জীবিত সাপ খাওয়ালে উটের হায়াম নামের কোনো রোগ নিরাময় হয় না

গত কয়েক বছর ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দাবি করা হচ্ছে, ‘জীবিত সাপ খাওয়ালে উটের হায়াম নামের রোগ নিরাময় হয়। উটের চোখের পানি যেকোন প্রাণীর বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর। এমনকি এই দাবিটি পবিত্র কোরআন শরীফেও উল্লেখ আছে’ মর্মেও দাবি করা হচ্ছে। 

জীবিত সাপ

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

এই দাবিতে এখানে ফেসবুকে ভাইরাল তিনটি ভিডিও লক্ষাধিক মানুষের নিকট পৌঁছেছে। সহস্রাধিক মানুষ ভিডিওগুলোতে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, হায়াম নামক রোগ কিংবা জীবিত সাপ খেলে হায়াম রোগ নিরাময় হওয়ার পক্ষে পবিত্র কোরআন শরীফে কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় নি। বৈজ্ঞানিকভাবেও উক্ত কথার কোনো ভিত্তি নেই। তাছাড়া, উটের চোখের পানি যেকোনো বিষের ক্ষেত্রে কার্যকরী তথ্যটিরও কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। 

আলোচিত ভিডিওগুলোর প্রথম দিকে দাবি করা হয়, পবিত্র কোরআন শরীফে এমন একটি রোগের কথা বলা হয়েছে, যে রোগে আক্রান্ত হলে উট খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উট শুধুমাত্র সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ রোগের নাম হায়াম। এটি থেকে নিরাময় পেতে উটকে অত্যন্ত বিষধর জীবন্ত সাপ খাওয়াতে হবে। 

পবিত্র কোরআন শরীফে কি হায়াম সম্পর্কে এমন কিছু বলা হয়েছে? 

রিউমর স্ক্যানার টিম কিওয়ার্ড অনুসন্ধান করে ইংল্যান্ডের একটি সমসাময়িক ইসলামিক প্রতিষ্ঠান ও রিসার্চ সেন্টার Al Qudwa Institute এর একটি নিবন্ধ খুঁজে পায়। নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে পবিত্র কোরআন শরীফে ১৫ বার উটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত আল্লাহর কারুকার্যের নিদর্শন বুঝাতেই উটের উল্লেখ করা হয়েছে৷ তবে, কোরআন শরীফে উল্লেখ করা সেই ১৫ বারের বিস্তারিত উল্লেখ উক্ত নিবন্ধে না থাকায় অধিকতর কিওয়ার্ড অনুসন্ধানে আরো একটি নিবন্ধ ও একটি রিসার্চ পেপার খুঁজে পাওয়া যায়। The last dialogue নামের একটি ওয়েবসাইটে পবিত্র কোরআন শরীফে সেই ১৫ বার উল্লেখ করা আয়াত খুঁজে পাওয়া যায়। দেখা যায়, কোরআন শরীফের ৬ষ্ঠ সূরা, সূরা আল আন-আম থেকে শুরু করে ৯১তম সূরা, সূরা আশ শামস পর্যন্ত ১৫টি আয়াতে ১৫ বার উটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর কোনো আয়াতেই হায়াম রোগের কথা উল্লেখ পাওয়া যায় নি। মূলত আল্লাহর কারুকার্য ক্ষমতা, উদাহরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রেই উটের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ‘A Quick look at camel’s names in holy Quran’ শিরোনামে রিসার্চগেটে প্রকাশিত একটি রিসার্চ পেপার খুঁজে পাওয়া যায়। ইরানের সিরাজ শহরে অবস্থিত সিরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন গবেষক Aliasghar Chalmeh, Mohamadreza Farangi ও Seyedmojtoba Naghib এর দ্বারা প্রকাশিত উক্ত রিসার্চ পেপারে কোরআন শরীফে উল্লেখ হওয়া উটের নাম নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। তাদের এই গবেষণাপত্র পড়ে জানা যায়, প্রসঙ্গ অনুসারে পবিত্র কোরআন শরীফে এগারো রকমের নামে উটকে বুঝানো হয়েছে। আবার কিছু সময় উটকে বুঝানো শব্দ দিয়ে গরু, ভেড়ার মতো পশুকেও বুঝানো হয়েছে। সূরা আল আনআম এর ১৪৪তম আয়াতে ব্যবহৃত Ebel হচ্ছে উটের জাতিবাচক শব্দ যেটাকে উটের পাল বুঝাতে ব্যবহার করা হয়, তবে কোরআন শরীফে একবচন হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। উট শান্ত এবং শব্দ ছাড়া চলাফেরা করায় না’ম নামেও ব্যবহার হয়েছে। তাছাড়া, Zamer, Jamal, Naghe ইত্যাদি নামেও উটকে উল্লেখ করা হয়েছে। এরকম নানা বচন, সমার্থক শব্দসহ নানাভাবে কোরআন শরীফে মোট ১৮ বার উটের নাম উল্লেখ করা হয়েছে বা উটকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু, কোনো আয়াতে হায়াম বা হায়ামের রোগ নিরাময় এর কথা উল্লেখ করা হয় নি৷ কোরআন শরীফে এ বিষয়ে উল্লেখ থাকার স্বপক্ষে কোনো স্বনামধন্য ইসলামি স্কলারেরও দাবি পাওয়া যায় নি। 

Screenshot : Research Gate

এ বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে কোন আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে জানতে অধিকতর অনুসন্ধান করলে, “উট কেন জীবিত সাপ খায়? জানলে অবাক হয়ে যাবেন” শিরোনামে মাওলানা সিদ্দিকুর রহমান নাসরুল্লাহ এর একটি ভিডিও পাওয়া যায়৷ তিনি সেখানে হায়াম এবং হায়ামের প্রতিকারের বিষয়ে একই দাবি করে উল্লেখ করেন, সূরা আল ওয়াক্বিয়া’র ৫২ থেকে ৫৬তম আয়াতে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সত্যতা নিশ্চিত করতে সূরা আল ওয়াক্বিয়া এর ৫২-৫৬ তম আয়াতের ইংরেজি এবং বাংলা দুইটি অনুবাদ পড়লেও হায়ামের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় নি, এমনকি আকার ইঙ্গিতেও এ বিষয়ে কোনো রোগের কথা বলতে দেখা যায় নি। সূরা আল ওয়াক্বিয়া এর ৫২ থেকে ৫৬তম আয়াতের অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “”তারা/তোমরা অবশ্যই আহার করবে যাক্কূম গাছ থেকে, এবং ওটা দ্বারা তোমরা উদর পূর্ণ করবে, তারপর তোমরা পান করবে ফুটন্ত পানি। পান করবে পিপাসার্ত উটের ন্যায়। কিয়ামতের দিন এটাই হবে তাদের আতিথ্য।” 

স্পষ্টতই এখানে হায়াম বলতে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই এবং সাপকে খাওয়ানোরও কোনো কথা বলা হয় নি। উল্লেখ্য যে, উট এক নাগাড়ে অনেক বেশি পানি পান করে থাকে৷ এর পরিমাণ ১০০ লিটারেরও বেশি হয়ে যেতে পারে অনায়াসেই। এ বিষয়ে তাফসীরে আহসানুল বায়ানে কাছাকাছি একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়, উক্ত আয়াতে উট দ্বারা, এক ধরণের পিপাসিত উটদেরকে বলা হয়েছে যারা বিশেষ এক রোগের কারণে পানির উপর পানি পান করেই যায়, কিন্তু তাদের পিপাসার নিবৃত্তি হয় না। 

Screenshot : Hadith BD

এই ব্যাখ্যা অনুসারেও এটা পরিষ্কার যে এখানে কোথাও হায়াম বা সাপ খাইয়ে সুস্থ করার কথা বলা হয় নি। তাছাড়া, দাবিতে বলা হয়েছে উট রোগাক্রান্ত হওয়ার পর কিছুই খায় না৷ কিন্তু এখানে বরং পিপাসার্ত উটের কথা বলা হচ্ছে যারা পানির পর পানি পান করেই যাচ্ছে। তারপরও, অধিকতর নিশ্চিত হতে এর পরবর্তী বা পূর্ববর্তী আয়াত পড়েও সাপ খাইয়ে সুস্থ করার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় নি। পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, “অতঃপর হে বিভ্রান্ত মিথ্যাজ্ঞানকারীরা!” এবং পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, “আমিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তবে কেন তোমরা বিশ্বাস করছ না?”

অর্থাৎ, কোরআন শরীফে সাপ খাইয়ে উটকে হায়াম নামক রোগ থেকে নিরাময় করার কথা উল্লেখ করার বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি।

আলোচিত ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর উট কোনোকিছুই খায় না।

উট এর কোনোকিছু না খাওয়া কি খুবই অস্বাভাবিক? 

Denver Zoo এর মতে, Bactrian Camel (উট) একসাথে ৩৫ গ্যালন পানি পান করতে পারে। Wildlife Informer এর মতে উট এক নাগাড়ে ৩০ গ্যালন পানি পান করতে পারে। San Diego Zoo এর মতে, উট একবারে ৩২ গ্যালন পানি পান করতে পারে। উট এই পানি তার কুঁজে চর্বি আকারে জমা রাখে এবং পরবর্তীতে ব্যবহার করে। একবার জমা রাখার পর টানা ১০ থেকে ১৫ দিন কোনো পানি পান না করেই উট বেঁচে থাকতে পারে। কোনো খাবার ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে কয়েক মাস। উট এমনকি নিজের ওজন ৪০ শতাংশ হ্রাস করেও বেঁচে থাকতে পারে। তাই, দেখা যাচ্ছে উটের পর্যাপ্ত খাবার থাকলে কোনোকিছু না খাওয়া সবসময় অস্বাভাবিক নয়। বরং, তাদের সক্ষমতাই এমন। এরকম সময়ে উটকে হায়াম রোগে আক্রান্ত ধরে সাপ খাওয়ানো উটের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। 

হায়াম রোগের কি অস্তিত্ব আছে?

কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধান করে কোনো বিশ্বস্ত বৈজ্ঞানিক সূত্রে হায়াম নামক কোনো রোগের প্রমাণ পাওয়া যায় নি। বিশেষ করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার মতো উপসর্গের কোনো রোগ খুঁজে পাওয়া যায় নি। যুক্তরাজ্য বসবাসরত গবেষক JJ Mcgrane ও A.J Higgins কর্তৃক শীর্ষস্থানীয় বৈজ্ঞানিক ও মেডিক্যাল জার্নালের ডাটাবেস ওয়েবসাইট সায়েন্স ডিরেক্টে প্রকাশিত উটের রোগ নিয়ে লেখা রিসার্চ পেপারে ক্যামেল পক্স, স্যালমোনেলোসিসের মতো বিভিন্ন রোগের উল্লেখ পাওয়া গেলেও হায়াম নামের কোনো রোগের উল্লেখ পাওয়া যায় নি। এরকমই আরেকটি রিসার্চ পেপার খুঁজে পাওয়া যায় Frontiers নামক জার্নালে। সেখানে সৌদি আরবের কিং ফয়সাল ইউনিভার্সিটির গবেষক Mahmoud Kandeel ও Abdullah I. A. Al-Mubarak এবং মিশরের কাফরেল ইউনিভার্সিটির গবেষক উটের বিভিন্ন রোগ, রোগের প্রতিকার, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সম্পর্কে গবেষনাপত্রটি লিখেন। সেখানেও বিভিন্ন রোগের উল্লেখ থাকলেও ‘হায়াম’ রোগের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় নি। 

এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধানে The Daily Wild Life এবং Wildilfe boss নামক ওয়েবসাইটে হায়াম রোগ সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়৷ তবে, তাদের নিবন্ধে তারা সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, রোগটির কোনো অস্তিত্ব নেই, এটি লোকবিশ্বাস। 

Screenshot : The Daily Wildlife

Wildlife Boss এর নিবন্ধ অনুসারে, Isidore of Seville নামের এক স্প্যানিশ ব্যক্তি Etymologies নামের ২০ খন্ডের একটি বই লিখেছিলেন৷ বইটিতে অসুস্থ থাকা অবস্থায় হরিণের একটি অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করে নথিবদ্ধ করেন। নিজেদের অসুস্থতা নিরাময় করতে মাটি থেকে সাপ বের করে তা হরিণ খেত। এই বিশ্বাসটির সাথে উটকে সাপ খাওয়ালে সুস্থ হওয়ার মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্বাসের সাথে মিল আছে৷ তাই ধরে নেওয়া হয়, কালের পরিক্রমায় হরিণের থেকে উটের সাথে এই তথ্যটি জুড়ে গিয়েছে। 

Screenshot : Wildlife Boss

Wildlife Boss এবং The Daily Wildlife এর নিবন্ধ অনুসারে, সাপকে খাওয়ালে উট সুস্থ হওয়ার রোগটি বলতে হয়তো Trypanosomosis রোগটি বুঝানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের দ্বারা পরিচালিত বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ মেডিক্যাল লাইব্রেরি National Library of Medicine এবং The Daily Wildlife এর নিবন্ধ অনুসারে  এটি Trypanosoma evansi বা সংক্ষেপে T evansi নামক একটি পরজীবির কারণে সৃষ্ট হওয়া একটি গুরুতর প্যাথোজেনিক প্রোটোজোয়াল রোগ। রোগটি রক্ত শোষণ করা পতঙ্গের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি রক্ত সংক্রমিত করে এবং সুস্থ হওয়ার জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এটি গর্ভপাত, অপরিবর্তনীয় অন্ডকোষের ক্ষয় সহ মারাত্মক ক্ষতিসাধন করতে পারে। এই রোগটির লক্ষণ হলো: জ্বর, চোখ দিয়ে পানি পড়া, রক্তশূন্যতা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ফুলে যাওয়া, নিস্তেজ হওয়া, দুর্বল হওয়া ইত্যাদি। সুচিকিৎসা না করলে এটিতে মৃত্যুর হার প্রায় শতভাগ। 

তাছাড়া, সাপ খাওয়ানো এই রোগটির চিকিৎসা নয়। Science Direct জার্নাল ডাটাবেসে প্রকাশিত রিসার্চ পেপারWildlife Boss এর নিবন্ধ অনুসারে, রোগটি থেকে সুস্থ হতে Naganol নামের একটি polyanionic compound এর চার গ্রাম শিরায় প্রদান করতে হয়৷ 

Screenshot : WIldlife Boss

এমন কোনো গবেষণা পাওয়া যায় নি যেখানে বলা হয়েছে, এই রোগটি জ্যান্ত সাপ খাওয়ালে নিরাময় হয়ে যাবে। তাছাড়া, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার কোনো উপসর্গও এই রোগে পাওয়া যায় নি।

আলোচিত ভিডিওটিতে দাবি করা হয়েছে, এই রোগাক্রান্ত হলে উট নিজেই অনেকসময় সাপ খেয়ে থাকে। 

উট কি সাপ খায়? 

Animal World এ “What Do Camels Eat in the wild and as pets? Facts & FAQ” শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধ অনুসারে, উটের মূলত দুইটি প্রজাতি; Dromedary এবং Bactrian. Dromedary দের একটি কুঁজ থাকে এবং এই প্রজাতির সব উটকে পোষ মানানো হয়েছে। এরা আফ্রিকা এবং এশিয়ার মরু অঞ্চলে বসবাস করে এবং মূলত গুল্ম এবং ঘাস খেয়ে থাকে। অপরদিকে Bactrian দের মধ্যে গবাদি এবং বন্য দুই প্রকারেরই আছে। এদের দুইটি কুঁজ থাকে এবং এরা মঙ্গোলিয়া ও চীনে বাস করে। সাধারণত ঘাস এবং অন্যান্য মরু গুল্ম খেয়ে থাকে৷ অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে, প্রজাতি যেরকমই হোক না কেন, উট মূলত তৃণভোজী প্রাণী। তবে, মাঝেমধ্যে উট মাংসাশী আচরণও করে থাকে। তারা মাংস পরিপাক করতে পারে এবং মৃত প্রাণী ও গলিত মাংস খেয়ে থাকে৷ তবে, মূলত তাদের খাদ্য সংকট দেখা দিলে তারা এমন মাংসাশী আচরণ করে থাকে। JSTOR নামের একটি ডিজিটাল লাইব্রেরিতে “Conundrums in Indology. I. The Snake-Eating Camel (karabha)” শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র পাওয়া যায়। গবেষণাপত্রটিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ ভারতেও সম্প্রতি উটকে মাঝেমধ্যে সাপ খেতে দেখা যাওয়ার পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। 

Animalia তে প্রকাশিত নিবন্ধ অনুসারে, Dromedary Camel (উট) তৃণভোজী প্রাণী। তারা মূলত গাছের পাতা, শুষ্ক ঘাস এবং মরু গাছপালা খেয়ে থাকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঁটাযুক্ত উদ্ভিদও খেয়ে থাকে । কাঁটাযুক্ত উদ্ভিদ অন্যান্য প্রাণীরা খেতে না পারলেও উটের পুরু ঠোঁটের কারণে তারা বেশ আয়েশেই এটি খেতে পারে। খাবার খুঁজার সময় তারা বৃহৎ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিটি গাছ থেকে মাত্র কয়েকটি পাতা নিয়ে থাকে। তাদের জন্য পানি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র ১৩ মিনিটের মধ্যে তারা ৩০ গ্যালন অর্থাৎ ১১৩ লিটার পানি পান করতে পারে।

তাই বলা যায়, উট মূলত তৃণভোজী প্রাণী। তবে, উট মাঝেমধ্যে মাংসাশী আচরণ করতে পারে৷ মূলত যখন কোনো তৃণভোজী খাবার না পাওয়া যায়, তখন উট সাপ খেয়ে থাকতে পারে। 

সাপ খাওয়ার পর কি উটের চোখ দিয়ে পানি পড়ে?

আলোচিত ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, সাপ খাওয়ার পর উটের চোখ দিয়ে পানি পড়ে এবং সেটির নাম তিরআক৷ এটি যেকোনো বিষ নষ্ট করতে সক্ষম। 

কিন্তু, Animal World এ ‘Do Camels Eat Snakes & Are They Poisonous To Them? Facts & FAQ’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধ অনুসারে, সাপ খাওয়ার পর উটের চোখ দিয়ে পানি পড়ার পক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। এটি পুরোপুরি লোককথা।

The Daily Wildlife এ ‘Why Do Camels Eat Snakes?’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধও এই দাবিকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণহীন লোককথা বলেই জানিয়েছে। তাছাড়া, উটকে সাপ খাওয়ানোর সময় সাপ কামড় বসিয়ে দিলে উটের জন্য বিপজ্জনক বা প্রাণঘাতীও হতে পারে।

সাপের বিষ বিভিন্ন রকমের ভঙ্গুর প্রোটিন দিয়ে তৈরি৷ এটি উটের রক্ত সংবহনতন্ত্রে মিশে গেলে, অর্থাৎ রক্তে পৌঁছে গেলে বিষক্রিয়া করবে৷ তারপর রক্তের সাথে মিশে এটি শরীরের যে জায়গায় যাবে সেটি অক্ষম করে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। সাপের বিষ মূলত প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ করে থাকে। তাই, যদি কোনো অবস্থায় সাপ ঐ উটকে কামড় দিয়ে বসে, তাহলে প্রচুর বিষ স্থানান্তর করবে এবং এটি উটের ক্ষতি করতে পারে, এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে। 

তবে, যদি উট ঐ সাপকে গিলে ফেলে, তাহলে বিষের ঐসব প্রোটিন উটের পরিপাকতন্ত্রের দ্বারা ভেঙে যাবে এবং বিষের কার্যকরী শক্তি দুর্বল করে ফেলবে বা বিষকে নষ্ট করে ফেলবে। তবে, কিছু বিষ এরপরও রক্তে মিশে যেতে পারে। আর, যদি কোনোভাবে এই বিষের পরিমাণটা বেশি হলে উটকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা প্যারালাইজড করা, হৃৎপিণ্ড বা কিডনি নষ্ট করা, এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে।

তাই, উটকে জ্যান্ত সাপ খাওয়ানো উটের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

উটের চোখের পানি কি যেকোন বিষ নষ্ট করতে পারে?

আলোচিত ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, সাপ খাওয়ার পর উটের চোখ থেকে পড়া পানির নাম তিরয়াক৷ এটি যেকোন প্রাণীর বিষ নষ্ট করতে উপযোগী। 

কিন্তু, এই দাবির পক্ষেও কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। উল্লেখ্য যে, বিষের বিরুদ্ধে কাজ করা পদার্থকে অ্যান্টিভেনম বলা হয়। Animal World এর নিবন্ধ অনুসারে, উটের চোখের পানি বিষের বিরুদ্ধে কাজ করার দাবিটি মিথ্যা। তবে, উটের থেকে বেশ কার্যকরী অ্যান্টিভেনম পাওয়া যায়। তবে, সেটি উটের চোখের পানি থেকে বানানো হয় না৷ Wild Life Boss এ ‘Do Camels Eat Snakes? (Are They Poisonous?)’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধ অনুসারে, অতীতে ভেড়া এবং ঘোড়া থেকে বানানো অ্যান্টিভেনম হিমায়িত অবস্থায় রাখতে হতো এবং কক্ষ তাপমাত্রায় অ্যান্টিভেনমটি তার কার্যকারিতা হারাতো। এই কারণে বিদ্যুতহীন গ্রামাঞ্চলে এটি বেশ সমস্যার সৃষ্টি করতো। তাছাড়া, হিমায়িতকরণ শর্তটাও অ্যান্টিভেনমকে বেশ ব্যয়বহুল বানিয়ে দিত। সাম্প্রতিক সময়ে, বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, উট থেকে বানানো অ্যান্টিভেনমকে হিমায়িত অবস্থায় রাখার প্রয়োজন নেই। এটি কক্ষ তাপমাত্রাতেই নিজের কার্যকারিতা বজায় রাখতে পারে। ধারণা করা হয়, মরু আবহাওয়ায় উটের ভালোই অভ্যাস্ততা এর কারণ হতে পারে। অ্যান্টিভেনম তৈরি করতে, অ্যান্টিভেনম উৎপন্ন করতে চাওয়া প্রাণীর শরীরে অল্প মাত্রায় বিষ প্রবেশ করানো হয়। এই মাত্রাটি অল্প পরিমাণেই হতে হবে৷ অতিরিক্ত হলে বিষটি প্রাণীর ক্ষতি করে ফেলবে। তারপর প্রাণীটির রক্ত সংগ্রহ করা হয় যাতে করে বিষের বিপরীতে প্রাণীটির শরীরে উৎপন্ন হওয়া অ্যান্টিবডি সংগ্রহ করা যায়। অতঃপর সেটি ল্যাবে নিয়ে পরিশোধিত করে ব্যবহার উপযোগী বানানো হয়। তাই, দেখা যাচ্ছে উটের বিষের অ্যান্টিভেনম তৈরির প্রক্রিয়ায় উটের চোখের পানির কোনো প্রয়োজন নেই৷ তাছাড়া, চোখের পানি থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি করা হয় না। 

মূলত, উটের হায়াম রোগ নামক কোনো রোগের কথা কিংবা সেটা থেকে নিরাময় পেতে জ্যান্ত সাপ খাওয়ানোর কোনো কথা পবিত্র কোরআন শরীফে বলা হয় নি। দ্বিতীয়ত, উট সাধারণত তৃণভোজী প্রাণী, নিজ ইচ্ছায় মূলত তারা খাদ্যাভাব ছাড়া সাপ খায় না। তৃতীয়ত, উটের হায়াম নামের বা এই উপসর্গের কোনো রোগ নেই এবং জ্যান্ত সাপ খাওয়ালে উটের কোনো রোগ নিরাময় হয় না, বরং উটের ক্ষতি হতে পারে, এমনকিও মৃত্যুও হতে পারে। সবশেষে, সাপ খাওয়ানোর পর উটের চোখ থেকে এক নাগাড়ে পানি পড়ারও কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। উটের চোখের পানি কোনো বিষের বিরুদ্ধে অ্যান্টিভেনম তৈরি করতেও ব্যবহার করা হয় না।

অর্থাৎ, হায়াম রোগ, এই রোগ থেকে নিরাময় করতে জীবিত সাপ খাওয়ানো, উটের চোখের পানির যেকোনো বিষের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা শীর্ষক প্রতিটি দাবি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img