কোটা আন্দোলনে নিহত হওয়া ফাইয়াজকে নিয়ে কালবেলাকে উদ্ধৃত করে ভুয়া তথ্য প্রচার

সকল গ্রেডের সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কার করে কোটা ব্যবস্থার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা গত পহেলা জুলাই থেকে টানা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে গত ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়েও কথা বলেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হন। এর প্রেক্ষিতে আন্দোলনের কর্মসূচিতে রাস্তায় নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে ঘটেছে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা, এসেছে বহু হতাহতের খবরও। আন্দোলনকারীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার দলীয় কর্মীদের সংঘর্ষে অন্তত ২১২ জন প্রাণ হারান বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। ঢাকার ধানমন্ডিতে এমনই এক সংঘর্ষে গত ১৮ জুলাই ফারহান ফাইয়াজ নামের ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীও নিহত হন। সম্প্রতি এরই প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মূলধারার সংবাদমাধ্যম কালবেলার বরাতে দাবি করা হচ্ছে, ফারহান ফাইয়াজকে টিউশনি পড়াতো ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রশিবিরের সাহিত্য সম্পাদক আবির হোসাইন। ফারহানের পরিবার জানতো না তার শিক্ষক সরাসরি শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত। গত ১৮ জুলাই সকালে ফারহানকে কল দিয়ে ঘুরতে বের হবে বলে নিয়ে যায় বাসা থেকে। তারপর কৌশলে ফারহানকে হত্যা করে। 

এই দাবিটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুব মহিলা লীগের যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি ইয়াসমিন সুলতানা পোলেন, মুক্তা নামের সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী ও আওয়ামীলীগ কর্মী এবং চট্টগ্রাম ০৪ আসনের সংসদ সদস্য এস এম আল মামুনের ব্যক্তিগত সহকারী মো: সায়দুর রহমান মারুফের মতো ব্যক্তিবর্গরাও পোস্ট করেছেন।

ফাইয়াজ

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ফারহান ফাইয়াজের টিউশন শিক্ষক শিবির কর্মী এবং ফারহানকে খুনের সঙ্গে তার শিক্ষক জড়িত শীর্ষক দাবিতে কালবেলা কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি৷ কালবেলা ব্যতীত অন্য কোনো মূলধারার গণমাধ্যমে বা বিশ্বস্ত তথ্যসূত্রের মারফতেও আলোচিত দাবির পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে কালবেলা এমন কোনো সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কি না তার অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার টিম। কিন্তু, কালবেলার ওয়েবসাইটে আলোচিত দাবিতে কোনো সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। 

এ বিষয়ে অধিকতর নিশ্চিতে কালবেলার অনলাইন বিভাগের প্রধান পলাশ মাহমুদের সাথে কথা বলে রিউমর স্ক্যানার টিম। আলোচিত দাবিতে কালবেলা এমন কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি বলে তিনিও রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেন।

এছাড়া, প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে আলোচিত দাবিতে অন্য কোনো মূলধারার গণমাধ্যমেও প্রকাশিত কোনো সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। 

ফারহান ফাইয়াজের নিহত হওয়ার বিষয়ে কালবেলায় ১৮ জুলাই তারিখে “ধানমন্ডিতে সংঘর্ষে ঢাকা রেসিডেনসিয়ালের শিক্ষার্থীর মৃত্যু” শিরোনামে প্রকাশিত একটি খবর পাওয়া যায় যেখানে বলা হয়, “রাজধানীর ধানমন্ডিতে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী মো. ফারহানুল ইসলাম ইসলাম ভূঁইয়া (ফারহান ফায়াজ) নিহত হয়েছেন। তার বয়স ১৮ বছর। বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) দুপুরে ধানমন্ডির পুরোনো ২৭ নম্বর সড়ক এলাকায় তার মৃত্যু হয়। তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং ২০২৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরীক্ষায় অংশ্রগ্রহণের কথা ছিল তার। এর আগে বেলা ১১টা থেকে রাপা প্লাজার পাশের মোড় থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়। মৃত্যুর খবর জানিয়ে ফেসবুকে এক পোস্টে ফারাজের নিকট আত্নীয় নাজিয়া খান জানিয়েছেন, ‘তারা আমার শিশুকে হত্যা করেছে। এমনকি তার বয়স ১৮ বছরও ছিল না। আমি ফারহান ফাইয়াজ এর হত্যার বিচার চাই।'”

পরবর্তীতে অনুসন্ধানে নাজিয়া খান নামের এই নারীর উক্ত পোস্টটির অস্তিত্বের সত্যতা পাওয়া যায়৷ ফারহান ফাইয়াজকে নিয়ে নাজিয়া খানের উক্ত পোস্টে তিনি আরো জানান, সে ২০০৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেছে। তিনি ফারহানের জৈবিক মা না হলেও ফারহান তার কাছে সন্তানতুল্য। ফারহান ফাইয়াজ সম্পর্কে তার আরো ভিন্ন দুইটি পোস্ট পাওয়া যায়। কিন্তু, কোথাও তিনিও ফারহানের হত্যা সম্পর্কে তার টিউশন শিক্ষক ও শিবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেননি।

মূলত, দেশব্যাপী চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে গত ১৮ জুলাই ধানমন্ডিতে নিহত হন ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজ। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মূলধারার সংবাদমাধ্যম কালবেলার বরাতে দাবি করা হয়, ফারহান ফাইয়াজের টিউশন শিক্ষক ছিলেন পড়াতো ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রশিবিরের সাহিত্য সম্পাদক আবির হোসাইন। ফারহানের পরিবার জানতো না তার শিক্ষক সরাসরি শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত। গত ১৮ জুলাই সকালে ফারহানকে কল দিয়ে ঘুরতে বের হবে বলে নিয়ে যায় বাসা থেকে। তারপর কৌশলে ফারহানকে হত্যা করে। কিন্তু, রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, কালবেলা উল্লিখিত দাবিতে কোনো সংবাদ প্রচার করেনি এবং বিশ্বস্ত সূত্রে আলোচিত দাবির পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। 

সুতরাং, কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত ফারহান ফাইয়াজের শিক্ষক শিবির কর্মী এবং তিনি ফারহানকে হত্যার সাথে জড়িত শীর্ষক সংবাদ কালবেলা প্রকাশ করেছে মর্মে প্রচারিত দাবিটি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img