সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে “খালেদা জিয়া এশিয়ার ম্যান্ডেলা, অচিরেই বিশ্বনেতা হবেন- মাহাথির মোহাম্মদ।” শীর্ষক শিরোনামসহ ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে একটি তথ্য প্রচার হয়ে আসছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায় মাহাথির মোহাম্মদ খালেদা জিয়াকে নিয়ে এরকম কোনো মন্তব্য করেননি বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র ব্যতীত এবং কিছুক্ষেত্রে মিথ্যা সূত্রের বরাতে তথ্যটি প্রচার করা হচ্ছে।
গুজবের সূত্রপাত
অনুসন্ধানে পত্রিকা ডট কম (potryka.com) নামক পোর্টালে ১৪ মার্চ ২০১৮ (বিকেল ৫.২৪) “খালেদা জিয়া এশিয়ার ম্যান্ডেলা, অচিরেই বিশ্বনেতা হবেন: মাহাথির শীর্ষক শিরোনামে ”প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। এর ঠিক এক ঘন্টা পরে (বিকেল ৬.২৪) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে Basir Uddin নামের একটি প্রোফাইল থেকে একই বিষয় নিয়ে (এই মাধ্যমে) প্রথম পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। পরবর্তীতে বিষয়টি আরও বিভিন্ন ভুঁইফোড় পোর্টাল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
যদিও কয়েকটি পোস্টের শেষে তথ্যসূত্র হিসেবে শীর্ষ খবর ডট কম উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু শীর্ষ খবর তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে গুজবের সূত্রপাতের দুইদিন পরে ১৬ মার্চ ২০১৮।
দাবি অনুসন্ধান
কি-ওয়ার্ড সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে ইন্টারনেটে ও দাবিতে উল্লিখিত সূত্র ‘দ্য মালয় মেইল’ এর ওয়েবসাইটে অনুসন্ধান করে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ কর্তৃক বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সম্পর্কে দেওয়া এরকম কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
পাশাপাশি, বিষয়টি নিয়ে সেসময়ে (২০১৮ সালের মার্চে) দেশীয় গণমাধ্যমেও মাহাথির মোহাম্মদ কর্তৃক খালেদা জিয়াকে নিয়ে মন্তব্য করার এরকম কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।
“খালেদা জিয়া” সম্পর্কিত দাবি ব্যতীত বাকি অংশের সাক্ষাৎকার যাচাই
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের “খালেদা জিয়া এশিয়ার নেলসন ম্যান্ডেলাঃ মাহাথির মোহাম্মদ” শীর্ষক দাবির সাথে সংযুক্ত বাকি সাক্ষাৎকার যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সেসকল বাক্যে ব্যবহৃত শব্দ নিয়ে কি-ওয়ার্ড সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে দেশীয় গণমাধ্যম দৈনিক মানবজমিন-এ ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি “বাংলাদেশে রাজনীতি বেশি, উন্নয়ন কম : মাহাথির মোহাম্মদ” শিরোনামে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারের সাথে কিছু অংশের মিল পাওয়া গেছে।
দাবির সাথে ব্যবহৃত ছবি অনুসন্ধান
শুরুর দিকে দাবির সাথে খালেদা জিয়া ও মাহাথির মোহাম্মদ এর দুটি আলাদা ছবি পাশাপশি অবস্থায় থাকা একটি ছবি প্রচার করা হয়। পরে আলোচিত দাবির সাথে খালেদা জিয়া ও মাহাথির মোহাম্মদ এর একইসাথের ছবিটি প্রথম ব্যবহার করা হয় গুজবটির সূত্রপাতের পরেরদিন, তথা ২০১৮ সালের ১৫ মার্চ।
পাশাপাশি কিছু পোস্টে খালেদা জিয়ার একটি ছবিতে মাহাথির মোহাম্মদ এর একটি ছবি সম্পাদিত করেও প্রচার করা হয়।
ছবিতে থাকা ব্যক্তিদের নাম (কি-ওয়ার্ড) দিয়ে অনুসন্ধান করে স্টক ছবির সাইট গেটি ইমেজ-এ আলোচিত ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে ছবির বিবরণ অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ও তার স্ত্রী সিতি হাসমাহ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাচ্ছেন মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ার কনভেনশন সেন্টারে। ১৬ অক্টোবর ২০০৩-এ ৫৭ দেশীয় অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) এর শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনের আগে। অর্থাৎ ছবিটি ২০০৩ সালের অক্টোবরে তোলা। সে সময়ে বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল খালেদা জিয়া ও তার দল।
ছবিটি নিয়ে দেশীয় ইংরেজি সংবাদ মাধ্যম এর আর্কাইভ দেখুন এখানে।
দাবির পোস্টগুলোতে আরও উল্লেখ করা হয়, বিএনপির কারাবন্দী চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে এশিয়ার নেলসন ম্যান্ডেলা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদ। কিন্তু ছবিটি ২০০৩ সালের অর্থাৎ যখন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সুতরাং ছবিটি খালেদা জিয়ার কারাবরণ এর কাছাকাছি (পূর্ববর্তী কিংবা পরবর্তী) কোনো সময়েরও নয়।
মূলত, খালেদা জিয়াকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো তথ্যসূত্র ব্যতীত এবং কিছুক্ষেত্রে মিথ্যা সূত্রের বরাতে তথ্যটি প্রচার করা হচ্ছে। তবে খালেদা জিয়ার অংশটুকু ব্যতীত দাবির সাথে সংযুক্ত বাকি সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত ২০১৬ সালের একটি সাক্ষাৎকারের সাথে মিল রয়েছে।
এশিয়ার নেলসন ম্যান্ডেলা হিসেবে কেউ খ্যাতি পেয়েছেন
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার মত রাজনৈতিক কারণে মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী ও ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) পার্টির প্রধান অং সান সুচি’কে ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ২১ বছরের মধ্যে ১৫ বছর গৃহবন্দী অবস্থায় থাকতে হয়েছে। একারণে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু গণমাধ্যম তাকে মিয়ানমারের তথা এশিয়ার নেলসন ম্যান্ডেলা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএন এর এ জাতীয় সংবাদ দেখুন এখানে এবং এখানে।
উল্লেখ্য, আলোচিত দাবিটি ২০১৮ সালের মার্চ থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন সময় অনলাইনে প্রচার করা হয়েছিল। এরমধ্যে গুজবটি শুরুর সময়, সেপ্টেম্বর ২০২১ এবং সাম্প্রতিক সময়ে (২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষদিকে) স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
অন্যদিকে, বেশকিছু ফেসবুক পোস্টে বিডিনেটইয়ার্ক২৪ ডট নেট নামের একটি পোর্টালের প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট প্রকাশ করা হয়েছে।
কিন্তু অনুসন্ধানে পোর্টালটিতে সেরকম কোনো সংবাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
উপরন্তু, বিডিনেটইয়ার্ক২৪ ডট নেট এর প্রতিবেদনের স্ক্রিনশটটি পূর্বে উল্লেখিত পত্রিকা ডট কম (potryka.com) নামক পোর্টালের প্রতিবেদনের স্ক্রিনশটের সাথে মিল পাওয়া যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল তথ্যটি প্রচারের প্রভাব
আলোচিত ভুল প্রচারণা (খালেদা জিয়াকে এশিয়ার নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন মাহাথির মোহাম্মদ) বিশ্বাস করে এই তথ্যের ভিত্তিতে ডিজিটাল ব্যানার তৈরি করা হয়েছে। এরপরে সেই ব্যানারের ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
এছাড়াও, দাবিটি বিশ্বাস করে এই তথ্যের ভিত্তিতে বি.এন.পির একজন সাবেক সংসদ সদস্য কর্তৃক খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন জানানোর একটি ফেসবুক পোস্টও পাওয়া গেছে (প্রোফাইলটি সেই সংসদ সদস্যের অফিশিয়াল কিনা নিশ্চিত হওয়া যায়নি)।
প্রসঙ্গত, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ই ফেব্রুয়ারি কারাবরণ করেন খালেদা জিয়া। আর নেলসন ম্যান্ডেলা-ও যেহেতু রাজনৈতিক কারণে কারাবরণ করেছেন সেই বিষয়টির উপর ভিত্তি করে সেবছরের পরের মাসেই (মার্চ) আলোচিত গুজবটির সূত্রপাত হয়। বিষয়টি নিয়ে ইতোপূর্বে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন করেছিল ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান বিডিফ্যাক্টচেক ও ফ্যাক্টওয়াচ।
সুতরাং, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো তথ্যসূত্র ব্যতীত এবং কিছুক্ষেত্রে মিথ্যা সূত্রের বরাতে ‘খালেদা জিয়াকে এশিয়ার নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ’ শীর্ষক দাবি প্রচার করা হচ্ছে যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।