জাপানের মাইনিচি সংবাদপত্রের বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে।
যা দাবি করা হচ্ছে
জাপানের সংবাদপত্র মাইনিচি’র বিষয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে, “জাপানের মাইনিচি সংবাদপত্র বায়োডিগ্রেডেবল কাগজ এবং বীজ থেকে তৈরি করে। খবর পড়া শেষ হলে, এটি রোপণ করা যায় এবং ফুল গাছ পরিণত হয়!”
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
গণমাধ্যমে উক্ত খবরটিকে ২০১৬ সালের ঘটনা দাবিতে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন মোহনা টিভি।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, জাপানের মাইনিচি সংবাদপত্রের মূল সংস্করণ নয় বরং একটি বিশেষ সংস্করণের কাগজে বীজের প্রলেপ দেওয়া থাকায় সেটি ছিঁড়ে রোপণ করার পর তা থেকে ফুলের চারা হয়েছিল। তাছাড়া উক্ত ঘটনাটি ২০১৫ সালের।
জাপানের বহু পুরোনো পত্রিকা হিসেবে পরিচিত মাইনিচির পথচলা শুরু ১৮৭২ সালে। শুরুতে মূলত জাপানি ভাষায় ‘Mainichi Shinbun’ নামে প্রতিদিন বের হলেও ১৯২২ সালে ইংরেজি ভাষায় ‘Mainichi’ নামে দৈনিক, রবিবারে সাপ্তাহিক মাইনিচি ম্যাগাজিন এবং অন্ধ ব্যক্তিদের জন্য ব্রেইল মাইনিচি বের করা শুরু করে মাইনিচি কর্তৃপক্ষ। পত্রিকাটি বায়োডিগ্রেডেবল কাগজ এবং বীজ দিয়ে তৈরী করা শীর্ষক একটি দাবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
বায়োডিগ্রেডেবল কী?
বায়োডিগ্রেডেবলের শাব্দিক অর্থ জীব ভাঙ্গন যোগ্য। বায়োডিগ্রেডেবল বলতে বোঝায় যে কোনও আইটেমকে কোনো দূষণ না ঘটিয়ে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা জীবাণু দ্বারা ক্রমবর্ধমান ছোট ছোট টুকরোতে ভেঙে আশেপাশের পরিবেশ দ্বারা শোষিত করা। উদ্ভিদের অধিকাংশ উপাদানই প্রাকৃতিকভাবেই বায়োডিগ্রেডেবল হওয়ায় এটি থেকে উৎপন্ন কাগজও স্বাভাবিকভাবে বায়োডিগ্রেডেবল।
অনুসন্ধান যেভাবে
অনুসন্ধানের শুরুতে ‘Mainichi’ এর ওয়েবসাইটে জাপানী ভাষায় কিওয়ার্ড সার্চ করে ২০১৫ সালের ১ মে “On Greenery Day, Mainichi Shimbun titles turn green! Related events will also be held (2015/5/1)” শিরোনামে (অনুবাদকৃত) প্রকাশিত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়।
বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, জাপানে সে বছর ৪ মে অনুষ্ঠিতব্য ‘Greenery Day’ উপলক্ষে মাইনিচির পক্ষ থেকে বেশ কিছু আয়োজন করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে মাইচিনি পত্রিকাকে ‘Green Newspaper’ করা।
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে সংবাদপত্রটি ‘সিড পেপার’ ব্যবহার করে পত্রিকাটি সেদিন (০৪ মে) একটি বিশেষ সংস্করণ ছাপানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। সিড পেপারে কাগজের মধ্যেই ফুলের চারার বীজের প্রলেপ ছিল যা শিল্পকাখানার বর্জ্য কাগজ পুনর্ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল। ভারতীয় পপি, কর্ন পপি এবং স্ন্যাপড্রাগনের মতো বন্য ফুলের বীজ ছিল উক্ত সিড পেপারে।
পরবর্তীতে ০৪ মে’র আয়োজনের বিষয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মাইনিচি জানায়, পাঁচ ধরনের ফুলের বীজের প্রলেপ সম্বলিত ‘গ্রিন নিউজ পেপার’-এর দেড় হাজার শীট যাতে পরিবেশ সংক্রান্ত আর্টিকেল ছিল তা সেদিন (০৪ মে) বিতরণ করা হয়েছিল। আর্টিকেলগুলো পড়ার পরে, দর্শকরা এটি ছিঁড়ে ফেলে, এটি একটি ফুলের পাত্রে রাখে এবং মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়। প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে সেগুলো অঙ্কুরিত হওয়ার কথা জানানো হয় প্রতিবেদনে।
পরবর্তীতে সে বছরের (২০১৫) আগস্টে ইউটিউবে প্রকাশিত একটি ডকুমেন্টারিতেও গ্রিন নিউজপেপার ক্যাম্পেইনের বিষয়ে একই তথ্য এসেছে।
২০১৬ সাল কিংবা পরবর্তী সময়েও এই উদ্যোগ চালু ছিল না কিনা এ বিষয়ে অনুসন্ধানে মাইনিচির ওয়েবসাইটে একাধিক ভিন্ন ভিন্ন কিওয়ার্ড সার্চ করেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তাছাড়া, গণমাধ্যমে এই উদ্যোগের ধারণাটির উদ্ভাবনকারী হিসেবে জাপানের এডভার্টাইজিং এজেন্সি ‘Dentsu Inc.’ এর নাম উল্লেখ করা হলেও মাইনিচির সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞপ্তি ও প্রতিবেদনে বিষয়টির উল্লেখ ছিল না।
এ বিষয়ে জানতে ‘Dentsu Inc.’ এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে ২০২১ সালে ইউটিউবে “A Japanese newspaper that blooms? | Mainichi Shimbun Green Newspaper | Fake news about Japan” শিরোনামে আরেকটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডিওতে মাইনিচি পত্রিকার কাগজ দিয়ে সে সময় বীজ থেকে চারা হয় কিনা সে বিষয়টি যাচাই করে দেখানো হয়৷
ভিডিও ধারণকারী ব্যক্তি মাইনিচির একটি সংস্করণ কিনে এনে সেটি ছিঁড়ে টবে রোপণ করলেও সেটি থেকে কোনো চারা জন্মায়নি।
অর্থাৎ, মাইনিচি পত্রিকাটি ২০১৫ সালের ৪ মে’তে গ্রিনারি ডে উপলক্ষে ফুলের বীজের প্রলেপ সম্বলিত বিশেষ একটি সংস্করণ বের করেছিল।
এ বিষয়ে জানতে মাইনিচির ডেস্ক এডিটর রবার্ট সাকাই-ইরভাইন (Robert Sakai-Irvine) এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, এটি ২০১৫ সালে একটি একক প্রকল্প ছিল এবং একটি ইভেন্টে বিতরণের জন্য শুধুমাত্র ১৫০০টি বিশেষ কপি তৈরি করা হয়েছিল। যদিও এটি পুরনো খবর, তবু আমি জানি না কেন প্রতিবার ইন্টারনেটে এ বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে।”
মূলত, ২০১৫ সালের ৪ মে ‘Greenery Day’ উপলক্ষে জাপানি পত্রিকা ‘Mainichi’ ‘Green Newspaper’ নামে একটি উদ্যোগের অংশ হিসেবে ‘সিড পেপার’ ব্যবহার করে পত্রিকাটির ১৫০০ কপির একটি বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করে। সিড পেপারে কাগজের মধ্যেই ফুলের চারার বীজের প্রলেপ ছিল। উক্ত পত্রিকা পড়ার পর পাঠকরা এটি ছিঁড়ে ফেলে ফুলের পাত্রে রাখে এবং মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়। প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে সেগুলো অঙ্কুরিত হওয়ার কথা জানানো হয় মাইনিচির প্রতিবেদনে। উক্ত তারিখের জন্যই শুধু উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল বলে মাইনিচি কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে। কিন্তু সম্প্রতি এই ঘটনাকে গণমাধ্যমে ২০১৬ সালের এবং ফেসবুকে পত্রিকাটি এখনও একইভাবে পত্রিকা প্রকাশ করছে দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।
সুতরাং, জাপানের মাইনিচি সংবাদপত্রের বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Mainichi: On Greenery Day, Mainichi Shimbun titles turn green! Related events will also be held (2015/5/1)
- Mainichi: “Love Plants” environmental event in Daikanyama
- KOSUKE TAKESHIGE: Green Newspaper / THE MAINICHI NEWSPAPERS
- Internecional: A Japanese newspaper that blooms? | Mainichi Shimbun Green Newspaper | Fake news about Japan
- Statement from Robert Sakai-Irvine, Desk Editor, Mainichi.