনটি ভিডিও এবং ২০২৩ সালের একটি ছবি ব্যবহার করে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে এ বছরের বৃষ্টিতে কোমরসমান পানি জমার দাবি ছড়ানো হচ্ছে; যা মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img