সম্প্রতি ‘ইরাকের পাহাড়ে শ্রীরাম চন্দ্র’ শীর্ষক শিরোনামে একটি ছবি সম্বলিত তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইরাকের পাহাড়ে শ্রীরাম চন্দ্র ও হনুমানের অবয়বের সাদৃশ্যে খোদাইকৃত চিত্র থাকার দাবিতে প্রচারিত ছবি সম্বলিত তথ্যটি সঠিক নয় বরং এই খোদাইকৃত চিত্রটি মেসোপটেমিয়ার শাসক তারদুন্নিকে চিত্রিত করে তৈরি এবং তারদুন্নির সামনে উক্ত খোদাইকৃত চিত্রে নতজানু হয়ে থাকা মানুষের চিত্রগুলো হলো পরাজিত হুরিয়ান সৈন্যদের।
খোদাইকৃত চিত্রটিতে কি দেখা যাচ্ছে?
নগ্ন বুকে একজন রাজা একহাতে ধনুক ও অন্য হাতে ধারালো খঞ্জর নিয়ে আছেন, তার কোমরে তলোয়ার গোজা। পায়ের কাছে দুইজন ব্যক্তি। একজন পদদলিত এবং অন্যজন জোড়হাতে উপবিষ্ট।
খোদাইকৃত চিত্রটি নিয়ে অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে ইতিহাস ভিত্তিক ওয়েবসাইট World History এর ওয়েবসাইটে ২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল ‘Never Before Seen: The Belula Pass Rock Relief‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়।

মেসোপটেমীয় সভ্যতা নিয়ে কাজ করা ইরাকের স্নায়ুবিদ্যার সহযোগী অধ্যাপক ওসামা এস এম আমিনের লেখা এই নিবন্ধটি থেকে জানা যায়, এই খোদাইকৃত চিত্রটিকে বলা হয় ‘রিলিফ অফ তরদুন্নি’ বা “বেলুলা পাস রক রিলিফ”। এটি ইরাক-ইরান সীমান্তের কাছে সুলায়মানিয়া শহরের কাছে হোরেন শেখান এলাকায় দারবন্দ-ই-বেলুলা পর্বতের পাহাড়ের পাশে অবস্থিত।

নিবন্ধটি থেকে আলোচিত খোদাইকৃত চিত্রটির বিস্তারিত বিবরণ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, সুলাইমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওসমান তৌফিকের সৌজন্যে নিবন্ধটিতে ব্যবহৃত একটি ছবির সূত্রে জানা যায়, খোদাইকৃত চিত্রটিতে থাকা পরাজিত শত্রুরা হুরিয়ান হতে পারে। খোদাইকৃত চিত্রটি দেখে প্রতীয়মান হচ্ছে তাকে মৃত হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।

এরপরের ছবিটিতেই ওসমান তৌফিকের সূত্রে জানা যায়, খোদাইকৃত চিত্রটিতে থাকা দ্বিতীয় পরাজিত ব্যক্তিটি ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে আছেন। তার হেলমেট এবং পোশাক একজন হুরিয়ান সৈন্যের প্রতি নির্দেশ করতে পারে।

নিবন্ধটিতে খোদাইকৃত চিত্রটির পাশেই থাকা একটি লিপির সূত্রে উল্লেখ করা হয়, সেখানে ”Tar…duni” শব্দটি লেখা রয়েছে। এই ছবিটিও সুলাইমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওসমান তৌফিকের সৌজন্যে ব্যবহৃত।

পরবর্তীতে নিবন্ধটিতে সুলায়মানিয়াহ জাদুঘরের পরিচালক হাশিম হামা আবদুল্লাহকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, খোদাইকৃত চিত্রটির লেখাগুলো পরবর্তীতে কোনো সময়ে যোগ করা হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। এই খোদাইকৃত চিত্রগুলোতে বিভিন্ন রাজা, শাসকদের নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে। তবে এসবের মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হল এখানে যে নামটি রয়েছে সেটি “তার…দুন্নি”। “তার…দুন্নি” ছিলেন ইক্কির পুত্র, যিনি একজন লুলুবিয়ান রাজা, রাজপুত্র, শাসক বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন।

এই খোদাইকৃত চিত্রটি নিয়ে ওসামা এস এম আমিনের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত একটি ভিডিও দেখুন এখানে।

সার্বিক বিশ্লেষণে ওসামা এস এম আমিনের এই নিবন্ধ বা ভিডিওটির কোথাও উক্ত খোদাইকৃত চিত্রটিকে শ্রীরামচন্দ্র ও হনুমানের অবয়ব হিসেবে উল্লেখ করার তথ্য পাওয়া যায়নি।
এছাড়া ইতোপূর্বে উক্ত খোদাইকৃত চিত্রটি শ্রীরামচন্দ্রের ভাস্কর্য দাবিতে ভারতেও প্রচার হলে একাধিক ভারতীয় ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানও উক্ত দাবিটি সঠিক নয় উল্লেখ করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনগুলো দেখুন ফ্যাক্টলি ডট ইন, নিউজ চেকার ডট ইন, ডিজিটাল ফরেনসিক, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকস সেন্টার।
মূলত, ইরাকের সুলায়মানিয়া শহরের কাছে হোরেন শেখান এলাকায় দারবন্দ-ই-বেলুলা পর্বতের পাহাড়ের পাশে অবস্থিত একজন বিজয়ী রাজা ও দুইজন পরাজিত সৈন্যের একটি খোদাইকৃত চিত্রকে সম্প্রতি ইরাকের পাহাড়ে শ্রীরাম চন্দ্র ও হনুমানের অবয়বের সাদৃশ্যে খোদাইকৃত চিত্র থাকার দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, উক্ত খোদাইকৃত চিত্রটির সাথে শ্রীরামচন্দ্র ও হনুমানের অবয়বের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এই খোদাইকৃত চিত্রটি প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার শাসক তারদুন্নিকে চিত্রিত করে তৈরি এবং তারদুন্নির সামনে উক্ত খোদাইকৃত চিত্রে নতজানু হয়ে থাকা মানুষের চিত্রগুলি হলো পরাজিত হুরিয়ান সৈন্যদের।
সুতরাং, ইরাকের পাহাড়ে শ্রীরাম চন্দ্র ও হনুমানের অবয়বের সাদৃশ্যে খোদাইকৃত চিত্র থাকার দাবিতে ছবি সম্বলিত যে তথ্যটি প্রচার করা হচ্ছে; তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- World History: Never Before Seen: The Belula Pass Rock Relief
- Osman SM Amin_Youtube: Darband-i Belula Rock-Relief of “Tar…dunni”, Iraqi Kurdistan