এমপি আরাফাতকে গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক অপহরণ ও মারধরের দাবিটি ভুয়া

সম্প্রতি, “ডিজিএফআই দ্বারা অপহৃত ও প্রহৃত হলেন আওয়ামী লীগের নতুন এমপি আরাফাত” শীর্ষক দাবিতে একটি বিষয় ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে।

আরাফাত

গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজে প্রকাশিত উক্ত দাবিতে পোস্ট দেখুন ফেস দ্য পিপল। 

এছাড়া, একই দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত আরো কিছু পোস্ট দেখুন  এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে, ঢাকা-১৭ আসনের উপ নির্বাচনে বিজয়ী নব নির্বাচিত এমপি মোহাম্মদ এ আরাফাতকে গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক অপহরণ ও নির্যাতন করার দাবিটির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বরং কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ছাড়াই ভুঁইফোড় কিছু অনলাইন পোর্টাল ও ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে দাবিটি ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে।

দাবিটির সূত্রপাত যেভাবে 

দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে গত ১৯ জুলাই “BD Politico” নামক একটি ওয়েবসাইটে “ডিজিএফআই দ্বারা অপহৃত ও প্রহৃত হলেন আওয়ামীলীগের নতুন এমপি আরাফাত” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: BD Politico Website

প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়, ‘নির্বাচনে জেতার পর মোহাম্মদ এ আরাফাত একটি গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক অপহৃত এবং মারধরের শিকার হয়েছেন।’ 

প্রতিবেদনটিতে আরও দাবি করা হয়, ‘আরাফাত ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কেন্দ্রে কোনো ভোট পাননি। এতে বিরক্ত হয়ে তিনি ফোনে কাউকে গালাগালি করতে থাকেন এবং বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ঘাতক এই আর্মি আমাকে ভোট দিবে কেনো? জননেত্রী এত কিছু দেয়ার পরেও এই দশা! শুয়ারের বাচ্চাদের আমি দেখে নেব।’

Screenshot: BD Politico Website

বিডি পলিটিকো নামের এই সাইটের দাবি অনুযায়ী, সংস্থাটির নিয়মিত মনিটরিংয়ে আরাফাতের এই গালাগালি ধরা পড়ে। পরবর্তীতে সোমবার অর্থাৎ ১৭ জুলাই মধ্যরাতের পরে আরাফাতকে তুলে এনে হাত মুখ বেধে অন্ধকার ঘরে বেধড়ক পেটানো হয় এবং ইলেকট্রনিক শক দেওয়া হয়, এতে এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন আরাফাত। পরে ডাক্তার এনে চিকিৎসা শেষে ভোর রাতে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয় সংস্থাটি।

মোহাম্মদ এ আরাফাত কি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কেন্দ্রে কোনো ভোট পাননি?

বিডি পলিটিকোর দাবি অনুযায়ী, মোহাম্মদ এ আরাফাত ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কোনো ভোট পাননি। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকা-১৭ আসন উপনির্বাচনে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্তত ৭ টিতে আরাফাত ৩৬৭ টি ভোট পেয়েছেন।

এ বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানে জাতীয় দৈনিক আজকের পত্রিকাতে গত ১৮ জুলাই এক কেন্দ্রে আরাফাতের চেয়ে বেশি, আরেকটিতে সমান ভোট পেয়েছেন হিরো আলম’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে উল্লেখিত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের তিনটি কেন্দ্রের মধ্যে ১০৫ নম্বর কেন্দ্র [বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ডিওএইচএস মহাখালী, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা (২য় তলা) (পুরুষ ভোটার) কেন্দ্র-১] এ ৩ হাজার ১৮২ টি ভোটের বিপরীতে পড়া ২২৫ টি ভোটের মধ্যে আরাফাত পেয়েছেন ৭৯ ভোট।

Screenshot: Ajker Patrika

এছাড়া, ১১৩ নম্বর কেন্দ্রে [শহীদ বীর বিক্রম রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা (দক্ষিণ ভবন) (পুরুষ ও মহিলা ভোটার), কেন্দ্র-১] ২ হাজার ১৭ টি ভোটের বিপরীতে পড়া ৬০ ভোটের মধ্যে আরাফাত পেয়েছেন ২৫টি ভোট।

সর্বশেষ, ১১৪ নম্বর কেন্দ্রে [শহীদ বীর বিক্রম রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা (উত্তর ভবন) (পুরুষ ও মহিলা ভোটার), কেন্দ্র-২] ২ হাজার ৪২৯ টি ভোটের বিপরীতে পড়া ২৪টি ভোটের মধ্যে আরাফাত পেয়েছেন ১১ ভোট। 

ক্যান্টনমেন্টের এই তিনটি কেন্দ্র ছাড়াও রিউমর স্ক্যানার টিম অধিকতর অনুসন্ধানে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বার্তা বাজারে গত ১৭ জুলাই ‘ঢাকা ১৭ আসন উপ নির্বাচনের ফলাফল সরাসরি’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি লাইভ সম্প্রচারেও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন কেন্দ্রের ফলাফল খুঁজে পায়।

যেমন, ১০৬ নম্বর কেন্দ্র [বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ডিওএইচএস মহাখালী, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা (নীচ তলা) (মহিলা ভোটার) কেন্দ্র-২] এ আরাফাত পেয়েছেন ৪১ ভোট।

১০৭ নম্বর কেন্দ্র, বিএএফ শাহীন কলেজ, কুর্মিটোলা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা (নীচ তলা, পূর্ব পার্শ্ব) (পুরুষ ভোটার-২) কেন্দ্র-১] এ আরাফাত পেয়েছেন ৮১ ভোট।

১০৮ নম্বর কেন্দ্র, বিএএফ শাহীন কলেজ, কুর্মিটোলা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা (নীচ তলা, পূর্ব পার্শ্ব) (পুরুষ ভোটার-২) কেন্দ্র-২] এ আরাফাত পেয়েছেন ১০১ভোট।

১০৯ নম্বর কেন্দ্র, বিএএফ শাহীন কলেজ, কুর্মিটোলা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা (নীচ তলা, পশ্চিম পার্শ্ব) (মহিলা ভোটার) কেন্দ্র-৩] এ আরাফাত পেয়েছেন ২৯ ভোট।

Screenshot: Barta Bazar facebook Live

১১০ নম্বর কেন্দ্রে [শহীদ বীর বিক্রম রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা, কলেজ ভবন ( নীচ তলা),  (পুরুষ ভোটার-১), কেন্দ্র-১] এ আরাফাত পেয়েছেন ৬৫ ভোট। 

১১১ নম্বর কেন্দ্রে [শহীদ বীর বিক্রম রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা, কলেজ ভবন ( ২য় তলা),  (পুরুষ ভোটার-২), কেন্দ্র-২] এ আরাফাত পেয়েছেন ২৮ ভোট।

১১২ নম্বর কেন্দ্রে [শহীদ বীর বিক্রম রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা, ডিগ্রি ভবন ( ২য় তলা),  (মহিলা ভোটার), কেন্দ্র-৩] এ আরাফাত পেয়েছেন ২২ ভোট।

Screenshot: Barta Bazar facebook Live

অর্থাৎ, অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে যে মোহাম্মদ এ আরাফাত ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট পেয়েছেন, তাই কোনো ভোট না পেয়ে ফোনকলে গালিগালাজ করতে থাকা শীর্ষক বিডি পলিটিকো সাইটের এই দাবিটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হিসেবেই প্রতীয়মান হয়।

মোহাম্মদ এ আরাফাতের নির্বাচন পরবর্তী কার্যক্রম 

বিডি পলিটিকোর দাবি অনুযায়ী, মোহাম্মদ এ আরাফাতকে সোমবার (১৭ জুলাই) মধ্যরাতের পরে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হয় এবং ইলেকট্রনিক শক দিয়ে কথা বের করা হয়। এসব ঘটনার এক পর্যায়ে আরাফাত অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং পরে ডাক্তার এনে চিকিৎসা শেষে ভোর রাতে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয় সংস্থাটি। 

অর্থাৎ, সাইটটির দাবি অনুযায়ী মোহাম্মদ এ আরাফাতের শারীরিক অবস্থা শোচনীয় হওয়াটাই অনুমেয়।তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৮ জুলাই বিকাল ৩ টায় ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে জয়ের পরদিন মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সস্ত্রীক দেখা করেন মোহাম্মদ এ আরাফাত। এই সাক্ষাতের সময় মোহাম্মদ এ আরাফাতকে স্বাভাবিক অবস্থাতেই দেখা গেছে।

Screenshot: Daily Jugantor

এছাড়া নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাতকারে মোহাম্মদ এ আরাফাত যে বক্তব্য দেন, সেখানেও কম ভোট পাওয়া নিয়ে তিনি অস্বাভাবিক কোনো মন্তব্য করেননি।

Screenshot: Maasranga TV

মোহাম্মদ এ আরাফাতকে গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক অপহরণ ও মারধরের দাবির বিষয়ে বিডি পলিটিকোর সূত্র কি?

মোহাম্মদ এ আরাফাতকে গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক অপহরণ ও মারধরের দাবির বিষয়ে বিডি পলিটিকোর প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র সম্পর্কেও অনুসন্ধান করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিডি পলিটিকোর প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রথমত কোনো সুনির্দিষ্ট ও নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র নেই। পাশাপাশি, প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এখানে বিভিন্ন দাবির সূত্র হিসেবে খবর পাওয়া গেছে’, ‘অনেকেই’, ‘সূত্র জানায়’, ‘একটি মাধ্যম’ ইত্যাদি শব্দচয়ন করা হয়েছে। 

এছাড়া, প্রতিবেদনটিতে এমন কিছু শব্দ বা বাক্যের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় যা প্রতিবেদনটির দাবিগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মূলত, সাইটটির প্রতিবেদনে থাকা শব্দচয়নের সাথে কোনো প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের শব্দচয়নেরও মিল নেই।

বিডি পলিটিকোর পূর্বের গুজব ছড়ানোর রেকর্ড

রিউমর স্ক্যানারের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বিডি পলিটিকোতে পূর্বেও বিভিন্ন সময়ে কোনো প্রকার তথ্যসূত্র ছাড়া অসংখ্য ভুয়া খবর প্রচার করেছে।

পূর্ববর্তী সময়ে বিডি পলিটিকো সাইটে প্রচারিত গুজব সমূহের বিপরীতে রিউমর স্ক্যানারে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলো দেখুন:

মামলায় হাজিরা দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরব আমিরাত গমন দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি মিথ্যা 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২ লাখ দিরহাম অর্থদণ্ডের তথ্যটি মিথ্যা 

সরকারী ৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন স্যাংশনের দাবিটি মিথ্যা 

সাইটটি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, তাদের দাবি অনুযায়ী বিডি পলিটিকো রাজনীতি বিষয়ক শীর্ষ গণমাধ্যম।

Screenshot: BD Politico Website

তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওয়েবসাইটটিতে পরিচিতিমূলক বা আমাদের সম্পর্কে এবং কোনোপ্রকার যোগাযোগের ঠিকানা উল্লেখ করা নেই। পাশাপাশি, ওয়েবসাইটটির মালিকানা, পরিচালক কিংবা সম্পাদক পর্যায়ে কে বা কারা রয়েছে, এই সম্পর্কেও কোনো প্রকার তথ্য দেওয়া নেই সেখানে। 

মূলত, গত ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মোট ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত। তবে তার এ জয়ের পর গত ১৯ জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি সূত্রহীন দাবি ছড়িয়ে পড়ে যে, মোহাম্মদ এ আরাফাত ঢাকা-১৭ আসনের ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কোনো ভোট না পাওয়ায় সেনাবাহিনীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং এর প্রেক্ষিতে গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক তাকে অপহরণ ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। তবে প্রকৃতপক্ষে, মোহাম্মদ এ আরাফাত ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে অন্তত ৭ টি কেন্দ্রে ৩৬৭ টি ভোট পেয়েছেন। পাশাপাশি, যে ওয়েবসাইটটি থেকে কোনোপ্রকার সূত্র ছাড়া ভিত্তিহীনভাবে মোহাম্মদ এ আরাফাতকে অপহরণ ও মারধরের দাবি প্রচার করা হয়েছে, সেটি একটি ভুঁইফোড় ওয়েবসাইট, যাদের পূর্বে বিভিন্ন সময়ে গুজব বা ভুয়া তথ্য ছড়ানোর রেকর্ড রয়েছে।

সুতরাং, ঢাকা-১৭ আসনের এমপি মোহাম্মদ এ আরাফাতকে গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক অপহরণ ও মারধরের বিষয়টি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img