চার কিডনি অনুদান বিষয়ক ভাইরাল বার্তাটি ভুয়া 

সম্প্রতি, চার কিডনি অনুদান দেওয়া হচ্ছে দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

দাবিকৃত বার্তাটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

“Dear all
Important, 4 Kidneys Available.        

Due to Death of   Mr Sudhir And His Wife Who Met With an Accident Yesterday, Doctor Has Declared Them Brain Dead. Mr.Sudhir is B+ and His Wife O+. His Family Wants to Donate Their Kidneys for Humanity .Plz Circulate.                                  

 Contact 9837285283
9581544124
8977775312

Forward to Another Group,  It Could Help Someone…”

অনূদিত-
“প্রিয়জনেরা,
গুরুত্বপূর্ণ খবর: ৪টি কিডনি পাওয়া যাবে।

গতকাল একটি দুর্ঘটনায় মি. সুধীর এবং তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন, যার ফলে চিকিৎসক তাদের মস্তিষ্ক মৃত বলে ঘোষণা করেছেন। মি. সুধীরের রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ এবং তাঁর স্ত্রীর ও পজিটিভ। তাদের পরিবার মানবতার স্বার্থে তাদের কিডনি দান করতে ইচ্ছুক। অনুগ্রহ করে এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিন।

যোগাযোগ:
9837285283
9581544124
8977775312

এই বার্তাটি অন্যান্য গ্রুপে ফরওয়ার্ড করুন, এর মাধ্যমে অন্যরা সাহায্য পেতে পারে…”

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, চার কিডনি অনুদানের ভাইরাল বার্তাটি সত্য নয় বরং অন্তত ২০১৭ সাল থেকেই ভারতের এক কিডনি বিশেষজ্ঞ সহ আরো দুই অপরিচিত ব্যক্তির মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে চার কিডনি দান বিষয়ক একটি বার্তা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রচার হয়ে আসছে। তাছাড়া বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বার্তায় উল্লেখ করা উপায়ে কিডনি অনুদান সম্ভব নয়।

শুরুতেই ছড়িয়ে পড়া বার্তাটি ফেসবুকে অনুসন্ধান করি আমরা। একই বার্তা ২০১৭ সাল থেকে প্রায় প্রতি বছর দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট হতে দেখি আমরা (২০১৭,২০১৮,২০১৯,২০২০,২০২১,২০২২,২০২৩)। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের পোস্টগুলোতে শুধু একটি নম্বর ‘9837285283’ যুক্ত ছিলো। সময়ের ব্যবধানে আরো দুইটি নম্বর যুক্ত করে ২০১৯ সাল থেকে মোট তিনটি নম্বর সহ আলোচিত বার্তা প্রচার হতে দেখা যায়। 

বার্তাটির সাথে যুক্ত মোবাইল নম্বরগুলো লক্ষ্য করলে দেখতে পারি একটি নম্বরও বাংলাদেশি নয়। নম্বরগুলো কার সে বিষয়ে জানতে কলার সনাক্তকরণ ও ব্লক করার অ্যাপ ট্রুকলারের (Truecaller) ব্যবহার করি। ট্রুকলার ব্যবহার করে প্রথম অর্থাৎ ‘9837285283’ নম্বরটি সম্পর্কে জানা যায় এটি, Sandeep Kumar Garg নামের এক ব্যক্তির নম্বর। বাকি দুইটি নম্বর অর্থাৎ ‘9581544124’ এবং ‘8977775312’ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য মেলেনি। 

Image Collage: Rumor Scanner.

প্রথম নম্বর থেকে প্রাপ্ত নামের সূত্র ধরে ওপেন সোর্স অনুসন্ধানে ভারতের মিরাটে অবস্থিত নুতেমা হাসপাতালের ওয়েবসাইটে একজন ডাক্তারের প্রোফাইল খুঁজে পাই। সেখান থেকে জানতে পারি সন্দীপ কুমার গর্গ একজন নেফ্রোলজিস্ট (কিডনি বিশেষজ্ঞ)।

তার সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধানে ভারতীয় ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান নিউজ মোবাইলের (News Mobile) ওয়েবসাইটে ২০২১ সালে আলোচ্য বিষয়ে প্রকাশিত একটি ফ্যাক্ট-চেক প্রতিবেদন পাই আমরা। ভাইরাল এই বার্তার বিষয়ে সন্দীপ কুমারের সাথে যোগাযোগ করেছিলো তারা। এ বিষয়টি গুজব এবং অনেক বছর ধরেই ছড়িয়ে আসছে বলে নিউজ মোবাইলকে জানিয়েছেন সন্দীপ কুমার। 

আরেকটি ফ্যাক্ট-চেকিং সাইট Social Media Hoax Slayer-এ ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সন্দীপ কুমারের মন্তব্য পাওয়া যায়। জানা যায়, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এই সমস্যায় পড়েছেন তিনি। এই বিষয়ে সাইবার সেলেও অভিযোগ জানিয়েছেন। তার মতে কেউ প্র্যাংক বা হয়রানির উদ্দেশ্যে তার নম্বর যুক্ত করে এমন বার্তা ছড়িয়েছে।

আমরাও সন্দীপ কুমার গর্গের সাথে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। তবে প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময় অবধি কোনো প্রত্যুত্তর পাইনি।

বাকি দুইটি অর্থাৎ ‘9581544124’ এবং ‘8977775312’ নম্বরের বিষয়ে কোনো তথ্য মেলেনি এবং যোগাযোগও সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে আরো একাধিক আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় একই বার্তা ছড়িয়ে পড়লে ফ্রান্সের নিউজ এজেন্সি এএফপির ফ্যাক্টচেক বিভাগ বিষয়টিকে ভুয়া প্রমাণ করে। ২০২০ সালে একই বিষয়কে ভুয়া প্রমাণ করে ভারতের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান বুম

যেহেতু বার্তাটি বর্তমানে বাংলাদেশে ছড়িয়ে তাই বাংলাদেশে কিডনি অনুদান বিষয়ক আইনে কি বিধিনিষেধ আছে তা খুঁজে বের করি আমরা। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন, ২০১৮ অনুযায়ী জীবন রক্ষায় ২২ ধরনের নিকটাত্মীয়ের কিডনি নেওয়া যাবে। তারা হচ্ছেন- মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী ও আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা, নানি, দাদা, দাদি, নাতি, নাতনি এবং আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই বা বোন। এই তালিকার বাইরে অন্য কারও শরীর থেকে কিডনি নিয়ে অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করার আইনি সুযোগ নেই। 

যদিও ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আত্মীয় না হলেও কোনো ব্যক্তিকে কিডনি দান করার বিধান রেখে আইন সংশোধনের রায় দিয়েছে বাংলাদেশের হাইকোর্ট। তবে রায়ের পরবর্তী সময় আইন সংশোধনের কোনো তথ্য পাইনি আমরা। মূলত, ২০১৭ সাল থেকেই ভারতের নেফ্রোলজিস্ট সন্দ্বীপ কুমার গর্গ এবং আরো দুই অপরিচিত ব্যক্তির মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে চার কিডনি দান বিষয়ক একটি বার্তা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রচার হয়ে আসছে। জনাব সন্দ্বীপ এ বিষয়টি গুজব জানিয়ে সাইবার সেলেও অভিযোগ জানিয়েছেন। বাংলাদেশে মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন অনুযায়ী কিডনি রোগীকে বাঁচাতে ২২ ধরনের নিকটাত্মীয় নিজের একটি কিডনি দিতে পারেন। এই তালিকার বাইরে অন্য কারও শরীর থেকে কিডনি নিয়ে অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করার আইনি সুযোগ নেই।

অর্থাৎ, চার কিডনি দানের ভাইরাল বার্তাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img