সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাতীয় দৈনিক কালবেলা’র একটি ফটোকার্ড প্রচার করে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, “এখন হয়ত শিক্ষার মান ভালো হতে পারে। ধন্যবাদ ড.ইউনুস স্যার”। প্রচারিত ফটোকার্ডটিতে লেখা রয়েছে, “বেত ব্যবহারের অনুমতি পেলেন শিক্ষকরা”।
অর্থাৎ, দাবি করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে বেত ব্যবহারের অনুমতি পেলেন শিক্ষকরা।

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষকদের বেত ব্যবহারের অনুমতির সংবাদটি বাংলাদেশের নয় বরং, ভারতের কেরালার সংবাদকে বাংলাদেশের দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রচারিত ফটোকার্ডটি লক্ষ্য করলে তাতে মূলধারার গণমাধ্যম কালবেলা’র লোগো এবং ফটোকার্ডটি প্রকাশের তারিখ হিসেবে ১৫ মার্চ ২০২৫ এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এরই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করলে কালবেলা’র ফেসবুক পেজে গত ১৫ মার্চে আলোচিত বিষয়ে প্রচারিত ফটোকার্ডটি পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়াকালীন সময়ে কালবেলার উক্ত ফটোকার্ডটির পোস্টটি সম্পাদিত হতে দেখা যায় এবং বর্তমান সংস্করণে ভারতের রাজ্য কেরালা’র নাম উল্লেখ করে লেখা রয়েছে, “শিক্ষকদের বেত ব্যবহারের অনুমতি দিল কেরালার হাইকোর্ট”।
উক্ত পোস্টটির মন্তব্য সেকশনে এ বিষয়ে একই শিরোনামে গত ১৫ মার্চে কালবেলা’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, “শিক্ষকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেত বহনের অনুমতি দেওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছে ভারতের দক্ষিণের কেরালা রাজ্যের হাইকোর্ট। আদালত জানিয়েছে, শিক্ষকের হাতে বেত থাকলে সেটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলবে এবং তাদের সামাজিক অপরাধ থেকে দূরে রাখবে। একই সঙ্গে আদালত রায়ে স্পষ্ট করেছে, এটি ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক নয়, বরং এটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে। শনিবার (১৫ মার্চ) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই রায়ের তথ্য জানা যায়।…”
এরই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় “Act only after probe in plaint against teachers: HC to cops” শীর্ষক শিরোনামে এ বিষয়ে গত ১৪ মার্চে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কেরালা হাইকোর্ট রায় দিয়েছে যে, শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অপরাধের অভিযোগ এলে আগে প্রাথমিক তদন্ত করতে হবে, তবে তদন্ত চলাকালে তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। এই রায় কেরালার তিরুবনন্তপুরমের এক শিক্ষককে আগাম জামিন দেওয়ার সময় দেওয়া হয়, যিনি ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রকে শত্রুতাবশত বেত দিয়ে মারধরের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন। তবে তিনি দাবি করেন, তিনি শত্রুতাবশত নয়, বরং শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সামান্য শাসন করেছিলেন।
আদালত মনে করে, শিক্ষকদের শুধু শিক্ষাদান নয়, শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বও আছে। তাদের সামান্য শাসনের জন্য শাস্তি দেওয়া উচিত নয়, কারণ তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথপ্রদর্শক। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা, মাদকাসক্তি ও শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনা বাড়ছে বলেও আদালত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আদালত মত দেয়, শিক্ষকেরা চাইলে স্কুলে বেত রাখতে পারবেন, তবে এটি ব্যবহার করা জরুরী নয়, বরং এটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি প্রতীকী সতর্কতা হয়ে থাকবে। তবে, অযৌক্তিক শারীরিক নির্যাতন বা কষ্ট দেওয়া কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তাই পুলিশকে প্রাথমিক তদন্তে প্রকৃত ঘটনা ও মিথ্যা অভিযোগের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে।
অর্থাৎ, এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, প্রচারিত ঘটনাটি বাংলাদেশের নয় বরং, ভারতের কেরালার।
তাছাড়া, জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’তে গত বছর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে একটি পরিপত্র জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে ২০২৩ সালে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “২০১০ সালে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড ও সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) দায়ের করা একটি রিট পিটিশনের (রিট পিটিশন নং ৫৬৮৪/২০১০) প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের শারীরিক শাস্তি অসাংবিধানিক (বিশেষ করে বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ৩১, ৩২, ৩৫ (৫) এর পরিপন্থী ) ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন। এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১১ ধরনের শারীরিক ও দুই ধরনের মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করতে ২০১১ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।”
এছাড়া, ২০২১ সালে ডয়চে ভেলে বাংলার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “বাংলাদেশের আইনে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ৷ ২০১১ সালে হাইকোর্টের এক আদেশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে৷ আর তাতে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির সংজ্ঞাও দেয়া হয়েছে৷ শারীরিক শাস্তি বলতে যেকোনো ধরনের দৈহিক আঘাত বলা হয়েছে৷ মারধর ছাড়াও আইনে কান ধরা, চুল টানা, বেঞ্চের নিচে মাথা রাখতে বাধ্য করাও দৈহিক শাস্তি৷ আর মানসিক শাস্তির মধ্যে শিশু বা তার পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বাজে মন্তব্য বা যেকেনো আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই দুই ধরনের শাস্তি দেয়াকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেছে৷ যাদের বিরুদ্ধে এই অপরাধ প্রমাণ হবে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ একই সঙ্গে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে৷”
তাছাড়া, প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলেও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেত ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, ভারতের কেরালায় শিক্ষকদের বেত বহনের অনুমতির ঘটনাকে বাংলাদেশ শিক্ষকদের বেত ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Kalbela – Facebook Post
- Kalbela – শিক্ষকদের বেত ব্যবহারের অনুমতি দিল কেরালা হাইকোর্ট
- Times of India – Act only after probe in plaint against teachers: HC to cops
- Prothom Alo – শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-বাড়িতে মারধর, চুল টানা, কান মলাসহ শিশুদের শাস্তি বন্ধ নেই
- Bangla Tribune – শিশুর শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে আইন করার আহ্বান
- DW Bangla – মাদ্রাসা বা স্কুল কোথাও রেহাই নেই