স্কোপোলামিন বিষয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ব্যবহার করে ভুয়া সতর্কবার্তা

মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুই উৎসবের একটি পবিত্র ঈদুল ফিতর ঘনিয়ে আসছে। প্রতি বছরই ঈদকে কেন্দ্র করে ভুল তথ্য বা গুজব অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে প্রচার হয়ে আসতে দেখছে রিউমর স্ক্যানার৷ সম্প্রতি, ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষদের প্রতি পরামর্শ হিসেবে স্কোপোলামিন নামে একটি মাদক সংক্রান্ত বেশ কিছু সতর্কতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি আমরা। 

দীর্ঘ পোস্টগুলোর শুরুটা এমন, “যারা ঈদে বাড়ি ফিরবেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা। 

সম্প্রতি একটা কেমিক্যাল এর ব্যবহার তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে কিছু অসৎ মানুষের হাতে পড়েছে। কেমিক্যাল টার নাম হচ্ছে স্কোপোলামিন। এটা সাধারণত সাড়ে তিন ফিট দূর থেকেও বাতাসের মাধ্যমে একজন মানুষকে আসক্ত করতে পারে। এই কেমিক্যালটা আমাদের ন্যাসাল রুটের মাধ্যমে যখন ভেতরে প্রবেশ করে তখন মানুষের মস্তিষ্কের প্রাইমারি ইনিশিয়াল স্টেজ অফ থিংকিং সহজ বাংলায় বললে মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। যে কারণে মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে সামনে থাকা মানুষের পুতুলে পরিণত হয়। তখন আপনাকে ওই লোক যা কমান্ড দেবে আপনি সেটাই করবেন। এটা থেকে বাঁচতে আমি কিছু বিষয়ের কথা বলছি এগুলো মাথায় রাখবেন।”

এরপর এ বিষয়ে ১৩ টি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। 

এই পরামর্শগুলো বাংলাদেশ পুলিশ দিয়েছে দাবি করে ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

একই পরামর্শ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল দিয়েছে দাবি করে ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

একই পরামর্শ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ দিয়েছে দাবি করে ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

স্কোপোলামিন

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্প্রতি ঈদকে কেন্দ্র করে স্কোপোলামিন বিষয়ে কোনো সতর্কবার্তা দেয়নি বরং, ডাঃ আজাদ নামে এক ব্যক্তি তার রোগীর কেসস্টাডির উপর নির্ভর করে প্রথম গত ২৫ মার্চ এ বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট করার পর পুলিশের বিভিন্ন শাখার নামে উক্ত সতর্কবার্তাগুলো ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে এ সংক্রান্ত দাবিটির মূল সূত্রপাতের খোঁজে ফেসবুকের এডভান্স সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে ২০২২ সালের ২৬ মার্চ কামরুজ্জামান কামরুল নামে এক ব্যক্তির পোস্টে একই তথ্য পাওয়া যায়। তবে এই পোস্টের এডিট হিস্টোরি যাচাই করে দেখা যাচ্ছে, গত ২৬ মার্চ এই পোস্ট এডিট করে আলোচিত তথ্যগুলো যুক্ত করা হয়েছে। এর পূর্বে উক্ত পোস্টের ক্যাপশনে কোনো লেখা ছিল না। 

Screenshot collage: Rumor Scanner 

আমাদের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ২৫ মার্চ দুপুর ১ টা ৫৬ মিনিটে এ সংক্রান্ত প্রথম পোস্ট করেন ডাঃ আজাদ নামে এক ব্যক্তি। তিনি তার পোস্টে পোস্টের সূত্র হিসেবে কোনো বাহিনীর নাম উল্লেখ করেননি। পোস্টের ক্যাপশনে তিনি জনসচেতনতার উদ্দেশ্যে এই পোস্টটি শেয়ার করতে আহ্বান জানান।  

Screenshot: Facebook 

আমরা তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেন, এটা তারই লেখা। পেশায় ডাক্তার জনাব আজাদ আমাদের এই পোস্ট লেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, “আমার এক বন্ধুর ওয়াইফের কাছ থেকে স্বর্ণলঙ্কার নিয়ে গিয়েছিল এই কেমিক্যালটা ব্যবহার করে। তারপর পরবর্তীতে যখন উনি নরমাল হচ্ছিল না তখন আমাকে নক দিয়েছিল।” 

অর্থাৎ, আলোচিত তথ্যগুলো একজন ডাক্তার তার রোগীর কেসস্টাডির উপর নির্ভর করে প্রথম লিখেন ফেসবুকে।

রিউমর স্ক্যানার টিম যাচাই করে দেখেছে, প্রথম দিকে কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম উল্লেখ ছাড়াই পোস্টের তথ্যগুলো কপি পেস্ট হতে থাকে। 

দিন তিনেক পর গত ২৮ মার্চ থেকে পুলিশের একাধিক শাখার নামে এই পোস্টটি প্রচার পেতে শুরু করে। সেদিন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তাও একই পোস্ট তাদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন। 

ভোলার সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেলের (ডিবি) এসআই মো: মুহাইমিনুল ইসলামের নাম ব্যবহার করে এ সংক্রান্ত একাধিক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে। 

মুহাইমিনুল ইসলাম নিজে এমন কোনো পোস্ট করেছেন কিনা তা জানা না গেলেও একইদিন কুষ্টিয়ার সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেলের এএসআই মো: মিন্টু মিয়া নিজেই তার নাম উল্লেখ করে নিজের আইডিতে একই পোস্ট করেন। 

পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের আরো একাধিক কর্মকর্তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং বিভিন্ন থানার ফেসবুক পেজে ২৮ ও ২৯ মার্চ একই পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।

২৮ মার্চ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেলের নাম ব্যবহার করে প্রথম পুলিশের কোনো শাখার নামে একই পোস্ট (, , ) প্রচার হয়। এমনকি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেলের বরাত দিয়ে একই পোস্ট শেয়ার করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তাও। 

২৮ মার্চই প্রথম বাংলাদেশ পুলিশের নাম উল্লেখ করে একই পোস্ট হতে দেখা যায়। সেদিন এমন অন্তত দুইটি পোস্টের খোঁজ মেলে। দেখুন এখানে, এখানে।  

পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল এবং বাংলাদেশ পুলিশ ছাড়াও একই দিন (২৮ মার্চ) পুলিশের স্পেশার ব্রাঞ্চের লোগোর ছবি ব্যবহার করে অন্তত একটি পোস্ট পাওয়া যায় যাতে একই তথ্য উল্লেখ রয়েছে। যদিও এই পোস্টে স্পেশার ব্রাঞ্চের নাম উল্লেখ করা হয়নি।  

তবে পরদিনই (২৯ মার্চ) স্পেশাল ব্রাঞ্চের নাম উল্লেখ করে একাধিক পোস্ট (, ) পাওয়া যায় ফেসবুকে। এর মধ্যে সম্ভাব্য প্রথম পোস্ট করা হয় সেদিন ভোরে আবদুল মনির নাবিল নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে।    

এরপরই স্পেশাল ব্রাঞ্চের নাম উল্লেখ করে এই পোস্ট প্রচার হতে থাকে। আমরা এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ পুলিশ সুপার মাসরুফ হোসেনের সাথে কথা বলেছিলাম। তিনি জানিয়েছেন, স্পেশাল ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে এমন কোনো সতর্কবার্তা দেওয়া হয়নি। 

মূলত, ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষদের প্রতি পরামর্শ হিসেবে স্কোপোলামিন নামে একটি মাদক সংক্রান্ত বেশ কিছু সতর্কতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সংক্রান্ত কতিপয় পোস্টে এই পরামর্শগুলো বাংলাদেশ পুলিশ দিয়েছে, কিছু পোস্টে পরামর্শগুলো পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল এবং কিছু পোস্টে একই পরামর্শ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ দিয়েছে শীর্ষক দাবি করা হচ্ছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্প্রতি ঈদকে কেন্দ্র করে স্কোপোলামিন বিষয়ে কোনো সতর্কবার্তা দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে, ডাঃ আজাদ নামে এক ব্যক্তি তার রোগীর কেসস্টাডির উপর নির্ভর করে প্রথম গত গত ২৫ মার্চ এ বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন যাতে তিনি কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম উল্লেখ করেননি। পরবর্তীতে পুলিশের বিভিন্ন শাখার নামে উক্ত সতর্কবার্তাগুলো প্রচারিত হয়েছে। 

সুতরাং, আসন্ন ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে স্কোপোলামিন মাদক বিষয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ব্যবহার করে একটি সতর্কবার্তা ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

  • ডাঃ আজাদ: Facebook Post
  • Statement from Mashroof Hossain 
  • Rumor Scanner’s own investigation 

আরও পড়ুন

spot_img