জাতীয় পার্টির নির্বাচন বর্জন ও নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন বাতিল ঘোষণার ভুয়া তথ্য প্রচার

গত পহেলা জানুয়ারি HN tech 75 নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ‘নির্বাচন বর্জন করলো জাতীয় পার্টি, নির্বাচন বাতিল ঘোষণা দিলেন ইসি’ শীর্ষক থাম্বনেইল ব্যবহার করে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়েছে।

নির্বাচন বর্জন

ভিডিওটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া অবধি ভিডিওটি প্রায় সাড়ে ৮ হাজার বার দেখা হয়েছে। এছাড়া ভিডিওটিতে প্রায় ২ শত পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় বা সম্মিলিতভাবে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়নি এবং নির্বাচন কমিশনও (ইসি) নির্বাচন বাতিল ঘোষণা দেয়নি বরং অধিক ভিউ পাওয়ার আশায় ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি ঘটনার ভিডিও ক্লিপ যুক্ত করে তাতে চটকদার থাম্বনেইল ব্যবহার করে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।

অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। এতে দেখা যায়, এটি ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি ঘটনার ভিডিও ক্লিপ নিয়ে তৈরি একটি বিস্তারিত ভিডিও। তবে উক্ত ভিডিওটিতে কোথাও জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে নির্বাচন বর্জন এবং নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্তৃক নির্বাচন ঘোষণা করার দাবির স্বপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।

আলোচিত ভিডিওটি থেকে কিছু স্থিরচিত্র নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে বেসরকারি টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’ এর ইউটিউব চ্যানেলে গত ৩১ ডিসেম্বর (২০২৩) ‘নির্বাচন বর্জন করেছেন জাতীয় পার্টির বরিশাল-২, ৫ ও বরগুনা-১ আসনের প্রার্থীরা’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। 

এই ভিডিওটি’র সাথে আলোচিত ভিডিওটিতে দেখানো প্রথম ভিডিও ক্লিপটি’র মিল পাওয়া যায়।

Video Comparison by Rumor Scanner

অর্থাৎ, এই ভিডিওটি জাতীয় পার্টির সম্মিলিত নির্বাচন বর্জনের নয় বরং সেখানে দলটি’র বরিশাল-২, ৫ ও বরগুনা-১ আসনের প্রার্থীদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার উল্লেখ পাওয়া যায়।

তাছাড়া, মূলধারার গণমাধ্যম যুগান্তর এর অনলাইন সংস্করণে গত পহেলা জানুয়ারি ‘নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকব কিনা সময়ই বলে দেবে: জিএম কাদের’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

উক্ত প্রতিবেদন জাতীয় পার্টির পাঁচটি আসনের প্রার্থীদের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে জানা যায়। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের কারণ হিসেবে দলটির চেয়ারম্যান ও রংপুর-৩ (সদর) আসনের প্রার্থী (লাঙ্গল) জিএম কাদের বলেন, প্রার্থিতা প্রত্যাহার হুমকির কারণেও হতে পারে, অর্থের অভাবেও হতে পারে। অনেক প্রার্থী অর্থশালী হয়ে থাকেন না, অর্থের কারণেও অনেকে নির্বাচন থেকে সরে যান।

উক্ত প্রতিবেদনে জাতীয় পার্টির নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকবে কিনা সে বিষয়ে দলটির চেয়ারম্যান ও রংপুর-৩ (সদর) আসনের প্রার্থী (লাঙ্গল) জিএম কাদেরের বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, নির্বাচন না আসা পর্যন্ত সঠিক করে বলা যাচ্ছে না। নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকব কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।

পরবর্তীতে মূলধারার গণমাধ্যম বাংলাদেশ প্রতিদিন’র অনলাইন সংস্করণে আজ (০২ জানুয়ারি) ‘যারা না জানিয়ে নির্বাচন থেকে সরে গেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : জিএম কাদের’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

উক্ত প্রতিবেদনে দলটি’র মনোনীত কয়েকজন প্রার্থীর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে জিএম কাদেরের বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, যারা দলকে না জানিয়ে নির্বাচন থেকে সরে গেছে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অর্থাৎ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এখন পর্যন্ত দলটি’র পক্ষ থেকে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের কোনো ঘোষণা দেননি বরং দলটি থেকে মনোনীত যেসব প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

তাছাড়া, মূলধারার গণমাধ্যম যুগান্তর এর অনলাইন সংস্করণে আজ (০২ জানুয়ারি) ‘সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে রাষ্ট্র ব্যর্থ হবে: ইসি আনিছুর’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

উক্ত প্রতিবেদনে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমানের বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। নির্বাচন উপলক্ষ্যে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, যদি কোনো কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন না হয়, তাহলে রাষ্ট্র নিজেই ব্যর্থ হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে সমগ্র বিশ্ব থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে যাবে বাংলাদেশ। তাই কোনোভাবেই নির্বাচনকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। যখন যেখানে যা করার আপনাদের তাই করতে হবে। 

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের একটিই নির্দেশনা সেটি হলো অবাধ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে সততা, নিষ্ঠা এবং দলমতের ঊর্দ্ধে উঠে আপনাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।

নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমানের উক্ত বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাসময়েই অনুষ্ঠিত হবে, অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল ঘোষণার দাবিটিও সঠিক নয়।

মূলত, নানা নাটকীয়তার পর আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে দলটি’র কয়েকটি আসনের প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়। এরই প্রেক্ষিতে গত পহেলা জানুয়ারি HN tech 75 নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ‘নির্বাচন বর্জন করলো জাতীয় পার্টি, নির্বাচন বাতিল ঘোষণা দিলেন ইসি’ শীর্ষক থাম্বনেইল ব্যবহার করে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত দাবিগুলো সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে এখন পর্যন্ত জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। তাছাড়া নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্তৃক আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল ঘোষণার দাবিরও সত্যতা পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, আগামী ৭ জানুয়ারি রোববার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

সুতরাং, জাতীয় পার্টি কর্তৃক নির্বাচন বর্জন ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্তৃক নির্বাচন বাতিল ঘোষণা দাবিতে প্রচারিত তথ্যগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img