সম্প্রতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাতীয় দৈনিক ডেইলি স্টার-এর ওয়েবসাইটের আদলে তৈরি একটি ওয়েবসাইটের লিংক ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে দাবি করা হচ্ছে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং কথিত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান PrimeAurora যৌথভাবে একটি নতুন বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম চালু করেছেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মাত্র ৩১,০০০ টাকা বিনিয়োগ করলেই প্রতি সপ্তাহে ১২ লাখ টাকা আয়ের নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। এছাড়া, প্রাথমিকভাবে ৫,০০০ জন বিনিয়োগকারী এই সুযোগ পাবেন এবং বর্তমানে ৯৬৪টি স্লট খালি রয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে।

উক্ত প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, Prime Aurora নামের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে স্বল্প সময়ে ৩১ হাজার টাকা থেকে বিপুল মুনাফা অর্জনের দাবিটি ভিত্তিহীন। প্রকৃতপক্ষে, ডেইলি স্টারের আদলে তৈরি একটি ভুয়া ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নাহিদ ইসলামসহ পরিচিত ব্যক্তিদের নাম ও ছবি ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলার উদ্দেশ্যে এই দাবি ছড়ানো হচ্ছে।
দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের এমন কোনো বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম চালু করার বিষয়ে বিশ্বস্ত কোনো সূত্রে তথ্য পাওয়া যায়নি।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ডেইলি স্টার এর আদলে তৈরি করা হলেও সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটটি গণমাধ্যমটির আসল ওয়েবসাইট নয়। প্রতিবেদনটি wynterinvestments.com নামের একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে, যা ডেইলি স্টার এর ডিজাইন নকল করে তৈরি করা হয়েছে। গণমাধ্যমটি একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

কথিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশের দুটি সরকারি এবং দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পের উন্নয়নে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল), ডাচ্-বাংলা ব্যাংক পিএলসি (ডিবিবিএল) এবং বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম)। তবে, এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো বিনিয়োগ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। বিষয়টি যাচাই করতে প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যালোচনা করা হলেও প্রাইমঅরোরা নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের চুক্তির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এছাড়া, প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় এই বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্মের কার্যক্রম নিয়মিত তদারকি করছে, যাতে বিনিয়োগকারীদের সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। তবে, এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়নি, এবং কোনো বিশ্বস্ত সূত্রেও এর সত্যতা পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনটিতে আরিফ নূরুজ্জামান নামে এক ব্যক্তির অভিজ্ঞতার উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে দাবি করা হয়, তিনি মাত্র ৩১ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ৫ দিনের মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা আয় করেছেন। এই অংশে একজন ব্যক্তির ছবি সংযুক্ত করা হলেও, তার পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। ওপেন সোর্স অনুসন্ধানেও এই ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব মেলেনি। প্রতিবেদনটিতে তার ছবি থাকলেও তার কোনো ভিডিও বার্তা নেই। সাধারণত, এই ধরনের অভিজ্ঞতা শেয়ারের ক্ষেত্রে ভিডিও বার্তা বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়, কিন্তু এখানে শুধু লিখিত আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। ফলে এটি একটি ভুয়া রিভিউ বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রতিবেদনটিতে এসব তথ্য উল্লেখ করার পর একটি নির্দিষ্ট লিংকে গিয়ে নিবন্ধনের আহ্বান জানানো হয়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, উক্ত লিংকও ‘wynterinvestments.com’ নামের একই ডোমেইনের অধীনে রয়েছে। ডোমেইন সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, এটি ২০২৩ সালে নিবন্ধিত হয়েছে।
উক্ত ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে একটি ফরম প্রদর্শিত হয়, যেখানে নাম, ই-মেইল ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর প্রদান করতে বলা হয়। ফরম পূরণের পর এক কর্মদিবসের মধ্যে মুঠোফোনে যোগাযোগের আশ্বাস দেওয়া হয়। তবে তথ্য যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে রিউমর স্ক্যানার টিমের একজন প্রতিনিধি ফরমটি পূরণ করে দুই দিন অপেক্ষা করলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ফরম পূরণের ওয়েব পেজটিতে বেশ কিছু অসংগতি রয়েছে। এতে নাহিদ ইসলাম ও ড. ইউনূসের কথিত বক্তব্য তাদের ছবি সহ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সেখানে তাদের পরিচয় সংক্রান্ত কিছু তথ্যে গরমিল লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, নাহিদ ইসলামকে শুধু ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে ‘Chief Counselor of Bangladesh’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ, প্রচলিত প্রশাসনিক পরিভাষা অনুযায়ী, তাকে ‘Chief Advisor’ বলা হয়ে থাকে।
এছাড়া, ওয়েবসাইটটিতে দাবি করা হয়েছে এটি একটি ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ফরেক্স ট্রেডিং নিষিদ্ধ। সুতরাং, এই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সরকারের কোনো উপদেষ্টার যুক্ত থাকার দাবিও ভিত্তিহীন ও অবাস্তব।
PrimeAurora নামের কথিত প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে অনুসন্ধানে বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে আরও অনুসন্ধানে বারমুডার সাংবাদিক গ্যারি ফস্টার স্কেলটনের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। ওই পোস্টে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘Prime Aurora’ নামে একটি ভুয়া ক্রিপ্টো ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রতারণার কৌশল হিসেবে তার ও বারমুডার শ্রমমন্ত্রী জেসন হেওয়ার্ডের ছবি ও নাম ব্যবহার করে একটি ভুয়া অনলাইন নিবন্ধ তৈরি করা হয়েছে। সেই নিবন্ধে তাদের কাল্পনিক এক সাক্ষাৎকার দেখিয়ে Prime Aurora-তে বিনিয়োগকে লাভজনক বলে প্রচার করা হয়েছে।
গ্যারি ফস্টার স্কেলটন জানিয়েছেন, এটি একটি ভুয়া নিবন্ধ এবং তার বা মন্ত্রীর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন এবং বিশ্বস্ত সূত্র থেকে তথ্য যাচাই না করে কোনো সন্দেহজনক প্ল্যাটফর্মে সাইন আপ বা বিনিয়োগ না করার আহ্বান জানিয়েছেন।
গ্যারি ফস্টার স্কেলটনের বর্ণনার সঙ্গে নাহিদ ইসলামের নামে প্রচারিত ডেইলি স্টারের আদলে তৈরি ভুয়া ওয়েবসাইটের প্রচারণার মিল লক্ষ্য করা যায়।
সুতরাং, নাহিদ ইসলামের নাম ব্যবহার করে ডেইলি স্টারের আদলে তৈরি ভুয়া ওয়েবসাইটে Prime Aurora কথিত প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগের আলোচিত বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুয়া ও প্রতারণামূলক।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s investigation.
- Daily Star: Fake report on Adviser Nahid falsely attributed to Star
- Gary Foster Skelton: Instagram Post
- Rising BD: পুঁজিবাজারে ‘ফরেক্স’ চালুর উদ্যোগ: পাবে বৈধতা, কমবে ঝুঁকি, বাড়বে সম্ভাবনা