সম্প্রতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন জোবরা গ্রামের স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা পরই একটি ভিডিওটি প্রচার করে ‘ভয়েস অব বাংলাদেশি হিন্দুস’ নামের একটি টুইটার হ্যান্ডেল জোবরা গ্রামকে বৌদ্ধ এলাকা উল্লেখ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও জামায়াত মিলে ওই গ্রামের সংখ্যালঘু বৌদ্ধ ও হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে বলে দাবি করেছে।
ভিডিওতে সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে একদল যুবককে ওই গ্রামে প্রবেশ করতে দেখা যায় এবং এসময় ওই যুবকদেরকে একটি বসতবাড়িতে ঢিল ছুঁড়তে দেখা যায়।
এক্স, ইউটিউব এবং ফেসবুকে উক্ত দাবিতে প্রচারিত একটি করে পোস্ট এখানে, এখানে এবং এখানে।

ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেনাবাহিনী ও জামায়াত কর্তৃক জোবরা গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়নি। জোবরা গ্রাম বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকা নয় এবং সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। সাম্প্রতিক সংঘর্ষটি ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে, যার সঙ্গে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোনো সম্পর্ক নেই।
অনুসন্ধানে প্রচারিত ভিডিওটি চবি শিক্ষার্থী ও জোবরা গ্রামের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনার হিসেবে পাওয়া যায়। আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীকে সাথে নিয়ে শিক্ষার্থীরা জোবরা গ্রামে প্রবেশ করার পরের ভিডিও এটি। ভিডিওতে শিক্ষার্থীদের বাড়িঘরে ঢিল ছুঁড়ে আক্রমন করতেও দেখা যায়।
জোবরা গ্রামে এলাকাবাসীর সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামে শনিবার (৩০ আগস্ট) রাত সাড়ে ১১টার দিকে একটি ভাড়া বাসায় প্রবেশের ঘটনায় একজন ছাত্রীর সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীর বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে ওই ছাত্রী তার এক সহপাঠীকে খবর দেন। পরে কয়েকজন শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলে গেলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ওই ছাত্রীকে নিরাপত্তা প্রহরী শারীরিকভাবে হেনস্তা করেছেন।
ভাড়া বাসার দারোয়ান তাকে মারধর করেছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আরও অনেক শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে প্রতিবাদ করতে থাকেন এবং ঘটনার সঙ্গে যুক্ত “দারোয়ানকে” তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানান। এরপর এটি ঘটনাক্রমে এলাকাবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে পরিণত হয় এবং দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি শুরু হয়, যা রাত চারটা পর্যন্ত চলে বলে জানা যায়। মসজিদের মাইক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হামলা করতে এসেছে বলে ঘোষণা দিয়ে এলাকাবাসীকে জড়ো করা হয় বলেও জানা গেছে। রবিবার দুপুর ১২ টায় ফের সংঘর্ষ শুরু হয় যা বেলা ৩ টা পর্যন্ত চলে।
সংঘর্ষে লাঠি ও ইটপাটকেলের পাশাপাশি রামদা ও অন্যান্য ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। জোবরা গ্রাম একপর্যায়ে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শিক্ষার্থীরা গ্রামে ছড়িয়ে থাকা অলিগলিতে আটকা পড়ে এবং তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্র ও পরে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
সংঘর্ষ চলাকালে জোবরা গ্রামে বাড়ি ও দোকান-ঘরে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এই ধরনের ভাঙচুর শনিবার রাতে এবং রোববার বিকেলে সংঘটিত হয়েছে।
অর্থাৎ, জোবরা গ্রামের স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘাত কোনোভাবেই ধর্মীয় কারণে ঘটেনি এবং এখানে কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে লক্ষ্য করে হামলার ঘটনা ঘটেনি। এটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের একটি ঘটনা।
জোবরা গ্রামকে বৌদ্ধ এলাকা হিসেবে দাবি করার বিষয়টি নিয়েও আমরা খোঁজ নিয়েছি। সংবাদপোর্টাল ঢাকা মেইল-এর চবি প্রতিনিধি রেদোয়ান আহমেদ জানান, জোবরা গ্রামে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এখানে একটি বৌদ্ধ পাড়া আছে, যার নাম বড়ুয়া পাড়া, তবে সেখানে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “এটা ঠিক যে জোবরা গ্রামের উত্তরপাশে একটি বৌদ্ধ পাড়া আছে, তবে এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ মুসলিম।” তিনি আনুমানিক হিসেবে বলেন, ওই গ্রামের প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ মুসলিম এবং বাকিরা মূলত অমুসলিম বড়ুয়া (বৌদ্ধ) হতে পারে।
সুতরাং, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং জোবরা এলাকাবাসীর সংঘর্ষের ঘটনাকে বৌদ্ধ ও হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা বলে প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Prothom Alo and DW Bangla
- Statements from a journalist and a teacher
- Rumor Scanner Investigation