ভারতে পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা মসজিদটির অবস্থান হারদিয়া গ্রামে নয়

সম্প্রতি “বাঁধ নির্মাণের পর ডুবে যাওয়া “নূরী মসজিদ” আজ ৩০ বছর পর সেই অক্ষত অবস্থায় আবারও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে নদীর বুকে।” শীর্ষক শিরোনামের একটি মসজিদের ছবিসহ কিছু তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে। 

কী দাবি করা হচ্ছে?

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে একটি মসজিদের বেশ কয়েকটি ছবি যুক্ত করে বলা হয়েছে, “বাঁধ নির্মাণের পর ডুবে যাওয়া ‘নূরী মসজিদ’ আজ ৩০ বছর পর সেই অক্ষত অবস্থায় আবারও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে নদীর বুকে। বিহারের নওয়াদা জেলার রাজাউলি ব্লকের হারদিয়া গ্রামের ঘটনা। উক্ত বাঁধটির নাম ফুলবাড়ীয়া বাঁধ, ১৯৮৪ সালে এটি চালু হয় তার পরেই মসজিদটি চলে যায় জলের নীচে। মসজিদটি ১২০ বছর পুরানো।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। 

আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “ফুলওয়ারিয়া ড্যামের নির্মাণকাজ ১৯৮৫ সালে শেষ হয়।”

দেশীয় গণমাধ্যমে ১৯৮৫ সালে উক্ত বাঁধটি তৈরি হয় দাবিতে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন দেখুন – কালের কন্ঠ (আর্কাইভ), সময় নিউজ (আর্কাইভ), ইনকিলাব (আর্কাইভ), যমুনা (আর্কাইভ), বাংলাদেশ টুডে (আর্কাইভ), রিদ্মিক নিউজ (আর্কাইভ), দৈনিক করতোয়া (আর্কাইভ)।

Screenshot Source: kaler kantho

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, আলোচিত মসজিদটি ভারতের বিহারের হারদিয়া গ্রামের নয় এবং মসজিদটির ডুবে যাওয়ার জন্য দায়ী বাঁধটি ১৯৮৪ সালে নির্মাণ হয়নি বরং মসজিদটির অবস্থান চিরালিয়া গ্রামে এবং উক্ত বাঁধটি নির্মাণ শেষ হয় ১৯৮৮ সালে৷

কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে পাকিস্তানি ইংরেজি ভাষার দৈনিক The Express Tribune এ গত ৭ সেপ্টেম্বর WATCH: Old mosque emerges from underwater in India (আর্কাইভ) শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে কাশ্মিরভিত্তিক ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম Kashmir Media Service এর বরাতে বলা হয়, “ভারতের বিহার রাজ্যের নওয়াদা (Nawada) জেলার চিরালিয়া (Chiralia) গ্রামের রাজাউলি (Rajauli) ব্লকে একটি মসজিদ তিন দশক পর পানির নিচ থেকে জেগে উঠেছে।

Screenshot Source: The Express Tribune

এই প্রতিবেদনে সূত্র হিসেবে উল্লিখিত Kashmir Media Service এর ওয়েবসাইটে (আর্কাইভ) একই দিনে (৭ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত আলোচিত প্রতিবেদনটি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “১৯৮৫ সালে চিরালিয়া গ্রামে বাঁধ নির্মাণ করার পর সেখানে অবস্থিত নুরী (Noori) মসজিদটি পানির নিচে ডুবে যায়।” প্রতিবেদনে বলা হয়, চিরালিয়ায় বসবাসকারী মানুষরা পরবর্তীতে একই ব্লকের হারদিয়া গ্রামে স্থানান্তরিত হন। কিন্তু মসজিদটি একই স্থান অর্থাৎ চিরালিয়া গ্রামেই থেকে যায়।

Screenshot Source: Kashmir Media Service

The Express Tribune প্রকাশিত প্রতিবেদনে Manmauji Baba নামক ট্রাভেল ভ্লগভিত্তিক একটি ইউটিউব চ্যানেলে গত ২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি ভিডিওর বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, ঘুরতে যাওয়া দর্শনার্থীরাও মসজিদটির অবস্থান চিরালিয়া গ্রাম বলে উল্লেখ (1:42 minutes) করেছেন। পাশাপাশি, ওই গ্রামের মানুষ যে হারদিয়া গ্রামে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন, সেই বিষয়টিও উল্লেখ (2:33 minutes) করা হয় ভিডিওতে। 

বাঁধটির নির্মাণ ১৯৮৫ সালেও নয়?

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর সূত্র হিসেবে উল্লিখিত Kashmir Media Service এর প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “ফুলওয়ারিয়া বাঁধটি ১৯৮৫ সালে নির্মিত হয়।”

Screenshot Source: Kashmir Media Service

তবে রিউমর স্ক্যানার অধিকতর অনুসন্ধানে দেখেছে, বাঁধটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৮৮ সালে। ভারতের বিহার রাজ্য সরকারের পানি সম্পদ বিভাগের (Water Resources Department) ওয়েবসাইটে চলতি বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ফুলওয়ারিয়া বাঁধটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৮৮ সালে।

Screenshot from fmiscwrdbihar website

২০২০ সালে ফুলওয়ারিয়া বাঁধ বিষয়ে প্রকাশিত ভারতীয় গবেষকদের একটি গবেষণা প্রতিবেদনেও (page 1) বাঁধটির নির্মাণসাল হিসেবে ১৯৮৮ উল্লেখ রয়েছে।

মসজিদটির বিষয়ে আলোচনার শুরু কবে?

কিওয়ার্ড এবং রিভার্স ইমেজ সার্চে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, গেল ২ সেপ্টেম্বরের আগে এই বিষয়ে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কোনো আলোচনা হয়নি। ২ সেপ্টেম্বর Manmauji Baba এর ইউটিউব ভিডিওটি প্রকাশের পরই মূলত মসজিদটির বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। ভারতের মূল ধারার কোনো গণমাধ্যমেই এ বিষয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশ করতে দেখা না গেলেও মূলত স্থানীয় গণমাধ্যমের মাধ্যমে এই তথ্য ছড়িয়ে পড়ে।

মসজিদটি কত পুরানো?

মসজিদটি ঠিক কবে নির্মাণ করা হয়েছিল সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি।

পাকিস্তানের GEO Tv বলছে, স্থাপত্যশৈলী দেখে অনেকের অনুমান করছেন এটি সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নির্মাণ করা হতে পারে। কারও কারও ধারনা, ১২০ বছর আগে এটি নির্মাণ হয়ে থাকতে পারে। মসজিদ নির্মাণের মুঘল রীতি অনুসরণ করা হয়েছে এতে। সেটা দেখেই বয়স অনুমান করা সহজসাধ্য হয়েছে অনেকের কাছে।

কী ঘটেছিল মসজিদটির ভাগ্যে?

নওয়াদা জেলার কৃষকদের সেচ কাজে সুবিধার জন্য ভারত সরকার ১৯৭৯ সালে জেলার রাজাওয়ালী ব্লকে ফুলওয়ারিয়া নামে একটি বাঁধ নির্মাণ করে। ১৯৮৮ সালে এই বাঁধটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। বাঁধ নির্মাণকালে স্থানীয় জনগণকে সরে যেতে হয়েছিল ওই জায়গা থেকে। তাদের সে সময় স্থানান্তরিত করা হয় পাশের হারদিয়া গ্রামে। বাঁধ নির্মাণস্থলে নুরী মসজিদটিও ছিল। তবে বাঁধের নির্মাণকাজে বাঁধা না থাকায় মসজিদটি অক্ষত রাখা হয়। নির্মাণ শেষ হওয়ার পরও তাই মসজিদটি অক্ষত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যমে তবে বাঁধের কারণে ওই এলাকায় ক্রমশ পানি জমতে শুরু করলে মসজিদটি এক সময় পানিতে তলিয়ে যায়। এরপর মসজিদটি আর দেখতে পাননি স্থানীয়রা। সাম্প্রতিক সময়ে ওই এলাকায় খরা দেখা দেওয়ায় পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর মসজিদটি আবার দৃশ্যমান হতে দেখেছেন স্থানীয়রা। 

মূলত, এ বছর সেপ্টেম্বরের শুরুতে ভারতের বিহারের চিরালিয়া গ্রামে ১৯৮৮ সালে নির্মিত ফুলওয়ারি নামক একটি বাঁধের কারণে পানিতে ডুবে থাকা স্থানগুলোয় খরার কারণে পানি শুকিয়ে যায়। ওই স্থানে পানির নিচে তলিয়ে থাকা নুরী নামে একটি মসজিদও জেগে উঠতে দেখেন স্থানীয়রা। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মসজিদটির অবস্থান হারদিয়া গ্রামে এবং গণমাধ্যমে বাঁধটি ১৯৮৫ সালে নির্মিত হয় দাবি করে প্রচার করা হচ্ছে।

সুতরাং, ভারতের নুরী মসজিদটির বিষয়ে ফেসবুকে প্রচারিত তথ্যগুলো আংশিক মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img