সম্প্রতি ‘পবিত্র রমজান মাসে মাইক ও লাউডস্পিকারে রাষ্টীয়ভাবে আজান ও মসজিদে ইফতার নিষিদ্ধ করলো ইসলামের জন্মভূমি সৌদি আরব’ শীর্ষক শিরোনামে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন বাংলা হান্ট নিউজ, এই সময়৷
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সৌদি আরবে রমজান মাসে মাইক ও লাউডস্পিকারে রাষ্টীয়ভাবে আজান ও মসজিদে ইফতার নিষিদ্ধের দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে দেশটিতে এমন কোনো নিষেধাজ্ঞাই দেওয়া হয়নি।
কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে সৌদি আরবের ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের টুইটার একাউন্টে গত ৩ মার্চ ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রী ড. আব্দুল লতিফ আল শায়েখের বরাতে একটি বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়।
১০ টি ধারা সম্বলিত এই বিজ্ঞপ্তিটির কোথাও আজানে মাইক ও লাউডস্পিকারের ব্যবহার নিয়ে কোনো বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
তবে বিজ্ঞপ্তিটির ৬ষ্ঠ ধারায় মসজিদে ক্যামেরা স্থাপনের বিষয়ে একটি নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে বলা হয়, মসজিদে ক্যামেরা স্থাপন ও মসজিদের ইমাম ও মুসল্লিরা প্রার্থনার সময় সেগুলোব্যবহারের বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে। পাশাপাশি কোনো ধরনের মিডিয়ায় নামাজের বিষয় প্রচার করা যাবে না।
এছাড়া ৯ম ধারায় বলা হয়েছে, রমজান মাসে রোজাদারদের জন্য ইফতারের আয়োজন মসজিদের আঙিনা বা চত্ত্বরে মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের দায়িত্বে করতে হবে এবং ইফতার শেষ হওয়া মাত্র মসজিদের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক গণমাধ্যম Middle East Monitor এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে সৌদি ইসলাম ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্দুল্লাহ আল এনেজি বলেন, মন্ত্রণালয় মসজিদে ইফতারে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। বরং মসজিদের পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় ইফতার মসজিদ চত্ত্বরে আয়োজনের বিষয়ে বলা হয়েছে।
পরবর্তীতে অধিকতর অনুসন্ধানে সৌদি আরব ভিত্তিক গণমাধ্যম Saudi Gazette এ চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি ‘Saudi Arabia limits external loudspeakers in mosques‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, দেশটির ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রী ড. আব্দুল লতিফ বিন আব্দুল আজিজ আল শায়েখ মসজিদগুলোতে আজানের জন্য বাইরে ব্যবহৃত লাউডস্পিকারের সংখ্যা ৪ টির মধ্যে সীমিত করে দিয়েছেন৷ পাশাপাশি ৪ টির অতিরিক্ত বাহ্যিক সকল লাউডস্পিকার সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছেন।
অর্থাৎ দেশটিতে আজানের জন্য মসজিদের বাইরে সর্বোচ্চ চারটি লাউডস্পিকার ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে লাউডস্পিকার ব্যবহার করে আজান নিষিদ্ধের কোনো নির্দেশনা এই প্রতিবেদন থেকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক গণমাধ্যম Gulf News এর একইদিনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন সূত্রেও একই তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
পাশাপাশি প্রতিবেদনটি সূত্রে আরও জানা যায়, দেশটির মন্ত্রণালয় রমজান মাস চলাকালে মসজিদে লাউডস্পিকারের ভলিউম ব্যবহারের উপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে। স্পিকার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তিন স্তরের ভলিউম ব্যবহার করা যাবে।
এই তথ্যের সূত্রে পরবর্তী অনুসন্ধানে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক আরেকটি গণমাধ্যম Al Jazeera তে ২০২১ সালের পহেলা জুন ‘Saudi minister defends volume limit on mosque loudspeakers‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে উক্ত তথ্যের সত্যতা মিলে।
পাশাপাশি প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, লাউডস্পিকারে পুরো নামাজ প্রচারের পরিবর্তে কেবল আজানের জন্য লাউডস্পিকারের ব্যবহার সীমিত করে নিয়ে আসতে হবে৷
প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, দেশটির সরকার মূলত উচ্চ ভলিউম শিশু ও বয়স্কদের বিরক্ত করছে-নাগরিকদের থেকে পাওয়া এমন অভিযোগের ভিত্তিতেই লাউডস্পিকার ব্যবহার নিয়ে উপরিউক্ত নির্দেশনাটি জারি করে।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, দেশটিতে আজান দেওয়ার ক্ষেত্রে লাউডস্পিকার নিষিদ্ধ নয়। প্রকৃতপক্ষে লাউডস্পিকারের উচ্চ ভলিউম শিশু ও বয়স্কদের বিরক্ত করছে-নাগরিকদের থেকে পাওয়া এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সৌদি সরকার ২০২১ সালে লাউডস্পিকারের ভলিউম সর্বোচ্চ তিন স্তর পর্যন্ত রাখার নির্দেশ দেয় এবং একইসাথে আরও নির্দেশ দেয় যে, লাউডস্পিকারে পুরো নামাজ প্রচারের পরিবর্তে কেবল আজানের জন্য এটি ব্যবহার করতে হবে।
মূলত, ভারতীয় বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে যে, পবিত্র রমজান মাসে সৌদি আরবে মাইক ও লাউডস্পিকারে রাষ্টীয়ভাবে আজান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের সার্বিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, সম্প্রতি দেশটির ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় আসন্ন রমজান উপলক্ষে যেসব নির্দেশনা জারি করেছে, সেখানে লাউডস্পিকার ব্যবহার নিয়ে কোনো তথ্যের অস্তিত্ব নেই। এছাড়া সৌদি আরবে মাইক বা লাউডস্পিকারের ব্যবহারও নিষিদ্ধ নয় বরং ২০২৩ সালের একটি ঘোষণায় সৌদি সরকার মসজিদে লাউডস্পিকারের সংখ্যা সর্বোচ্চ চারটি নির্ধারিত করে দেয়। এছাড়া ইতোপূর্বে ২০২১ সালে লাউডস্পিকারের ভলিউম সর্বোচ্চ তিন মাত্রা রেখে ব্যবহারের ব্যাপারেও নির্দেশনা জারি করেছিল দেশটির উক্ত মন্ত্রণালয়।
সুতরাং, সৌদি আরবে রমজান মাসে মাইক ও লাউডস্পিকারে রাষ্টীয়ভাবে আজান নিষিদ্ধের দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Saudi Islamic Affairs: Ministry of Foreign Affairs,India Tour
- Saudi Gazette: Saudi Arabia limits external loudspeakers in mosques
- Gulf News: Saudi Arabia restricts loudspeakers to 4 to make prayer calls in all mosques across the kingdom
- Al Jazeera: Saudi minister defends volume limit on mosque loudspeakers
- Middle East Monitor: Saudi Arabia imposes restrictions on Ramadan practices, limiting loudspeakers and surveiling worshippers