সম্প্রতি, ‘ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ার পরেও এমন হাঁসি মুখে থাকা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই সেই হামজা বেনদেলাজ, যিনি ২১৭ টি ব্যাংক থেকে ৪০ কোটি ডলার হ্যাক করেন এবং আফ্রিকা ও ফিলিস্তিনে অনাহারে অর্ধাহারে মরে যাওয়ার উপক্রম মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দেন।আদালতে তাঁর ফাঁসির রায় হলে অবশেষে হাসি মুখে ফাঁসিতে ঝুলে পড়েন।” শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য ও দুইটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, হামজা বেনদেলাজের নামে প্রচারিত তথ্যটি সত্য নয় এবং উক্ত তথ্যের সাথে সংযুক্ত দুইটি ছবির একটি হামজা বেনদেলাজের হলেও ফাঁসির ছবিটি ভিন্ন একজন ব্যক্তির।
তথ্য যাচাই
হামজা বেনদেলাজ কি ব্যাংক থেকে টাকা হ্যাক করে আফ্রিকা ও ফিলিস্তিনের দুঃস্থ মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলেন?
প্রচারিত পোস্টগুলোতে হামজা বেনদেলাজের ডলার হ্যাক করে আফ্রিকা ও ফিলিস্তিনে অনাহারে ও অর্ধাহারে মরে যাওয়ার উপক্রম মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। তবে উল্লিখিত দাবিটি সত্য নয়।
“বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য মার্কিন ব্যাংক থেকে মিলিয়ন ডলার চুরি করার সন্দেহে এফবিআই কর্তৃক অভিযুক্ত আলজেরিয়ান কম্পিউটার হ্যাকার হামজা বেনদেলাজকে ব্যাংককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
থাই পুলিশ হামজা বেনদেলাজকে যখন জিজ্ঞাসা করেছিল যে তিনি এই অর্থ দিয়ে কী করেছেন, তখন হামজা বেনদেলাজ বলেছেন যে তিনি এই অর্থ ভ্রমণ এবং বিলাসবহুল জীবনের জন্য ব্যয় করেছেন, যেমন ফার্স্ট ক্লাস ফ্লাইটে ভ্রমণ, বিলাসবহুল জায়গায় থাকা ইত্যাদি।”
Screenshot from BBC News
থাইল্যান্ডের গণমাধ্যম Bangkok Post সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও তার গ্রেফতার এর বিষয়টি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে একই তথ্য পাওয়া যায়।
অর্থাৎ, হামজা বেনদেলাজ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে আফ্রিকা ও ফিলিস্তিনে অনাহারে ও অর্ধাহারে মরে যাওয়ার উপক্রম মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দেন নি বরং সেই টাকা তিনি বিলাসী জীবনযাপনের জন্য ব্যয় করেছেন।
হামজা বেনদেলাজের কি ফাঁসি হয়েছে?
প্রচারিত পোস্টগুলোতে আরো উল্লেখ করা হয়, আদালতে তাঁর ফাঁসির রায় হলে অবশেষে হাসি মুখে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে পড়েন। তবে এই দাবিটিও মিথ্যা। মূলত, হ্যাকিংয়ের দায়ে হামজা বেনদেলাজ এর ফাঁসি হয়নি, তার ১৫ বছরের জেল হয়েছিলো।
কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘Al Jazeera’ এর অনলাইন সংস্করণে “Hacker Hamza Bendelladj sentenced to 15 years“ ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়,
“আলজেরিয়ান হ্যাকার এবং ক্ষতিকর স্পাইআই ম্যালওয়ারের বিকাশকারী হামজা বেনদেলাজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার একটি আদালতে ১৫ বছরের জেল দেয়া হয়েছে।”
Screenshot from Al Jazeera website
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘FBI‘ এর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটেও হামজা বেনদেলাজের ১৫ বছরের জেল হওয়া সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
অর্থাৎ, হামজা বেনদেলাজের ফাঁসি হওয়া এবং ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ানোর পরও এমন হাঁসি মুখে থাকা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল শীর্ষক দাবিটিও মিথ্যা।
ছবি যাচাই
প্রচারিত দুইটি ছবির মধ্যে হাতকড়া পড়ানো অবস্থায় হাসি মুখের ছবিটি হামজা বেনদেলাজের হলেও গলায় ফাঁসির দড়ি লাগানো থাকা হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তিটি হামজা বেনদেলাজ নয় বরং এটি ইরানের নাগরিক মাজিদ কাভুসিফার এর ছবি, যাকে বিচারককে খুনের অপরাধে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হয়।
রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘বিবিসি নিউজ’এ “Tehran killers hanged in public” শিরোনামে ২০০৭ সালের ২ আগস্ট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে একই ব্যক্তির গলায় ফাঁসির দড়ি লাগানো ভিন্ন একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়-
“একজন বিশিষ্ট বিচারককে হত্যার দায়ে তেহরানের একটি চত্বরে দুইজন ব্যাক্তিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, যা ২০০২ সালের পর ইরানের রাজধানীতে প্রথম প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড বলে মনে করা হয়। দেশের অন্যান্য অংশে নয়টি জনসমক্ষে ফাঁসি দেওয়ার একদিন পর মজিদ কাভুসিফার ও হোসেন কাভৌসিফার প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হয়।”
Screenshot from BBC News
একই তারিখে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘রয়টার্স’ এ ‘Iran hangs judge’s killers in public’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনও বিচারক হত্যার দায়ে মজিদ কাভুসিফারকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
Screenshot from Reuters website
অর্থাৎ, বিচারক হত্যার দায়ে প্রকাশ্যে ফাঁসি কার্যকর হওয়া এক ব্যক্তির হাসিমুখের একটি ছবি হামজা বেনদেলাজ দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘Al Jazeera’ এ ২০১৫ সালে “Hamza Bendelladj: Is the Algerian hacker a hero?“ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে হামজা বেনদেলাজকে হিরো বানানোর এই প্রচার নিয়ে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে বিষয়টির বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বদৌলতে এই গুজবটি বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত বিভিন্ন দেশে প্রচারিত হয়ে আসছে।
সুতরাং, হামজা বেনদেলাজ এর নামে ভিন্ন ব্যক্তির ছবি প্রচার করা হচ্ছে, এছাড়া ব্যাংক থেকে ডলার হ্যাকিং করে সেই অর্থ আফ্রিকা ও ফিলিস্তিনে দান এবং তার ফাঁসি হয়েছে শীর্ষক দাবিগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।
[su_box title=”True or False” box_color=”#f30404″ radius=”0″]
Claim Review: ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ার পরেও এমন হাঁসি মুখে থাকা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই সেই হামজা বেনদেলাজ, যিনি ২১৭ টি ব্যাংক থেকে ৪০ কোটি ডলার হ্যাক করেন এবং আফ্রিকা ও ফিলিস্তিনে অনাহারে অর্ধাহারে মরে যাওয়ার উপক্রম মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দেন।আদালতে তাঁর ফাঁসির রায় হলে অবশেষে হাসি মুখে ফাঁসিতে ঝুলে পড়েন