সম্প্রতি “ভোলার দৌলতখানে দেড় লাখ টাকার বিনিময় মুসলিম মেয়েকে হিন্দু পরিবারের হাতে তুলে দিলেন এলাকার কিছু নেতারা।” শীর্ষক শিরোনামে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়,ভোলার দৌলতখানে দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে মুসলিম মেয়েকে হিন্দু পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় বরং মেয়েটি অপ্রাপ্তবয়স্ক ও হিন্দু ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত ছিল এবং তার অভিভাবকের একটি মামলার প্রেক্ষিতে স্থানীয়রা তাকে তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার সময় এই ভিডিওটি ধারণ করা হয়।
গুজবের সূত্রপাত
ভোলার দৌলতখানে দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে মুসলিম মেয়েকে হিন্দু পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির সত্যতা অনুসন্ধানে ২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল “নব-মুসলিম এই বোনটির আত্ম চিৎকার তুমি কি শোনতে পাও হে প্রভু? (আর্কাইভ)” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত মূল ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডিওটির শিরোনাম থেকে জানা যায়, ভিডিওটিতে থাকা মেয়েটি গাজীপুরের হিন্দু পরিবারের। সে ভোলার একজন মুসলিম ছেলেকে সরকারি সকল নিয়মনীতি ও মুসলিম সুন্নাহ মেনে কোর্ট রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় মুসলিম হয়ে বিয়ে করে। অথচ সব নিয়মনীতি ভেঙে জোর করে মেয়েটিকে তার পরিবার নিয়ে যেতে চাইলে এভাবেই মেয়েটির আত্মচিৎকারে কেঁপে ওঠে আকাশ বাতাস।
অর্থাৎ যে মেয়েটিকে ঘিরে এই ভিডিও, গাজীপুরের সে মেয়েটি হিন্দু ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে ভোলার একজন মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করে। তবে পরবর্তীতে মেয়েটিকে তার পরিবার নিয়ে যেতে আসলে এই ঘটনার সূত্রপাত হয়।
পরবর্তীতে মূলধারার অনলাইন পোর্টাল abnews24.com এ ২০২১ সালের ২৭ এপ্রিল “দৌলতখানে নও-মুসলিম মেয়েকে স্বামীর বাড়ী থেকে জোরপূর্বক তুলে নেয়ার অভিযোগ(ভিডিও)” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ভোলার দৌলতখান উপজেলার মৃর্ধারহাটের মো. কামরুল নামের এক যুবক ঢাকার গাজীপুরে চাকরি করার সময় ঐশী নামের হিন্দু মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরবর্তীতে বিষয়টি মেয়ের পরিবার জানলে মেয়েটি ভোলায় প্রেমিক কামরুলের কাছে চলে আসে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বিয়ে করে। তার নতুন নাম দেয়া হয় জান্নাতুল ফেরদৌস। তবে ঘটনায় ঐশীর বাবা শংকর চন্দ্র কামরুলের নামে অপহরণ মামলা করে।
প্রতিবেদনটিতে মেয়েটির স্বামী কামরুলের ভাই নুরুজ্জামানকে উদ্ধৃত করে আরও বলা হয়, দৌলতখানের স্থানীয় প্রভাবশালী কামাল তুফানি নামে একলোক ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে ঐশীকে জোর করে তার বাবার হাতে তুলে দিয়েছে।
পাশাপাশি প্রতিবেদনটিতে দৌলতখান থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা (ওসি) বজলার রহমানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, গাজীপুরের একটি মামলায় পুলিশ মেয়েটিকে উদ্ধার করতে সাহায্য করে। মেয়েটি অপ্রাপ্ত বয়স্ক। আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এছাড়া প্রতিবেদনটিতে স্থানীয় কয়েকজনের বিরুদ্ধে মেয়েটিকে তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে দেড় লক্ষ টাকা নেওয়ার একটি অভিযোগের বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে।
ঘটনাটি নিয়ে দৌলতখানের জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকরা কি বলছে?
সম্প্রতি ২০২১ সালের এই ঘটনাটি পুনরায় ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে এটির সত্যতা যাচাইয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম দৌলতখান উপজেলা চেয়ারম্যান, দৌলতখান প্রেসক্লাবের সভাপতি ও স্থানীয় গণমাধ্যম ভোলা প্রতিদিন.কমের সংবাদকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করে।
এ প্রসঙ্গে দৌলতখান উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মনজুরুল আলম খান রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, এটা গত বছরের ঘটনা। এটা নিয়ে তখন মিটিং-বৈঠক হয়েছিল। একটা হিন্দু ঘরের মেয়ে মুসলমান হয়ে মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করে। কিন্তু মেয়েটা অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়৷ পরবর্তীতে বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় গড়ায় এবং প্রশাসনের হস্তক্ষেপে মীমাংসা হয়।
একই বিষয়ে দৌলতখান প্রেস ক্লাবের সভাপতি মো: মনিরুজ্জামান (মহীন) বলেন, এটা মিটমাট হয়ে গিয়েছে। দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে তুলে দেওয়ার যে দাবি, আসলে এটা এরকম না। মেয়েটার বাড়ি ছিল ঢাকার গাজীপুরে। সে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। মেয়েটা একটা মুসলিম ছেলের সাথে সম্পর্ক করে চলে এসে মুসলিম হয়ে ছেলেটাকে বিয়ে করে। তবে মেয়েটার অভিভাবক মামলা করলে পুলিশ এখানে তাকে শনাক্ত করে। পরবর্তীতে ছেলেটাকে বাঁচাতে স্থানীয়রা মেয়েটাকে তার অভিভাবকের হাতে তুলে দেয়। এটাকে তখন এভাবে প্রচার করা হয়েছিল যে, দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে হিন্দুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আসলে মেয়েটাকে তার অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
তিনি আরও জানান, পরবর্তীতে মেয়েটা এক মাসের মাথায় আবার এখানে চলে আসে এবং এখন পর্যন্ত এখানেই আছে। মেয়ের অভিভাবক আর নিতে আসেনি।
এছাড়া ভোলার স্থানীয় গণমাধ্যম ভোলা প্রতিদিন.কমের সংবাদকর্মী শাখাওয়াত শাকিল রিউমর স্ক্যানারকে জানান, এটা তো পুরানো ঘটনা। এখন কারা নতুন করে আবার ছড়াচ্ছে বলতে পারলাম না৷ তবে আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মেয়েটা তার পরিবারের সাথেই আছে।
তবে মেয়েটির সবশেষ অবস্থান সম্পর্কে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে নিশ্চিত কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মূলত, ২০২১ সালের এপ্রিলে ভোলার দৌলতখান উপজেলার মৃর্ধারহাটের মো. কামরুল নামের এক যুবকের সঙ্গে গাজীপুরের ঐশী নামের এক হিন্দু মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরবর্তীতে মেয়েটি বাড়ি থেকে চলে এসে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম ছেলেটিকে বিয়ে করে। তবে এ সময় মেয়েটি অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিল। পরবর্তীতে এ ঘটনায় ঐশীর বাবা শংকর চন্দ্র কামরুলের নামে অপহরণ মামলা করে। এই মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশ তাকে উদ্ধার করতে গেলে স্থানীয়রা মেয়েটিকে তার অভিভাবকের হাতে তুলে দেয়। ২০২১ সালের এই ঘটনাটিকেই দেড় লাখ টাকার বিনিময় মুসলিম মেয়েকে হিন্দু পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সম্প্রতি নতুন করে প্রচার করা হচ্ছে।
সুতরাং, হিন্দু পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- abnews24.com: দৌলতখানে নও-মুসলিম মেয়েকে স্বামীর বাড়ী থেকে জোরপূর্বক তুলে নেয়ার অভিযোগ(ভিডিও)
- Conversation with UP Chairman of Daulatkhan Upazila Parishad
- Conversation with Daulatkhan Press Club President
- Conversation with Local Media Journalist