সম্প্রতি, মিরপুর ১২ মেট্রোরেল স্টেশনের প্রবেশ গেটের একটি ছবি দাবি করে মেট্রোরেল স্টেশনের দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা শীর্ষক সমালোচনামূলক পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, মিরপুর-১২ নামে মেট্রোরেলের কোনো স্টেশন-ই নেই বরং ছবিটি পল্লবী স্টেশনের। তাছাড়া ছবির গেটটির কাজ এখনো চলমান রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জাপান সরকারের অর্থায়ন ও বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) তত্ত্বাবধানে মেট্রোরেল প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এ প্রকল্পের আওতায় উত্তরা (দিয়াবাড়ি) থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজ চলছে। চলতি মাসে (ডিসেম্বর) প্রথম ধাপে উদ্বোধন করা হবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের।
জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’র গত ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসেছে, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পথের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এ পথে ৯টি স্টেশন রয়েছে। উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ি), উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও।
একই তথ্য এসেছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ওয়েবসাইটেও।
কিন্তু ছড়িয়ে পড়া আলোচিত ছবিটি মিরপুর-১২ মেট্রোরেল স্টেশনের বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট এবং গণমাধ্যম সূত্র বলছে, মিরপুর-১২ নয় উক্ত স্টেশনের নাম পল্লবী। সংশ্লিষ্ট স্টেশন কর্তৃপক্ষও রিউমর স্ক্যানারকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ছবিটি স্টেশনের অসম্পূর্ণ কাজের
আলোচিত ছবির ক্যাপশনে ছবিটিকে মেট্রোরেলের প্রবেশ গেট বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথম আলো’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “মেট্রোরেল উদ্বোধন উপলক্ষে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চালাচ্ছে। মিরপুর এলাকায় কিছু স্টেশনে সিঁড়ি ও চলন্ত সিঁড়ির (এস্কেলেটর) কিছু কাজ চলমান আছে।”
পল্লবী স্টেশনটিও মিরপুর এলাকার আওতায় পড়েছে।
আলোচিত ছবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে পল্লবী স্টেশন সরেজমিন ঘুরে দেখেছে রিউমর স্ক্যানারের প্রতিনিধি। কথা বলেছে সংশ্লিষ্ট স্টেশনের একাধিক কর্মকর্তার সাথে।
রিউমর স্ক্যানারকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, “এই প্রবেশ গেটের কাজ এখনও চলমান। দ্রুতই এর দুই পাশে কাভার শিট দিয়ে ঢেকে দেয়া হবে। ইতোমধ্যে অন্যান্য স্টেশনের প্রবেশ গেটেও একইভাবে কাভার শিট দেওয়া হয়েছে।”
অন্যান্য স্টেশনে কাভার শিট লাগানোর পরের ছবি চাইলে রিউমর স্ক্যানারকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কাজ সম্পন্ন হওয়া ‘উত্তরা উত্তর স্টেশনের’ কিছু ছবি পাঠিয়েছেন।
ছবিগুলো দেখুন –
অর্থাৎ, প্রবেশ গেটের অসম্পূর্ণ কাজের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে বিভ্রান্তিকরভাবে সমালোচনা করা হচ্ছে।
প্রবেশ গেটই কি একমাত্র নিরাপত্তা স্তর?
মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনের প্রবেশ গেট পেরিয়েই যে মূল স্টেশনে সরাসরি প্রবেশ করা যাবে তা নয়।
প্রথম আলো’র প্রতিবেদনে এসেছে, “মেট্রোরেলের স্টেশনে লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যাবে। তিনতলা স্টেশন ভবনের দ্বিতীয় তলায় টিকিট কাটার ব্যবস্থা, অফিস ও নানা সরঞ্জাম থাকবে, যাকে বলা হচ্ছে কনকোর্স হল। তিনতলায় থাকবে রেললাইন ও প্ল্যাটফর্ম। শুধু টিকিটধারী ব্যক্তিরাই ওই তলায় যেতে পারবেন।”
পল্লবী স্টেশন কর্তৃপক্ষও রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছেন, “প্রবেশ গেট পেরিয়ে মূল স্টেশনে প্রবেশ করতে রোলার শাটার সিস্টেমে তৈরি আরেকটি প্রটেকশন গেট পার হতে হবে।”
রোলার শাটার সিস্টেমের কিছু ছবিও রিউমর স্ক্যানারকে পাঠিয়েছে স্টেশন কর্তৃপক্ষ।
ছবিগুলো দেখুন –
ছবি ১
অর্থাৎ, মূল প্রবেশ গেটের পরও দ্বিতীয় তলায় গিয়ে আরেকটি নিরাপত্তা স্তর পেরোতে হবে যাত্রীদের। এরপর টিকেট থাকা সাপেক্ষে তৃতীয় তলায় প্লাটফর্ম এরিয়ায় প্রবেশ করতে পারবে যাত্রীরা।
বিভ্রান্তির সূত্রপাত কীভাবে?
ফেসবুক মনিটরিং টুল এবং এডভান্স সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখা যায়, গত ১৩ ডিসেম্বর রাতে ফেসবুকে ‘Rafidul Hasan’ নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে প্রথম আলোচিত ছবিটি পোস্ট (আর্কাইভ) করা হয়।
পোস্টে তিনি লিখেছেন, “জীবনে প্রচুর সাইন্স পড়েছি, প্রচুর অংক মিলিয়েছি।
তবুও এই গেটের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সাইন্স কিংবা অংক কোনোটাই মিলাতে পারছি না। মিরপুর-১২ মেট্রোরেল স্টেশনের প্রবেশদ্বার।”
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জনাব রাফিদুল হাসান রাজধানীর ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইন্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের একজন প্রভাষক (লেকচারার)।
পরবর্তীতে গত ১৪ ডিসেম্বর ফেসবুকে ‘সাইবার ৭১ – We Work to Protect Bangladesh’ নামক পেজে একই ছবি প্রকাশ (আর্কাইভ) করে ক্যাপশনে লেখা হয়, “মিরপুর-১২ মেট্রোরেল স্টেশনের প্রবেশ গেইট। Security Level!”
সাইবার ৭১ এর এই পোস্টের পরই ছবিটি ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
মূলত, মেট্রোরেল স্টেশনের গেটের ভাইরাল এই ছবিটি ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থার করুণ অবস্থা’ শীর্ষক দাবিতে ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, মেট্রোরেলের মিরপুর-১২ তে কোনো স্টেশন নেই বরং ছবিটি পল্লবী স্টেশনের। রিউমর স্ক্যানারকে সংশ্লিষ্ট স্টেশন কর্তৃপক্ষ জানান, “এই প্রবেশ গেটের কাজ এখনও চলমান। দ্রুতই এর দুই পাশে কাভার শিট দিয়ে ঢেকে দেয়া হবে। ইতোমধ্যে অন্যান্য স্টেশনের প্রবেশ গেটেও একইভাবে কাভার শিট দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, এই প্রবেশ গেট পেরিয়ে মূল স্টেশনে প্রবেশ করতে রোলার শাটার সিস্টেমে তৈরি আরেকটি প্রটেকশন গেইট পার হতে হবে।”
উল্লেখ্য, আগামী ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও অংশের উদ্বোধন করবেন। ডিএমটিসিএল জানায়, উদ্বোধনের পর পুরোদমে চলবে না ঢাকার প্রথম এই মেট্রোরেল। প্রথম সপ্তাহে শুধু সকালে ও বিকালে চলবে। ধীরে ধীরে চলার সময় বাড়বে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের স্টেশন হবে নয়টি। এর ভাড়া প্রতি কিলোমিটার ৫ টাকা, সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা।
প্রসঙ্গত, ডিএমটিসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক জানিয়েছেন, দ্বিতীয় ধাপে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এবং এর পরে কমলাপুর পর্যন্ত অংশ চালু করা হবে।
সুতরাং, মেট্রোরেলের পল্লবী স্টেশনকে মিরপুর-১২ নামের কাল্পনিক মেট্রোরেল স্টেশন নামে প্রচার করা হচ্ছে এবং প্রবেশ গেটের অসম্পূর্ণ কাজের ছবিকে অনলাইনে ভাইরাল করে সমালোচনা করা হচ্ছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Bdnews24: মেট্রোরেল উদ্বোধন ২৮ ডিসেম্বর
- Prothom Alo: মেট্রোরেল খুলবে স্বস্তির দরজা
- DMTCL: MRT-6
- Statement from Pallabi Metrorail Station Authority