সম্প্রতি “খালেদা জিয়া ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে বক্তব্য দিতে পারবেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে কোন বাঁধা নাই – আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তথ্যসূত্রঃ আরটিভি।” শীর্ষক শিরোনামের একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নাম উদ্ধৃত করে প্রচার করা হচ্ছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এরকম কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত বক্তব্যটি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দেন নি বরং পুরো বক্তব্যের একটি খন্ডিত অংশ ব্যবহার করে ভুলভাবে প্রচার করা হচ্ছে।
গুজবের সূত্রপাত
অনুসন্ধানে উক্ত বক্তব্যের সাথে ব্যবহৃত পোস্টারটি পর্যবেক্ষণ করে পোস্টারের বাম পাশে নিচে 1A News নামক একটি লোগো দেখা যায়।
উক্ত নামে ফেসবুকে সার্চ করে 1A News নামক একটি ফেসবুক পেজ পাওয়া যায়। উক্ত পেজ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, পেজটি লন্ডন, যুক্তরাজ্য থেকে পরিচালিত একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম। উক্ত পেজে গত ২ ডিসেম্বর আইনমন্ত্রীর নাম উদ্ধৃত করে উক্ত বক্তব্যের পোস্টারটি খুঁজে পাওয়া যায়।
যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, উক্ত পেজ থেকেই সর্বপ্রথম আইনমন্ত্রীর নাম উদ্ধৃত করে বক্তব্যটি প্রচার করা হয়।
তথ্যযাচাই
উক্ত পোস্টটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, পোস্টটির ক্যাপশনে আরটিভির সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তীতে কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে, গত ২ ডিসেম্বর আরটিভির অনলাইন সংস্করণে “‘খালেদা রাজনীতি করতে পারবেন না, এমন তথ্য ঠিক নয়” শীর্ষক শিরোনামের একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে নারায়নগঞ্জের একটি অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রীর একটি বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে,
“বিএনপি বারবার বলছে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে। তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলব, তিনি তো মুক্ত। তাকে মুক্তি দেওয়ার কি আছে। তাকে দিয়ে ১০ ডিসেম্বর বক্তব্য দেওয়াতে চান ভাল কথা, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তাকে যে দুই শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়েছে তাতে প্রমাণ হয় তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, এমন তথ্য ঠিক নয়। নারায়ণগঞ্জে একটি অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এসব কথা বলেছেন।”
তবে পুরো প্রতিবেদনটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, খালেদা জিয়া সম্পূর্ণ মুক্ত কিংবা তার রাজনীতি করা বা সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো জটিলতা নেই, এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা পাওয়া যায় নি।
পরবর্তীতে, কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে, Bangladesh Grassroot AwamiLeague নামক ইউটিউব পেজে গত ২ ডিসেম্বর “নারায়নগঞ্জে আইনজীবীদের সেলিম ওসমান বার ভবন উদ্বোধনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শামীম ওসমান, সেলিম ওসমান” শীর্ষক শিরোনামের ২১ মিনিট ৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওতে আরটিভিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ব্যবহৃত বক্তব্যটির সম্পূর্ণ অংশটি পাওয়া যায়।
উক্ত ভিডিওতে আইনমন্ত্রী বলেন,
“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই শর্তে দন্ডাদেশ স্থগিত রেখে ৪০১ ধারায় খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, “কালকেও আমি শুনেছি, খবরের কাগজে দেখেছি উনারা (বিএনপির নেতাকর্মীরা) বক্তৃতা করেন খালেদা জিয়ার মুক্তি দিতে হবে, উনি (খালেদা জিয়া) তো মুক্ত, উনি মুক্ত, উনি উনার বাসায় আছেন, প্রায়সময়ই উনি চিকিৎসা নেয়ার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে যান।”
১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশে খালেদা জিয়ার বক্তব্য দেয়ার বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন,
“যে দুইটা শর্ত দেয়া হয়েছে এর মধ্যে কিন্তু ‘তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না’ এমন শর্ত নাই”। কিন্তু একটা কথা, উনাদের যে আবেদন (যে আবেদনের প্রেক্ষিতে খালেদা জিয়াকে ৪০১ ধারায় মুক্তি দেয়া হয়) ছিলো, সেই আবেদনের মধ্যে পরিষ্কারভাবে লেখা ছিলো যে তার (খালেদা জিয়ার) শারীরিক অবস্থা এতোই খারাপ যে তিনি চলাফেরা করতে পারেন না, তাকে অবশ্যই মুক্তি দিয়ে তার চিকিৎসা করাতে হবে। তাহলে যদি ১০ তারিখে বেগম খালেদা জিয়া বক্তব্য দিতে যান তাহলে দরখাস্তে যে লেখা ছিলো সেটি কি মিথ্যা প্রমাণিত হবে না? আপনাদের কাছে আমার এটুকুই কথা”।
অর্থাৎ, উক্ত ভিডিও বার্তায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সম্পূর্ণ বক্তব্যটি পরিস্কার হয়। যা থেকে তিনি পরোক্ষভাবে খালেদা জিয়ার সমাবেশে অংশগ্রহণ জামিন আবেদনের লঙ্ঘন বলে ইঙ্গিত করেন।
তবে আরটিভিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উক্ত বক্তব্যটির খন্ডিত অংশ উপস্থাপন করায় বিষয়টি ভুলভাবে প্রচারিত হতে থাকে।
পরবর্তীতে অধিকতর অনুসন্ধানে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে গত ২ ডিসেম্বর “খালেদা জিয়া বিএনপির সমাবেশে গেলে দরখাস্ত মিথ্যা প্রমাণিত হবে: আইনমন্ত্রী” শীর্ষক শিরোনামের একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়,
“ওনারা (বিএনপি নেতারা) বলেছেন ডিসেম্বরের ১০ তারিখে ওনাকে (খালেদা জিয়াকে) দিয়ে বক্তৃতা দেওয়াবেন। যে দুটি শর্তে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, ওই দুটি শর্তে তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না—এটা নেই। কিন্তু ওনাদের যে আবেদন ছিল, তাঁর শারীরিক অবস্থা এতো খারাপ, তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। তাকে অবশ্যই তাড়াতাড়ি মুক্তি দিয়ে তার চিকিৎসা করাতে হবে। তাহলে যদি খালেদা জিয়া ১০ তারিখে যান, তাহলে ওই যে দরখাস্ত, যে লেখা ছিল সেটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে না?”
মূলত, গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশে খালেদা জিয়ার বক্তব্য দেয়ার ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের প্রেক্ষিতে সমাবেশে অংশগ্রহণের বিষয়টি নাকচ করেন। তবে উক্ত বক্তব্যের খন্ডিত অংশ ভুলভাবে উপস্থাপনের কারণে সমাবেশে অংশগ্রহণ ও রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার বাঁধা নেই দাবিতে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে।
সুতরাং, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশে খালেদা জিয়ার বক্তব্য দেয়ার বা উপস্থিতি নিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যকে খণ্ডিত আকারে প্রচার করা হচ্ছে; যা বিভ্রান্তিকর।