ছবিটি হাসন রাজার মুখাবয়বের বর্ণনা থেকে আঁকা

বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে হাসন রাজা’কে নিয়ে লেখা কিংবা আলোচনামূলক পোস্টে এবং হাসন রাজা সম্পর্কিত দেশীয় গণমাধ্যমর বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং দেশ-বিদেশ থেকে পরিচালিত বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে হাসন রাজার একটি স্কেচ (প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে হাসন রাজা’র মুখাবয়বের বর্ণনা শুনে আঁকা কল্পিত একটি ছবি ) “স্কেচ” বা “আঁকা ছবি” উল্লেখ না করেই প্রচার হয়ে আসছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে হাসন রাজার স্কেচ ছবিকে স্কেচ/ প্রতিকৃতি উল্লেখ না করেই প্রকাশ

“স্কেচ ছবি” উল্লেখ না করেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সময় টেলিভিশন, আরটিভি, একুশে টেলিভিশন, নিউজ২৪ টেলিভিশন, সংগ্রাম, কালের কণ্ঠ, যুগান্তর, সমকাল, নিউজবাংলা২৪, রাইজিংবিডি, ডেইলি-বাংলাদেশ, সারাবাংলা, দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, ডেইলি সান, জাগোনিউজ, নিউ-নেশন, ডেইলি স্টার, ঢাকাপোস্ট, ডেইলি এশিয়ান এজ, বার্তা২৪, বাংলাদেশ জার্নাল, ঢাকাটাইমস, প্রথম আলো (প্রথম আলো এর সিলেটের ব্যুরো প্রধান উজ্জল মেহেদির কলাম)।

ছবিঃ বাংলাদেশ প্রতিদিনের ই-পেপার থেকে (৩১ অক্টবর ২০২১)
বাংলাদেশ প্রতিদিন ছাপা পত্রিকায়

আইএমডিবি, উইকিপিডিয়া বাংলা (পরবর্তীতে সংশোধন করেছে), রোর বাংলা, বাংলাপিডিয়া, hasanraja.com, alamy.com, প্রভাতফেরি (১), প্রভাতফেরি (২), প্রভাতফেরি (৩)।

(আলোচিত বহুল প্রচারিত ছবি)

যেভাবে বিভ্রান্তি

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে হাসন রাজা’কে নিয়ে লেখা কিংবা আলোচনামূলক পোস্টে এবং হাসন রাজা সম্পর্কিত দেশীয় গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে; প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে হাসন রাজা’র মুখাবয়বের বর্ণনা শুনে আঁকা কল্পিত ছবি, “স্কেচ”, “আঁকা ছবি” কিংবা প্রতিকৃতি শব্দ উল্লেখ না করে ছবিটি ব্যবহার করলে সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এবং পাঠকেরা ভাবতে পারেন ছবিটি হাসান রাজার নিজের জীবদ্দশায় তোলা।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রচারিত ছবিটি হাসন রাজা’র জীবদ্দশায় তোলা ছবি নয় বরং আলোচিত ছবিটি প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে হাসন রাজা’র মুখাবয়বের বর্ণনা শুনে আঁকা কল্পিত একটি ছবি, যাকে স্কেচও বলা হয়।”

কি-ওয়ার্ড সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে, দেশীয় গণমাধ্যম “প্রথম আলো”তে ০৭ ডিসেম্বর ২০২২ “তাহলে এটা হাসন রাজার ছবি নয়?” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “আলোচিত ছবিটি প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনে আঁকা কল্পিত একটি ছবি।”

পাশাপাশি, প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেলে “হাসন রাজার অন্তরালে” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিও প্রতিবেদনে হাসন রাজার প্রপৌত্র, গবেষক ও লেখক ‘সামারীন দেওয়ান’ বলেন, “বহুল প্রচারিত (আলোচিত) ছবিটি হাসন রাজার নয়, এটি আঁকা ছবি। হাসন রাজার একটি মাত্র তোলা ছবি রয়েছে”।

ছবিঃ প্রভাতফেরি ডট কম ডট এইউ

ছবিঃ “Hason Raja Jiban O Karma হাসন রাজা জীবন ও কর্ম” ফেসবুক পেজ থেকে।

এছাড়াও, হাসন রাজার প্রপৌত্র ও গবেষক “সামারীন দেওয়ান” এর সাথে কথা হলে তিনি রিউমর স্ক্যানার’কেও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যে, “ভুল প্রচারিত (আলোচিত) ছবিটি হাসন রাজার জীবদ্দশায় তোলা কোনো ছবি নয় বরং এটি একটি আঁকা ছবি”।  

তাহলে আলোচিত বহুল প্রচারিত ছবিটির উৎস কী

প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, “হাসন রাজার প্রপৌত্র ও গবেষক সামারীন দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেছেন, ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হাসন রাজা’ সিনেমায় ব্যবহারের জন্য ছবিটি আঁকিয়ে নিয়েছিলেন তাছাওয়ার রাজা। সম্পর্কে তিনিও হাসন রাজার প্রপৌত্র এবং সিনেমাটির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। হাসন রাজার জীবনী অবলম্বনে ছবিটি নির্মাণ করেন প্রয়াত পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। নামভূমিকায় অভিনয় করেন হেলাল খান, সিনেমার প্রযোজকও তিনি।

ছবিঃ ডেইলি স্টার। হাসন রাজার প্রপৌত্র দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন।

হেলাল খান জানান, সে সময় (সিনেমা নির্মানের) তিনবার হাসন রাজার জন্মস্থানে গিয়েছিলেন তাঁরা, এক শতবর্ষী নারীসহ বেশ কয়েকজন প্রবীণের কাছে হাসন রাজার চেহারার বর্ণনা শুনেছিলেন। শুনে শুনে হাসন রাজার একটি কল্পিত মুখাবয়ব পেয়েছিলেন তাঁরা। সেই কল্পনা থেকেই হাসন রাজার আলোচিত এই ছবিটিসহ তরুণ বয়সের কয়েকটি ছবি আঁকা হয়েছিল।

গবেষক সামারীন বলেন, সিনেমাটি মুক্তির পর সবার নজরে আসে সেই ছবি। ফলে দ্রুততম সময়ে বই, পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছবিটি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অনেকে ভাবেন, এটিই বোধ হয় হাসন রাজার আসল চেহারা। তবে এ ছবির সঙ্গে হাসন রাজার মূল চেহারার কোনো মিল নেই। অথচ গত দুই দশকে সেই ছবিকে অনুসরণ করে ভূরি ভূরি ছবি আঁকা হয়েছে। এক ছবি থেকে আরেক ছবিতে গিয়ে হাসন রাজার চেহারাও বদলে গেছে।”

কল্পনার আশ্রয়ে আঁকা এসব ছবিকে স্বাভাবিকভাবেই হাসন রাজার ছবি বলতে নারাজ তার উত্তরসূরীরা।

ছবিঃ Dewan Hason Raja নামক ফেসবুক পেজ থেকে

আসল ও জীবদ্দশায় তোলা একমাত্র ছবি

প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, “১৯১৪ সালের নভেম্বরে কলকাতার একটি স্টুডিওতে ছবিটি তোলা হয়েছিল, জানান সামারীন। কলকাতায় নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল হাসন রাজার। সেবারই শেষবারের মতো কলকাতায় গিয়েছিলেন তিনি। সামারীন বলেন, ছবিটি তুলে বেশ কয়েকটা কপি এনে বাড়িতে গানের আসরের সঙ্গী, প্রতিবেশী ও নিজের বংশধরদের কাছে বিলি করেছিলেন। বংশপরম্পরায় দাদা থেকে বাবা, বাবা থেকে নিজের হাতে ছবিটি পেয়েছেন বলে জানান সামারীন। তাঁর ভাষ্য, ছবিটি সংরক্ষণ করা না গেলে হাসন রাজার চেহারা-স্মৃতি বিলীন হয়ে যেত। ফলে ছবিটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

ছবিটি সংরক্ষণের জন্য ২০১৮ সালে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে মেধাস্বত্ব পেতে আবেদন করেন হাসন রাজার উত্তরাধিকারীরা। যাচাই-বাছাইয়ের পর তাঁদের সেই ছবির মেধাস্বত্ব সনদ দেওয়া হয়েছে বলে জানান সামারীন। এর আগে ২০১৫ সালে ঢাকার মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত গবেষক সামারীন দেওয়ানের হাসন রাজা: জীবন ও কর্ম গ্রন্থেও মূল ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছে। ২০০৬ সালে সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পারে হাসন রাজা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর ২০০৮ সাল থেকে ছবিটি দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শিত হচ্ছে।”

ছবিঃ প্রথম আলো

আসল ছবিটি ব্যতীত ইন্টারনেটে মোট কত ধরণের আঁকা ছবি বা প্রতিকৃতি পাওয়া যায়

শিল্পীর তুলিতে হাসন রাজা। ছবিঃ hasonraja.com সাইট থেকে
ছবিঃ হাসন রাজার প্রপৌত্র সামারীন দেওয়ান এর হোয়াটস এপ বার্তা

সামারীন দেওয়ান জানান, “মূল ছবিটির অনুকরণে ১৯৭৫ সালের হাসন রাজা উৎসবের ইভেন্টে এই ছবিটি এঁকেছিলেন  শিল্পী সুনীল শুক্লা”।

ছবিঃ সাহিত্যকথা সাইট থেকে
শিল্পীর তুলিতে অঙ্কিত হাসন রাজার একটি চিত্রকর্ম। ছবিঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন
ছবিঃ musicgoln.com
ছবিঃ musicgoln.com
হাছন রাজা, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল । ছবিঃ musicgoln.com

মূলত,  হাসন রাজার জীবনী অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হাসন রাজা’ সিনেমায় ব্যবহারের জন্য ছবিটি আঁকিয়ে নিয়েছিলেন হাসন রাজার প্রপৌত্র এবং সিনেমাটির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক তাছাওয়ার রাজা। প্রযোজক ও সিনেমাটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয়কারী হেলাল খান জানান, “সিনেমাটি নির্মাণের সময়ে এক শতবর্ষী নারীসহ বেশ কয়েকজন প্রবীণের কাছে হাসন রাজার চেহারার বর্ণনা শুনে শুনে একটি কল্পিত মুখাবয়ব থেকেই এই ছবিটিসহ হাসন রাজার তরুণ বয়সের কয়েকটি ছবি আঁকা হয়েছিল।” পরবর্তীতে, সিনেমাটি মুক্তির পর সবার নজরে আসে সেই ছবি। ফলে দ্রুততম সময়ে বই, পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছবিটি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অনেকে ভাবেন, এটিই বোধ হয় হাসন রাজার আসল চেহারা। এমনকি কল্পনার আশ্রয়ে আঁকা এসব (আলোচিত) ছবিকে স্বাভাবিকভাবেই হাসন রাজার ছবি বলতে নারাজ তার উত্তরসূরীরা।

উল্লেখ্য, হাসন রাজার প্রপৌত্র ও হাসন রাজা সম্পর্কিত গবেষক, সামারীন দেওয়ান এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী “ জন্মের একদম পরপরই হাসন রাজার নাম রাখা হয়েছিলো “অহিদুর রাজা”। তার মায়ের পছন্দ হয়নি বলে জন্মের মাস তিনেকের মাঝে “অহিদুর” নাম বাদ দিয়ে ‘হাসন’ রাজা রাখা হয়”। হাসন রাজা ১৮৫৪ সালে তৎকালীন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জের লক্ষ্মণশ্রী পরগনার তেঘরিয়া গ্রামে জন্ম নেন। ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন

প্রসঙ্গত, গণমাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে প্রচারিত নানাবিধ তথ্য ও সংবাদ নিয়ে ইতোপূর্বে বেশ কয়েকটি ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।

সুতরাং, হাসন রাজা সম্পর্কিত লেখা কিংবা প্রতিবেদনে; আলোচিত ছবিটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কল্পিত ছবি, “স্কেচ”, “আঁকা ছবি” কিংবা প্রতিকৃতি শব্দ উল্লেখ না করে ছবিটি ব্যবহার করা; সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img