হাট্টিমাটিম টিম ছড়াটি ৫২ লাইনের নয়

দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘এত বছর পর্যন্ত জানতাম এই ‘হাট্টিমাটিম টিম’ ছড়াটা ৪ লাইন। আসলে এটা রোকনুজ্জামান খানের ৫২ লাইনের অসম্ভব সুন্দর একটি ছড়া।’ শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য প্রচার হয়ে আসছে। 

২০১৬ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন একটি পোস্ট দেখুন পোস্ট (আর্কাইভ)।
২০১৭ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন পোস্ট (আর্কাইভ),  পোস্ট (আর্কাইভ)।
২০১৮ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন পোস্ট (আর্কাইভ),  পোস্ট (আর্কাইভ)।
২০১৯ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন পোস্ট (আর্কাইভ),  পোস্ট (আর্কাইভ)।
২০২০ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন পোস্ট (আর্কাইভ),  পোস্ট (আর্কাইভ)।
২০২১ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন পোস্ট (আর্কাইভ),  পোস্ট (আর্কাইভ)।
২০২২ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন পোস্ট (আর্কাইভ),  পোস্ট (আর্কাইভ)।
২০২৩ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন পোস্ট (আর্কাইভ),  পোস্ট (আর্কাইভ)।

 এবিষয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন ডেইলি বাংলাদেশ, আজকালের খবর

ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন নিউজ১৮। 

ফ্যাক্টচেক 

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, হাট্টিমাটিম টিম ছড়াটি ৫২ লাইনের নয় এবং এটি রোকনুজ্জামান খানেরও লেখা নয় বরং মূল ছড়াটি ৪ লাইনেরই এবং এই ছড়ার সাথে রোকনুজ্জামান খানের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। 

‘হাট্টিমাটিম ছড়াটি ৫২ লাইন’ দাবির উস অনুসন্ধান

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অন্তত ২০১৬ সাল থেকে প্রচার হয়ে আসছে যে, ‘হাট্টিমাটিম টিম’ ছড়াটির শুধু শেষদিকের ৪ লাইনই পড়ানো হতো। তবে সে সময় দাবি করা হয় যে, ছড়াটি ৫২ নয়, ৫৬ লাইনের একটি ছড়া।

২০১৬ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন একটি পোস্ট দেখুন পোস্ট (আর্কাইভ)।

Screenshot: Facebook Claim Post

তবে পরবর্তীতে ২০১৭ সাল থেকে দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ছড়াটি ৫২ লাইন দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে এবং পূর্বের ছড়াটি থেকে শেষ ৪ লাইন অর্থাৎ ‘তাদের বাড়ি ব্যাঙ এর বাসা/কোলা ব্যাঙ এর ছা/খায় দায় গান গায়/তাই রে নাই রে না।’ অংশটুকু বাদ দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। 

পরবর্তীতে কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে ব্লগিং ওয়েবসাইট somewhereinblog এ ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ ‘একটি হাট্টিমাটিম ছড়া এবং তারপর….’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ব্লগ খুঁজে পাওয়া যায়। 

এই ব্লগটিতে নাদিয়া জামান নামে একজন ব্লগার লিখেন, “সপ্তা খানিক আগে হঠাত ফেইসবুকে বেশ কিছু ম্যাসেজ পেলাম, বিষয় ছিল হাট্টিমাটিম ছড়াটির প্রথম ৪৮ লাইন! অনলাইনে সার্চ দিয়ে দেখলাম, সে কি কান্ড, হাট্টিমাটিম পুরো ছড়া আবিস্কার করে রীতিমত সাড়া জাগিয়ে ফেলেছেন অনেকেই! 

ফেইসবুকে অসংখ্য পেইজ পেলাম যেখানে আলোচিত শিরোনাম ” এত বছর পর্যন্ত জানতাম এই ‘হাট্টিমাটিম টিম’ ছড়াটা ৪ লাইন। আসলে এটা রোকনুজ্জামান খানের ৫২ লাইনের অসম্ভব সুন্দর একটি ছড়া।” এই টপিকে সকলের শেয়ার, কমেন্ট আর আলোচনার বন্যা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। এতো সুন্দর একটা ছড়ার সম্পর্কে এই ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি দেখে তা দূর করার জন্য কিছু একটা না লিখলেই যে নয়। দাদাভাই (রোকনুজ্জামান খান) এর লেখা ৪ লাইনের চমৎকার শিশুতোষ ছড়া হাট্টিমাটিম টিম। ২০১২ সালের দিকে লিখেছিলাম প্রথম দিকের লাইনগুলো। দাদা ভাইয়ের লেখা চারটি লাইন ছোটবেলায় পড়েন নাই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, আর তাই যখন আমি এই ছড়াটির প্রথম দিকের লাইন লিখেছি তখন রেফারেন্সিং এর প্রয়োজন ও বোধ করি নি।

Screenshot: somewhereinblog

বিভিন্ন অনলাইন ব্লগ আর ফোরামে এক্টিভ থাকার কারনে ছড়াটি সে সময় পোস্ট ও করেছিলাম আর চমৎকার সব রেসপন্স ও পেয়েছিলাম। কিন্তু এই ছড়া নিয়ে যে এতো বিভ্রান্তির শুরু হতে পারে তা ঘুণাক্ষরে ও মনে আসেনি। ছড়াটি নিয়ে এই ভুল তথ্য যেভাবে হাওয়ার বেগে ছড়িয়েছে, আমি আশা করবো সঠিক তথ্যটিও এভাবে ছড়াক। “

নাদিয়া জামানের এই ব্লগে প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হাট্টিমাটিম ছড়াটির প্রথম ৪৮ লাইন অর্থাৎ ‘হাট্টিমাটিম টিম/ তারা মাঠে পারে ডিম/ তাদের খাড়া দুটো শিং/তারা হাট্টিমাটিম টিম।’ অংশটুকু ছাড়া বাকি অংশটুকু তার লেখা।

তার এই দাবির পক্ষে সত্যতা যাচাইয়ে অধিকতর অনুসন্ধানে একই ব্লগ সাইটে ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ‘হাট্টিমাটিম গল্প’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ছড়া খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: somewhereinblog

ব্লগে প্রকাশিত এই ছড়াটির সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ছড়াটির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। 

পাশাপাশি ব্লগটির মন্তব্যবক্সে বিভিন্ন জনের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে নাদিয়া জামান লিখেন, হাট্টিমাটিম ছড়াটির ‘হাট্টিমাটিম টিম/ তারা মাঠে পারে ডিম/ তাদের খাড়া দুটো শিং/তারা হাট্টিমাটিম টিম।’ এই চার লাইন ব্যতীত বাকি লাইনগুলো তারই লেখা। 

Image collage: Rumor Scanner

এই পর্যন্ত অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয় যে, হাট্টিমাটিম ছড়াটির ৪ লাইনের সঙ্গে অতিরিক্ত যে ৪৮ লাইন প্রচার করা হচ্ছে সেটি এই ছড়াটির মূল অংশ নয় বরং এটি নাদিয়া জামান নামে একজন ব্লগারের লেখা। তবে নাদিয়া জামান দাবি করেন, হাট্টিমাটিম ছড়াটির মূল চার লাইন রোকনুজ্জামান খান থেকে নেওয়া। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টগুলোতেও দাবি করা হচ্ছে ছড়াটি রোকনুজ্জামান খানের লেখা। 

রিউমর স্ক্যানার টিম এই পর্যায়ে হাট্টিমাটিম ছড়াটির সঙ্গে রোকনুজ্জামান খানের সম্পর্ক নিয়ে অনুসন্ধান করে। 

হাট্টিমাটিম ও  রোকনুজ্জামান খানের সম্পর্ক

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে বাংলা একাডেমি থেকে ২০০১ সালে প্রকাশিত খালেক বিন জয়েনউদদীনের লেখা ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই (১৯২৫-১৯৯৯)’ শীর্ষক একটি জীবনী গ্রন্থ খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম। বইটির ৫৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত তথ্য থেকে জানা যায়, রোকনুজ্জামান খানের একটি বইয়ের নাম ‘হাটটিমা টিম।’ যেটি তার প্রকাশিত তৃতীয় ও প্রথম ছড়াগ্রন্থ। এটি ১৯৬২ সালে ঢাকার কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং এটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে ঢাকার ব্র্যাক থেকে। বইটির প্রচ্ছদপট ও বহুরঙা অঙ্গসজ্জা করেন শিল্পী হাশেম খান।

Image captured from book

পরবর্তীতে একই বইয়ের যথাক্রমে ১৪৭ ও ১৫২ নাম্বার পৃষ্ঠায় রোকনুজ্জামান খানের হাট টিমা টিম বইয়ের প্রচ্ছদ ও তার লেখা ২২ লাইনের ‘হাট টিমা টিম’ ছড়াটি খুঁজে পাওয়া যায়। এই ছড়াটির কোথাও ‘হাট্টিমাটিম টিম/ তারা মাঠে পারে ডিম/ তাদের খাড়া দুটো শিং/তারা হাট্টিমাটিম টিম।’ এই চার লাইন খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

Image Collage: Rumor Scanner 

অর্থাৎ ‘হাট্টিমাটিম টিম/ তারা মাঠে পারে ডিম/ তাদের খাড়া দুটো শিং/তারা হাট্টিমাটিম টিম।’ এই চার লাইন রোকনুজ্জামান খানের লেখা নয়। এছাড়া পূর্বেই প্রমাণিত হয়েছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ছড়াটি রোকনুজ্জামান খানের লেখা দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে সেটি নাদিয়া জামান নামে একজন ব্লগারের লেখা। 

হাট্টিমাটিম টিম’ মূল ছড়াটি সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে

এ নিয়ে অনুসন্ধানে বইয়ের পাঠশালা নামক একটি ওয়েবসাইটে ‘হাট্টিমাটিম টিম ছড়াটির লেখক কে? সম্পূর্ণ কবিতার আসল রচয়িতা কে?’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ব্লগ খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: Boier Pathshala

এই ব্লগটির সূত্রে ‘খুকুমনির ছড়া’ নামের একটি বইয়ের ৩৭ নাম্বার পৃষ্ঠায় চার লাইনের ‘হাট্টিমাটিম টিম’ ছড়াটিখুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Khuku Monir Chora book 

খুকুমনির ছড়া বইটির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই বইটি বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দ ,ইংরেজি ১৮৯৯ সালে কলকাতার ৬৪ নং কলেজ স্ট্রীটের সিটি বুক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত। এই বইটি সংকলন করেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার।

Screenshot: Khuku Monir Chora book 

প্রসঙ্গত, বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত রোকনুজ্জামান খানের জীবনী গ্রন্থমালা থেকে জানা যায়, রোকনুজ্জামান খানের জন্ম ১৯২৫ সালে, রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলায়। অর্থাৎ তাঁর জন্মের আগে থেকেই হাট্টিমাটিম টিম ছড়াটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।

Image captured from book

উল্লেখ্য, চার লাইনের মূল ‘হাট্টিমা টিম’ ছড়াটি কার লেখা তা নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান। কারো কারো মতে, এটি সুকুমার রায়ের লেখা, আবার কারো মতে অন্নদা শঙ্কর রায়ের লেখা। তবে মূল লেখক নিয়ে বিতর্ক থাকলে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এটি রোকনুজ্জামান খানের লেখা নয় এবং মূল ছড়াটিও ৫২ নয় মাত্র ৪ লাইনের। 

মূলত, দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে যে, ‘হাট্টিমাটিম টিম’ ছড়াটি  ৪ লাইনের নয়, এটি রোকনুজ্জামান খানের ৫২ লাইনের একটি ছড়া। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ‘হাট্টিমাটিম টিম/ তারা মাঠে পারে ডিম/ তাদের খাড়া দুটো শিং/তারা হাট্টিমাটিম টিম।’ ছড়াটি এই চার লাইনেরই। ছড়াটি ৫২ লাইন দাবিতে অতিরিক্ত যে ৪৮ লাইন প্রচার করা হচ্ছে, সেটি মূলত নাদিয়া জামান নামে একজন ব্লগারের লেখা। যিনি ২০১২ সালে এটি লিখেছিলেন এবং ছড়াটির সঙ্গে শিশু সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের লেখা ২২ লাইনের ‘হাট টিমা টিম’ ছড়াটির কোনো মিল নেই। পাশাপাশি ‘হাট্টিমাটিম টিম’ চার লাইনের ছড়াটিও রোকনুজ্জামান খানের লেখা নয় বরং তাঁর জন্মের আগে থেকেই ছড়াটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।

সুতরাং, হাট্টিমাটিম টিম ছড়াটি ৫২ লাইন ও এটি রোকনুজ্জামানের লেখা দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img