২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ পুলিশে নিয়োগের বিষয়ে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসতে দেখছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
ফেসবুকের পোস্টগুলোতে দাবি করা হয়, শুধু বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগেই ৮০ হাজার ভারতীয় হিন্দুরা চাকরি করে।
কিছু পোস্টে সূত্র হিসেবে মূল ধারার সংবাদমাধ্যম ‘যমুনা টেলিভিশন’ এর নামও উল্লেখ পাওয়া যায়। এমনকি কোনো কোনো পোস্টে যমুনা টিভির একটি প্রতিবেদনে ভিডিও ক্লিপ এই দাবির স্বপক্ষে উপস্থাপন করতেও লক্ষ্য করা গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এ সংক্রান্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
একই সময়ে যমুনা টিভির ভিডিও প্রতিবেদন যুক্ত করে এ সংক্রান্ত দাবিতে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে ইউটিউবের ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ পুলিশে ৮০ হাজার ভারতীয় চাকরি করে দাবিতে যমুনা টিভি কোনো সংবাদ প্রচার করেনি বরং এ সংক্রান্ত দাবির পক্ষে যমুনার যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করা হচ্ছে তাতেও উক্ত দাবিতে কোনো তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে যমুনা টিভির আলোচিত প্রতিবেদনটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এটি যমুনা টিভির অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠান ইনভেস্টিগেশন থ্রি সিক্সটি ডিগ্রির একটি পর্বের ক্লিপ।
ফেসবুকে টিম থ্রি সিক্সটি ডিগ্রির ফেসবুক পেজে ২০১৫ সালের ০৫ অক্টোবর প্রকাশিত এ সংক্রান্ত মূল ভিডিওটি খুঁজে পেয়েছি।
২০১৮ সালের ০২ ডিসেম্বর যমুনা টিভির ইউটিউব চ্যানেলেও “পুলিশ নিয়োগ: সরিষায় ভূত” শীর্ষক একই শিরোনামে ভিডিওটি প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত ভিডিওর প্রসঙ্গে যমুনা টিভি ডেসক্রিপশনে অংশে লিখেছে, নিজ এলাকার কোটা না পেয়ে অন্য এলাকার ভূয়া ঠিকানা ব্যবহার করে পুলিশে চাকরি হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু মানুষ। নিয়োগ প্রক্রিয়ার একটি ধাপ, পুলিশ ভ্যারিফিকেশন। তবে এখানেই কিভাবে ভুয়া নাম ঠিকানার বিষয়টি পার পেয়ে যায় তা এক রহস্য। এ নিয়ে আমাদের ইনভেষ্টিগেশন – “পুলিশ নিয়োগ: সরিষায় ভূত।”
এছাড়া অনুষ্ঠানটি সেসময়ের নয়। এটি প্রথম ২০১৫ সালের ১০ এপ্রিল প্রচারিত হয় বলে জানিয়েছে গণমাধ্যমটি।
আমরা ২৪ মিনিট ৩ সেকেন্ডের পুরো ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, পুলিশের চাকরিতে এক জেলার লোক আরেক জেলায় অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ নিয়ে অনুসন্ধানের বিষয়টি উঠে এসেছে। কিন্তু মূল ভিডিওটি কোনো অংশেই বাংলাদেশ পুলিশে ভারতীয়দের নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
কীভাবে সূত্রপাত এই দাবির?
যমুনা টিভির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আলোচিত এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রচার হয় ২০১৫ সালের ১০ এপ্রিল। আমরা এই তারিখের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে দেখেছি, BD Tiger নামে একটি ফেসবুক প্রোফাইল থেকে এই ভিডিওটি সমজাতীয় একটি দাবিতে প্রকাশ (আর্কাইভ) করা হয় এর চারদিন পর, ১৪ এপ্রিল। ভিডিওটি পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখা হয়, “সরিষার ভিতরে ভুত শত শত পুলিশ নিয়োগ দিয়েছে কুত্তা হাসিনা ইন্ডিয়ান র ভিডিও টা দেখুন আর শেয়ার করুন।” (বানান ও শব্দচয়ন অপরিবর্তিত)
পরের বছরের (২০১৬) ২৩ এপ্রিল ‘Basherkella – বাঁশেরকেল্লা’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে একই ভিডিও (আর্কাইভ) প্রচার করে ক্যাপশনে লেখা হয়, “পুলিশ নিয়োগঃ সরিষায় ভৃত! ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের পুলিশ ??”
লক্ষ্য করুন, প্রথম দিকের দাবিগুলো সাম্প্রতিক সময়ের দাবির মতো ছিল না। সেসময় শেখ হাসিনা ভারতীয়দের পুলিশে চাকরি দিয়েছে, ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের পুলিশে চাকরি করছে শীর্ষক দাবিতে প্রচার হতে দেখা গেছে।
পরবর্তীতে ২০২০ সাল থেকে বর্তমান দাবিটি প্রচার পেতে শুরু করে। সেসময় এ সংক্রান্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
২০২১ সালে এ সংক্রান্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
কী বলছে যমুনা টিভি কর্তৃপক্ষ?
রিউমর স্ক্যানার টিম যমুনা টিভির ওয়েবসাইটসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় কিওয়ার্ড সার্চ করে এ ধরণের কোনো সংবাদের খোঁজ পায়নি। যমুনার ওয়েবসাইটের আর্কাইভ সংস্করণগুলোও যাচাই করে দেখেছি আমরা। কিন্তু এমন কোনো সংবাদের বিষয়ে জানা যায়নি।
আমরা এ বিষয়ে কথা বলেছি যমুনা টিভির চিফ নিউজ এডিটর মো: তৌহিদুল ইসলামের সাথে। তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, “এ রকম কোন নিউজের (প্রকাশের) কথা মনে পড়ছে না।” গণমাধ্যমটির নিউ মিডিয়া এডিটর রুবেল মাহমুদও রিউমর স্ক্যানার টিমকে একই তথ্য জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ পুলিশে কি ভিনদেশী নাগরিকদের নিয়োগের সুযোগ আছে?
বাংলাদেশ পুলিশে দুই উপায়ে নিয়োগের সুযোগ রয়েছে। একটি বিসিএস, অন্যটি নিজস্ব নিয়োগ। বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ থাকে যে, এই প্রক্রিয়ায় শুধু দেশের নাগরিকরাই আবেদন করতে পারবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ পুলিশের দেওয়া একাধিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, এক্ষেত্রেও জন্মসূত্রে বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিকদেরই শুধু আবেদনের সুযোগ রয়েছে।
আমরা এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ পুলিশ সুপার মাসরুফ হোসেনের সাথে কথা বলেছি। তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, বাংলাদেশ পুলিশের নিয়োগ হয় কন্সটেবল, সার্জেন্ট, এসআই এবং এএসপি পদে। এই পদসোপানের বাইরেও বাংলাদেশ পুলিশের আরো কিছু সিভিল এবং অস্থায়ী পদ রয়েছে, কিন্তু এর কোনোটাই “পুলিশ” -এর মূল পদসোপান ও কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ, তাঁরা সরাসরি “পুলিশিং” করতে পারবেন না। বাংলাদেশ পুলিশের কন্সটেবল থেকে আইজিপি পর্যন্ত পদসোপানে প্রত্যেককেই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে।
অর্থাৎ, নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুযায়ী বাংলাদেশ পুলিশে ভিনদেশী নাগরিকদের নিয়োগের সুযোগ নেই।
মূলত, ২০১৫ সাল থেকে যমুনা টিভির অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠান ইনভেস্টিগেশন থ্রি সিক্সটি ডিগ্রির একটি পর্বের বরাত দিয়ে দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগে ভারতীয় হিন্দুরা চাকরি করে। অন্তত ২০২০ সাল থেকে এ সংক্রান্ত দাবিটি প্রচারের সময় পুলিশে চাকরি করছে এমন ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ৮০ হাজার উল্লেখ করতে দেখা গেছে৷ কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, দাবিটি সঠিক নয়৷ যমুনা টিভি ইনভেস্টিগেশন থ্রি সিক্সটি ডিগ্রির উক্ত পর্বে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যই উল্লেখ করেনি। তাছাড়া, গণমাধ্যমটি এমন কোনো সংবাদও প্রকাশ করেনি। এছাড়া, নিয়োগ প্রক্রিয়ার নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ পুলিশে ভিনদেশী নাগরিকদের নিয়োগের সুযোগ নেই।
সুতরাং, যমুনা টিভির বরাত দিয়ে শুধু বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগেই ৮০ হাজার ভারতীয় হিন্দুরা চাকরি করে শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Jamuna Tv: পুলিশ নিয়োগ: সরিষায় ভূত
- Statement from Towhidul Islam, Jamuna Tv
- Statement from Rubel Mahmood, Jamuna Tv
- Statement from Mashroof Hossain, Bangladesh Police
- Rumor Scanner’s own investigation