আর্জেন্টাইন ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি তার পেশাদার ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় বার্সেলোনা ক্লাবের হয়ে খেলেছেন এবং এই ক্লাবের হয়ে অসংখ্য শিরোপা জিতেছেন। মেসি ৮ বার ব্যালন ডি’অর অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন এবং ২০২২ সালে কাতারে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেন। বর্তমানে তিনি মেজর লিগ সকার ক্লাব ইন্টার মায়ামি এবং আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলেন।
সম্প্রতি লিওনেল মেসিকে নিয়ে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। উক্ত ভিডিওতে দাবি করা হয়, “স্কাই নিউজ চ্যানেলে মেসি বলেছিলঃ কেন এই মুসলিমরা রমজানে তারাবিহ এর নামাজ পড়ে? কেন এই মুসলিমরা রমজানে রোজা রেখে খাবার ও পানীয় ছেড়ে দেয়? প্রকৃতপক্ষে, এই মুসলিমরা মানসিকভাবে অসুস্থ এবং উন্মাদ এবং এরকম মুসলমানরা আমার ভক্ত হওয়াতে আমি সম্মানিত নই।”
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
এ বিষয়ে ফেসবুকে সর্বাধিক ভাইরাল একটি ভিডিও প্রায় ৯ লক্ষ ৬৪ হাজার বার দেখা হয়েছে। ভিডিওটিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৮ হাজার ভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে, ভিডিওটি প্রায় ১০ হাজার বার শেয়ার করা হয়েছে এবং এতে প্রায় ৭ হাজার ৬০০ টি মন্তব্য করা হয়েছে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি মুসলমানরা মানসিকভাবে অসুস্থ ও উন্মাদ বলে কোনো মন্তব্য করেননি বরং একাধিক ভুল তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে উক্ত দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ফেসবুকে ভাইরাল ভিডিওগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ভিডিওটির এক কোণে ‘Mahfuj Ibna-Al Delowar’ নামে এক ব্যক্তির নাম ভিডিও কার্টেসি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই সূত্রে গত ১ ফেব্রুয়ারি ‘Mahfuj Ibn Al-DelowAr’ নামের একটি ফেসবুক আইডিতে একই ভিডিও (আর্কাইভ) পাওয়া যায়। জনাব মাহফুজের উক্ত পোস্টের ক্যাপশন থেকে জানা যায়, ভিডিওতে থাকা তথ্যটি তিনি ‘শাইখ মুনীর আস সাদী আল আদানী’ নামের এক ব্যক্তির বক্তব্য থেকে পেয়েছেন।
এই সূত্রে আরবি ভাষায় কি-ওয়ার্ড সার্চ করে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আরবি নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে শায়খ মুনির আস-সাদি আল-আদানি’র মেসিকে নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের একটি ভিডিও (আর্কাইভ) পাওয়া যায়। আরবি ভাষার বক্তব্যটি অনুবাদ করে জানা যায় তিনি তার বক্তব্যে বলেছেন, “আজ আমি এই ঘৃণ্য ও অপবিত্র মেসি সম্পর্কে শুনেছি—বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, আমরা কেন তাকে সমর্থন করি এবং ভালোবাসি। স্কাই চ্যানেলের একটি সাক্ষাৎকারে সে বলেছে, “রমজানে মুসলিমরা কেন তারাবিহ নামাজ পড়ে? এবং কেন তারা সারাদিন খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকে?” সে তাদেরকে (মুসলিমদের) অসুস্থ বলে আখ্যায়িত করেছে এবং বলেছে যে মুসলমানদের সমর্থন পাওয়া তার জন্য সম্মানের বিষয় নয়। এই ঘৃণ্য, অপবিত্র ব্যক্তি সম্পর্কে আপনাদের কি মতামত? হ্যাঁ, সেই দুষ্ট, খ্রিষ্টান অবিশ্বাসী। হ্যাঁ, অর্থাৎ আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া মুসলিম যুবকেরা প্রায় তার প্রতি উন্মাদ হয়ে যায়। দেখুন, সে মুসলিমদের সম্পর্কে কি বলে। আল্লাহর কসম, এমন একজন ব্যক্তি কি বলে দেখুন। আপনাদের কাছে আমি অনুরোধ করছি যে এই ব্যক্তির নোংরামি ও তার অপবিত্রতা মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে দিন, যাতে তারা তাকে আঁকড়ে না ধরে, না ভালোবাসে, এমনকি তার ছবির দিকেও না তাকায়।”
অর্থাৎ শায়খ মুনির আস-সাদি আল-আদানি দাবি করেছেন যে, স্কাই চ্যানেলে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে লিওনেল মেসি মুসলিমদের রমজান মাসে খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ এবং তারাবিহ নামাজ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন এবং মুসলিমদেরকে মানসিকভাবে অসুস্থ ও উন্মাদ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরো দাবি করেছেন যে, মেসি বলেছেন মুসলিমদের সমর্থন পাওয়া তার জন্য কোনো সম্মানের বিষয় নয়।
এই বিষয়ে সত্যতা যাচাই করার জন্য আমরা স্কাই টিভি এবং স্কাই স্পোর্টসের ওয়েবসাইট এবং সামাজিক মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলো পর্যবেক্ষণ করেছি, কিন্তু মেসির এমন কোনো মন্তব্যের কোনো প্রমাণ সেখানে পাওয়া যায়নি। মেসির মতো একজন প্রখ্যাত ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব যদি ধর্মীয় বিষয়ে এমন আপত্তিকর মন্তব্য করতেন, তা নিশ্চিতভাবে বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত হতো। কিন্তু মেসির এমন কোনো মন্তব্যের তথ্য বিশ্বস্ত কোনো সূত্রে পাওয়া যায়নি। এর ফলে এটি পরিষ্কার যে মেসির বিরুদ্ধে করা এই দাবির কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই।
তবে শায়খ মুনীর আস সাদী আল আদানী বক্তব্যের একটি অংশ যেখানে তিনি দাবি করেন “মেসি বলেছেন মুসলিমদের সমর্থন পাওয়া তার জন্য কোনো সম্মানের বিষয় নয়” সে প্রসঙ্গে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরব ভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান মিসবারে প্রকাশিত একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। মিসবারের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মেসি এমন কোনো মন্তব্য করেননি। এই মন্তব্যটি প্রথম ২০১৫ সালে Wakila Info নামের একটি স্যাটায়ার ফেসবুক পেজে প্রকাশিত হয়। মূলত বিনোদনের উদ্দেশ্যে এমন কাল্পনিক মন্তব্য প্রচার করে তারা। আর্জেন্টিনা কাতার বিশ্বকাপ জেতার পর ২০১৫ সালে তৈরিকৃত এই ভুয়া মন্তব্যটি ইন্টারনেটে পুনরায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
জনাব মাহফুজ উক্ত ফেসবুক পোস্টের কমেন্টে মেসি সম্পর্কিত আলোচ্য তথ্যটির পক্ষে আরবি ভাষার সংবাদের একটি ভিডিও সূত্র হিসেবে যুক্ত করেছেন।
উক্ত ভিডিওর সূত্রে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানে একই ভিডিও প্রতিবেদন (আর্কাইভ) ‘Ăm Ïñë’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডিওটি অনুবাদের মাধ্যমে জানা যায়, উক্ত ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে মেসি ইসরায়েলে এক মিলিয়ন ইউরো অনুদান দিয়েছেন। ভিডিওতে আরোও দাবি করা হয়, মেসি রমজানের পবিত্র মাসে রোজা এবং প্রার্থনা করে নিজেদের কষ্ট দেওয়ার কারণে মুসলিমদেরকে অসুস্থ বলে অপমান করেছেন।
উক্ত ভিডিওর এক কোণে আরবি ভাষায় একটি লোগো লক্ষ্য করা যায়। লোগোটির সূত্রে জানা যায় উক্ত ভিডিওটি শুরুক নিউজ (Shorouk News) নামের মিশরীয় একটি গণমাধ্যমের। তবে গণমাধ্যমটির ফেসবুক পেজ কিংবা অন্য কোনো সামাজিক মাধ্যমে এই প্রতিবেদনটি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ভিডিও প্রতিবেদনটিতে দাবিকৃত ইসরায়েলে মেসির অনুদানের বিষয়টি যাচাইয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ম্যাগাজিন দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্টে এ বিষয় নিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ইসরায়েলের জন্য লিওনেল মেসির ১ মিলিয়ন ইউরো দানের তথ্যটি ভুয়া। লে কম্পেটিটর (Le Compétiteur) নামের আলজেরিয়ান প্যারোডি ওয়েবসাইট থেকে এই তথ্যটি ছড়িয়েছিল। উক্ত প্যারোডি সাইটটিতে বিনোদনের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত প্রতিবেদন সত্য ভেবে বিষয়টি বিভিন্ন দেশের মূলধারার গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছিল।
লন্ডন ভিত্তিক প্যান-আরব সংবাদ সংস্থা দ্য নিউ আরব এবং মিশরীয় গণমাধ্যম ইউম৭ (Youm7) থেকেও একই তথ্য জানা যায়।
অর্থাৎ, ইসরায়েলের জন্য লিওনেল মেসির ১ মিলিয়ন ইউরো দানের তথ্যটিও ভুয়া।
এছাড়া শুরুক নিউজের প্রতিবেদনের একাংশে মেসিকে ইহুদিদের তীর্থস্থান পরিদর্শনের কিছু দৃশ্য ব্যবহার করতে দেখা যায়। এমন কয়েকটি ছবি ব্যবহার করে প্রায়ই দাবি করা হয় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়েছে মেসি। তবে উক্ত ছবিটি বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের শান্তি সফরের। ২০১৩ সালের এই সফরে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন উভয় ভূখণ্ডে ভ্রমণ করে দলটি (১,২,৩)। এছাড়া এখন অবধি ফিলিস্তিন কিংবা ইসরায়েল কোনো দেশকেই সমর্থনের কথা প্রকাশ্যে জানায়নি মেসি ।
তাছাড়া মুসলিমদের রোজা রাখা প্রসঙ্গে মেসির এরূপ মন্তব্যও বিশ্বস্ত কোনো সূত্রে পাওয়া যায়নি। শুরুক নিউজের কাছে এই প্রতিবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়ে এবং প্রতিবেদনটি বর্তমানে তাদের ওয়েবসাইট কিংবা অন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় না পাওয়ার কারণ জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলেও এখন অবধি কোনো প্রত্যুত্তর পাওয়া যায়নি।
মূলত, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আর্জেন্টাইন ফুটবল তারকা লিওনেল মেসিকে নিয়ে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওটির মাধ্যমে দাবি করা হয়, স্কাই চ্যানেলে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে লিওনেল মেসি মুসলিমদের রমজান মাসে খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ এবং তারাবিহ নামাজ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন এবং মুসলিমদেরকে মানসিকভাবে অসুস্থ ও উন্মাদ বলে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। দাবি করা হয়, মেসি বলেছেন মুসলিমদের সমর্থন পাওয়া তার জন্য কোনো সম্মানের বিষয় নয়। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে স্কাই চ্যানেলে মেসির দেওয়া এমন কোনো মন্তব্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তাছাড়া ‘মুসলিমদের সমর্থন পাওয়া তার জন্য কোনো সম্মানের বিষয় নয়’ শীর্ষক তথ্যটি ২০১৫ সালে Wakila Info নামের একটি স্যাটায়ার ফেসবুক পেজ থেকে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল পোস্টগুলোতে এ দাবির স্বপক্ষে উপস্থাপিত সূত্রগুলোও রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে ভুল বলে প্রমাণিত হয়।
সুতরাং, লিওনেল মেসি মুসলমানরা মানসিকভাবে অসুস্থ ও উন্মাদ বলেছেন দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s own analysis.
- Saja H. Mortada, AFCN manager.
- Misbar – تصريح مفبرك منسوب لميسي عن موقفه من تشجيع العرب والمسلمين له
- The National Interest – Iranian Press, Citing Algerian Parody Site, Claims Lionel Messi Donated €1m to Israel
- FC Barcelona – Trip to Israel and Palestine in quest to build bridges of peace through sport