মামলায় হাজিরা দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরব আমিরাত গমন দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি মিথ্যা

সম্প্রতি, “অর্থ পাচারের মামলায় হাজিরা দিতে আরব আমিরাতে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।” শীর্ষক একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে, অর্থ পাচারের মামলায় হাজিরা দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমিরাত যাত্রা সংক্রান্ত দাবিটির স্বপক্ষে কোনো ভিত্তি ও তথ্যপ্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় নি বরং কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ছাড়াই উক্ত দাবিটি সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।

গুজবের সূত্রপাত 

আলোচিত দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ফেসবুকের নিজস্ব মনিটরিং টুলস এর সহায়তায় অনুসন্ধান করে দেখা যায়, ‘BD Politico’ নামের একটি ফেসবুক পেজে গত ০৩ মার্চ রাত ৩ টা ৩২ মিনিটে “অর্থ পাচারের মামলায় হাজিরা দিতে আমিরাত যাত্রা” শীর্ষক শিরোনামে সর্বপ্রথম একটি ফেসবুক পোস্ট করা হয়।

উক্ত পোস্টের সূত্র হিসেবে ‘BD Politico’ নামের একটি ওয়েবসাইটে একই শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের একটি লিংক সংযুক্ত করা হয়, যা গত ০২ মার্চে সাইটটিতে প্রকাশ করা হয়েছিলো।

ঐ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়,

অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় হাজিরা দিতে আমিরাত যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনি। তার কন্যার সাবেক স্বামী খন্দকার মাসরুর হোসাইন মিতুর আরব আমিরাতে অর্থ পাচার মামলায় কন্যা পুতুল সহ শেখ হাসিনা নিজেও আসামী।

Screenshot BD Politico website

উল্লেখ্য, উক্ত প্রতিবেদনে দাবিকৃত তথ্যের প্রেক্ষিতে কোনো ধরণের তথ্যসূত্রের উল্লেখ ছিলোনা।

পরবর্তীতে বিস্তর অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখা যায়, ‘BD Politico’ পেজের পোস্টের ২ ঘন্টা ১৩ মিনিট পর অর্থাৎ ভোর ৫ টা ৪৬ মিনিটে ‘London Bangla Channel‘ নামের ফেসবুক পেজে “অর্থ পাচারের মামলায় হাজিরা দিতে আরব আমিরাতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ৭ই মার্চ শারজার একটি আদালতে মামলাটির চার্জ গঠনের কথা রয়েছে।” শিরোনামে আরেকটি পোস্ট করা হয়। সেখানেও সূত্র হিসেবে ‘BD Politico’ সাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনের লিংক সংযুক্ত করা হয়।

‘London Bangla Channel’ পেজের পোস্টের এক মিনিট পর অর্থাৎ ভোর ৫:৪৭ মিনিটে ‘Abdur Rab Bhutto‘ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে একই শিরোনামে একই সূত্র উল্লেখ করে আরেকটি পোস্ট করা হয়।

এছাড়াও গত ০৬ মার্চ বেসরকারি ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম ‘এটিএন বাংলা’র নামে তৈরি করা একটি ভুয়া ফেসবুক পেজ হতে ঐ একই শিরোনাম ও দাবিতে আরেকটি পোস্ট করা হয়।

পরবর্তীতে অনেক সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী তথ্যটির সূত্র হিসেবে “ATN Bangla” উল্লেখ করে ফেসবুকে বিষয়টি প্রচার করতে থাকেন।

মূলত, BD Politico, London Bangla Channel ও ATN Bangla (Fake Page) পেজ থেকে দেওয়া পোস্টগুলোর পরেই উক্ত দাবিটি কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই বিগত বেশ কয়েকদিন যাবত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

এছাড়াও একই দাবিকে কেন্দ্র করে গত ০৭ ও ১০ মার্চ ‘Bd Politico’ সাইটে যথাক্রমে “মানি লন্ডারিং মামলায় হাজিরা দিতে আরব আমিরাতে গেলেন শেখ হাসিনা“, “লাল পাসপোর্ট সারেন্ডার করে অর্থ পাচার দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিলেন শেখ হাসিনা” এবং “ব্রেকিং নিউজ: আরব আমিরাতে শেখ হাসিনার ২৪ ঘন্টা আটকাদেশ” শীর্ষক শিরোনামে পৃথক তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।

Screenshot BD Politico website

সেগুলো ‘BD Politico’ নামের ফেসবুক পেজে যথাক্রমে ১০ মার্চ প্রচারিত হয়। আলোচিত দাবিতে প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদনটির মতো এই তিনটি প্রতিবেদনেও কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র উল্লেখ ছিলো না এবং প্রথম প্রকাশিত তথ্যটি যেসব আইডি ও পেজ হতে শুরুর দিকে প্রচারিত হয়েছিলো এই তিনটি প্রতিবেদনের তথ্যগুলোও ঐ একই ফেসবুক আইডি ও পেজ থেকে প্রচারিত হয়। পোস্টগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

বিডি পলিটিকো নামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা একটি কেস নাম্বার [5251] যাচাই করতে আবু ধাবি জুডিশিয়াল ডিপার্টমেন্ট, দুবাই কোর্ট এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মিনিস্ট্রি অব জাস্টিস এর ওয়েবসাইটে সার্চ করে সেখানে এধরণের কোন মামলার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, যেসকল ফেসবুক আইডি ও পেজ থেকে ‘অর্থ পাচারের মামলায় হাজিরা দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমিরাত গমন’ দাবিতে শুরুরদিকে তথ্য প্রচার করা হয় সেই একই পেজ ও আইডিগুলো থেকে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছড়ানো ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পূর্বেও যাচাই করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার, দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

প্রতিমন্ত্রী পলকের যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে বাঁধা ও পুরোনো ছবি প্রচারের দাবিটি মিথ্যা

সিইসি নুরুল হুদার মার্কিন ভিসা বাতিলের তথ্যটি গুজব

স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সুইজারল্যান্ড থেকে ফিরিয়ে দেয়া ও ভিসা বাতিল সংক্রান্ত তথ্যটি মিথ্যা

মূলত, কথিত অর্থ পাচারের মামলায় হাজিরা দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরব আমিরাতে গমন করেছেন এমন দাবির কোনো তথ্য আরব আমিরাত কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায়নি যেখানে কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি ভিন্ন কোনো দেশে কোনো অপরাধের জন্য অভিযুক্ত হন কিংবা আটক হন সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে স্বাভাবিকভাবে সংবাদ প্রকাশিত হওয়া উচিত।

প্রসঙ্গত, ১৯৬১ সালে জাতিসংঘের ভিয়েনা কনভেশন কর্তৃক অনুমোদিত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদবী ধারী ব্যক্তিরা ভিনদেশে কূটনৈতিক অনাক্রম্যতা(Diplomatic immunity) পাওয়ার অধিকার রাখেন। উক্ত অধিকার পাওয়া ব্যক্তিকে যে দেশ সফর করছেন সে দেশে অপরাধ করলেও ঐ দেশের আইনে তার বিচার কিংবা আটক করা যাবেনা। যদি ইউমিনিটির অধিকার পাওয়া কোনো ব্যক্তি বড় ধরণের কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে তাকে বিচার কিংবা আটক করার জন্য আগে তিনি যে দেশের নাগরিক সে দেশের সরকারের মাধ্যমে কূটনৈতিক অনাক্রম্যতা’র বিশেষ আইন রদ করাতে হবে।

হাসিনা
Screenshot from Vienna Convention on Diplomatic Relations, 1961 PDF
Screenshot from Vienna Convention on Diplomatic Relations, 1961 PDF

অর্থাৎ, উপরোক্ত আইন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি আরব আমিরাতে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে থাকতেন তারপরেও ঐ অপরাধের জন্য তার বিচার করা কিংবা বিচারের অংশ হিসেবে তাকে আটক করার কোনো এখতিয়ার আরব আমিরাত সরকারের নেই।

উল্লেখ্য, গত ৭ মার্চ সন্ধ্যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এবং দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমের আমন্ত্রণে পাঁচ দিনের সরকারি সফরে আরব আমিরাতের আবুধাবি যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাত দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দুই দেশের মাঝে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। এছাড়াও গত ৯ মার্চ দুবাই প্রদর্শনী কেন্দ্রে আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমের এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাছাড়া তিনি আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে দুবাই প্রদর্শনী কেন্দ্রে আয়োজিত ‘রিডিফাইনিং দ্য ফিউচার ফর উইমেন’ শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন এবং সেখানকার বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন পরিদর্শন করেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাঁচ দিনের সরকারি সফর শেষে গত ১২ মার্চ শনিবার রাতে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সুতরাং, ‘অর্থ পাচারের মামলায় হাজিরা দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমিরাত গমন’ শীর্ষক দাবির কোনো ভিত্তিই নেই এবং বিষয়টি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা।

[su_box title=”True or False” box_color=”#f30404″ radius=”0″]

  • Claim Review: অর্থ পাচারের মামলায় হাজিরা দিতে আরব আমিরাতে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
  • Claimed By: Facebook Posts
  • Fact Check: False

[/su_box]

তথ্যসূত্র

  1. Vienna Convention on Diplomatic Relations, 1961
  2. Abu Dhabi Judicial Department: https://www.adjd.gov.ae/sites/eServices/EN/Pages/CaseStudyEnquiry.aspx
  3. Dubai Court: https://www.dc.gov.ae/PublicServices/InquiryByCaseNumber.aspx?lang=en
  4. Ministry of Justice: https://www.moj.gov.ae/en/search.aspx?type=all&query=Case%205251#page=1
  5. দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী – চ্যানেল আই অনলাইন
  6. প্রধানমন্ত্রী সংযুক্ত আরব আমিরাত যাচ্ছেন আজ

আরও পড়ুন

spot_img