সম্প্রতি “কুড়িগ্রামের রাজারহাটে মন্দিরে হামলা করতে এসে, হাতেনাতে আটক ১০ জনেরো বেশি হিন্দু। মূল পরিকল্পনায় ৬৮ হিন্দু” শীর্ষক দাবিতে ৩৫ মিনিটের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে কোনো মন্দিরে হামলা করতে এসে ১০ জনেরও বেশি হিন্দু ব্যক্তি আটকের ঘটনা ঘটেনি। বরং, ওই এলাকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে হামলা হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়লে, সেই গুজবের সাথে জড়িতদের নিয়ে সালিশ হয় এবং সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করা হয়। ওই সালিশের একটি ভিডিওই আলোচ্য দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে দাবিকৃত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয় রিউমর স্ক্যানার টিম। ‘KM Mamun Ar-Rashid’ নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে ফেসবুক লাইভে ভিডিওটি প্রচার করা হয়।

ভিডিওটির শুরুতে ক্যামেরার পেছনে থাকা ব্যক্তি দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলেন, বৈদ্যের বাজার এলাকায় কিছু ষড়যন্ত্রকারী মহল ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে হিন্দুদের ওপর হামলা এবং মন্দির ভাঙচুরের পরিকল্পনা করেছিল। তবে তৌহিদী জনতার সতর্কতায় তাদের হাতেনাতে ধরা গেছে এবং এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে।
এরপর হিন্দুদের বাড়িঘর পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন দাবি করা একজন ব্যক্তি তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি বলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলার খবর পেয়ে তিনি সতর্ক ছিলেন এবং প্রয়োজনীয় জায়গায় পাহারা দিয়েছেন। তবে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, যাদের জন্য তিনি রাত জেগে পাহারা দিলেন, তারাই একটি পোস্টের মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর তিনি এক ব্যক্তির উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, পাহারা দেওয়া তার ভুল ছিল কিনা।
ভিডিওটির এক পর্যায়ে, জামায়াতে ইসলামীর সদস্য পরিচয় দেওয়া একজন ব্যক্তি ক্যামেরার পেছনে গিয়ে বলেন, কিছু দুর্বৃত্ত হিন্দু ব্যক্তি অপর হিন্দুদের ঘর ভেঙে জামায়েত এবং বিএনপির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছিল। তবে তারা এই ষড়যন্ত্রকারীদের হাতেনাতে ধরে ফেলে এবং এখন প্রকাশ্যে তাদের বিচার হচ্ছে। মূল হোতাদেরও ধরার চেষ্টা চলছে।
এরপর সুদীপ কুমার রায় নামে এক ব্যক্তিকে এই চক্রের মূল হোতা দাবি করে ক্যামেরার সামনে আনা হয়। সুদীপ কুমার জানান, তিনি গুজব প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে স্থানীয় সনাতনী ছেলেদের নিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলেছিলেন। কিন্তু গ্রুপের একজন সদস্য দুটি হিন্দু পরিবারের ওপর হামলার গুজব ছড়ালে তিনি সকলকে প্রমাণসহ তথ্য শেয়ার করতে বলেন। তবে গ্রুপের কিছু সদস্য বিভ্রান্তিকর তথ্য শেয়ার করতে থাকে, ফলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে সন্দেহে তিনি গ্রুপটি বাতিল করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি স্বীকার করেন যে, গ্রুপে ছড়ানো সব তথ্যই গুজব ছিল।
পরে, জামায়েত পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি জানান, তারা এলাকায় ঘোষণা দিয়েছিল যে, যারা হিন্দুদের বাড়িতে হামলা করবে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। এরপরও যারা এমন কাজ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি। এরপর, সভায় উপস্থিত বিএনপি এবং জামায়েতের অন্যান্য সদস্যরাও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানান।
পরবর্তীতে, গুজব ছড়ানো ব্যক্তি নিজে থেকে সামনে এসে স্বীকার করেন যে, অজ্ঞাত একটি ফোন নম্বর থেকে তিনি এই তথ্য পেয়েছিলেন এবং যাচাই না করেই সেটি গ্রুপে শেয়ার করেন। পরে, তিনি সবাইকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার জন্য ক্ষমা চান এবং সবাই তাকে ক্ষমা করে দেয়। ভিডিওর শেষ পর্যায়ে দেখা যায়, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে মিটিংটি শেষ হয়।
ভিডিওটি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ভিডিওর কোনো অংশেই কাউকে আটক করার দৃশ্য দেখা যায়নি। মূলত ভিডিওটির শুরুতে লাইভ ভিডিও ধারণকারী ব্যক্তির বিভ্রান্তিকর বক্তব্য এবং পোস্টের ক্যাপশনে ভুল ব্যাখ্যার কারণে এই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে।
বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতে রিউমর স্ক্যানার টিম কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার নির্বাহী অফিসার খাদিজা বেগমের সাথে যোগাযোগ করে। তিনি জানান, ভিডিওটি আমি দেখেছি। বিষয়টি ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে। তবে, ভিডিওটির ক্যাপশন বিভ্রান্তিকর ও আই ক্যাচিং। রাজারহাটে এখন পর্যন্ত কোনো হিন্দু মন্দির বা বাড়ি ঘরে হামলার খবর পাওয়া যায়নি।
একই বিষয়ে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আশীষ কুমার রায়ের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, একটি ভুল বোঝাবুঝির কারণে সাময়িক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল, তবে তা সমাধান করা হয়েছে এবং এলাকায় কোনো বড় সমস্যা হয়নি।
সুতরাং, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে মন্দিরে হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ এবং ১০ জনেরও বেশি হিন্দু ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ার দাবি নিয়ে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s own analysis.
- Statement from Khadija Begum, UNO, Rajarhat Upazila, Kurigram.
- Statement from Ashish Kumar Roy, UP member of Chinai Union, Rajarhat Upazila, Kurigram.