শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে ট্রাম্পকে উদ্ধৃত করে ভুয়া তথ্য প্রচার

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, “আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিস্ফোরক এক ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসেই বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে এমন এক মন্তব্য করেছেন যা শুনলে আপনার চোখ কপালে উঠতে বাধ্য হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম ভাষণে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মতো একজন সফল প্রধানমন্ত্রী আর আসবে না। তার অসাধারণ নেতৃত্বেই বাংলাদেশ উন্নয়নের শিখরে পৌঁছেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আরো বলেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে যে সাফল্য অর্জন করেছে তা অনন্য। তার হাতেই বাংলাদেশ নিরাপদ। এখানেই থেমে যাননি ট্রাম্প। তিনি আরে বলেন আমি অতি শীঘ্রই বাংলাদেশের মাটিতে ফিরিয়ে আনবো এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাকে আবারও ক্ষমতায় বসানোর ব্যবস্থা করবো। [….]”

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া অবধি উক্ত দাবিতে প্রচারিত উপরোল্লিখিত পোস্টগুলো সম্মিলিতভাবে এক লক্ষেরও অধিক বার দেখা হয়েছে। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে ট্রাম্পকে উদ্ধৃত করে প্রচারিত তথ্যগুলো সঠিক নয়৷ প্রকৃতপক্ষে কোনোরকম নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই ভিন্ন, পুরোনো, সম্পাদিত ও অপ্রাসঙ্গিক নানা ছবি ও ভিডিও ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে একটি ভিডিও তৈরি করে তা আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পোস্টগুলো পর্যবেক্ষণ করলে তাতে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে ট্রাম্পকে উদ্ধৃত করে প্রচারিত তথ্যগুলোর দাবির সপক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ উল্লেখ করতে দেখা যায়নি৷ এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলেও কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে আলোচিত দাবির সপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রচারিত পুরো ভিডিওটিতে মূলধারার গণমাধ্যম যমুনা টিভির লোগো দেখা গেলেও যমুনা টিভির ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ বা ইউটিউব চ্যানেলে এমন কোনো প্রতিবেদন প্রকাশের প্রমাণ মেলেনি। 

এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে অন্য কোনো বিষয়েও শেখ হাসিনাকে ট্রাম্পের চিঠি দেওয়ার বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। বরং, শেখ হাসিনার তরফ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন চিঠি দেওয়ার বিষয়ে জানা যায়৷

আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করলে তাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও শেখ হাসিনার নানা ফুটেজ ও ছবি সংযুক্ত করতে দেখা যায়৷ প্রচারিত ভিডিওটির শুরুর দিকে বলা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প চিঠি দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এসময় গণমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের লোগোসহ একটি ফুটেজও সংযুক্ত করা হয়৷ তবে, ফুটেজটিতে শেখ হাসিনাকে ট্রাম্পের চিঠি দেওয়ার বিষয়ে লেখার বদলে “ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শেখ হাসিনার চিঠি | ডনাল্ড ট্রাম্প ও তার স্ত্রীর রোগমুক্তি কামনা” লেখা দেখতে পাওয়া যায়৷ 

Comparison : Rumor Scanner

এরই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করলে ইনডিপেনডেন্ট  টেলিভিশনের ইউটিউব চ্যানেলে ২০২০ সালের ০৪ অক্টোবরে “ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার স্ত্রীর রোগমুক্তি কামনা করে চিঠি দিয়েছেন শেখ হাসিনা” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওটির শুরুর দিকের দৃশ্যের সাথে প্রচারিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত উক্ত দৃশ্যের হুবহু সাদৃশ্য পাওয়া যায়, তবে অডিওতে “ট্রাম্প’কে” এর জায়গায় “কে” বাদ দিয়ে “ট্রাম্প” করে প্রচার করা হয়েছে। সংবাদ প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, সেসময় ট্রাম্প ও তার স্ত্রী করোনা আক্রান্ত হলে রোগমুক্তি কামনা করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিঠি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, প্রায় ৪ বছর পুরোনো ভিন্ন ও অপ্রাসঙ্গিক একটি দৃশ্য আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।

এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম ভাষণে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শীর্ষক দাবিটির সময় ট্রাম্পের ভাষণ দেওয়ার একটি ফুটেজ প্রচার করা হয়৷ তবে, ফুটেজটির একাধিক কি-ফ্রেম নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে ‘ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ আর্কাইভড’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৭ সালের ০১ ডিসেম্বরে প্রচারিত একটি ভিডিও এর ৪ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড পরবর্তী সময়ের দৃশ্যের সাথে হুবহু সাদৃশ্য পাওয়া যায়। 

Comparison : Rumor Scanner

তাছাড়া, একইদিনে ফক্স বিজনেস নামের একটি ফেসবুক পেজেও প্রচারিত একটি পোস্টে উক্ত দৃশ্যটি পাওয়া যায়৷ জানা যায়, দৃশ্যটি ওয়াশিংটন ডিসিতে ৯৫তম বার্ষিক জাতীয় ক্রিসমাস ট্রি লাইটিং এর দৃশ্যের।

এছাড়াও, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির একটি দৃশ্যে দেখা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্প হাতে শেখ হাসিনা ও ট্রাম্পের একটি ছবি ধরে আছেন। তবে, রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে উক্ত ছবিটির সত্যতার সপক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে আসা নিয়ে স্কাই নিউজ অস্ট্রেলিয়ার ফেসবুক পেজে প্রচারিত একটি সংবাদের একটি দৃশ্যে ট্রাম্পকে একটি নথি সদৃশ বস্তু হাতে দেখা যায়৷ 

Comparison : Rumor Scanner

ছবি দুইটি তুলনা করলে নিশ্চিত হওয়া যায়, উক্ত স্থিরচিত্র ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে আলোচিত ছবিটি তৈরি করা হয়েছে। 

উপরোল্লিখিত কোনো দৃশ্য বা ছবিতেই শেখ হাসিনা বা আলোচিত দাবির কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি৷ এছাড়া, প্রচারিত ভিডিওটিতে আরো কয়েকটি শেখ হাসিনার সাথে ট্রাম্পের ছবি ও ফুটেজ সংযুক্ত করা হয়েছে তবে কোনোটিরই সত্যতা পাওয়া যায়নি।

এদিকে, গত ২১ জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম সিএনএনের ইউটিউব চ্যানেলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের ভাষণ পাওয়া যায়। উক্ত ভাষণটি মনোযোগ দিয়ে শুনলে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে ক্ষমতায় বসানোর বিষয়ে কোনো কথা বলতে ট্রাম্পকে শোনা যায়নি৷ তিনি বরং যুক্তরাষ্ট্রের সমৃদ্ধি, সীমান্ত ও করসহ নানাক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন সেসব বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন।

পাশাপাশি, প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলেও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা, চিঠি দেওয়া বা শেখ হাসিনার গুণ উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্পকে সাম্প্রতিক সময়ে কোনো বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি।

উল্লেখ্য যে, প্রচারিত ভিডিওটির একটি অংশে শেখ হাসিনাকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়, যদিও শেখ হাসিনার বক্তব্যের শব্দ মিউট করে দেওয়া হয়৷ তবে, শেখ হাসিনার বক্তব্যের উক্ত দৃশ্যটির ব্যাকগ্রাউন্ডও সম্পাদিত। এ বিষয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম ইতোমধ্যে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

সুতরাং, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে ট্রাম্পকে উদ্ধৃত করে প্রচারিত তথ্যগুলো মিথ্যা।

তথ্যসূত্র


আরও পড়ুন

spot_img