প্রগতি স্কুল গণশিক্ষা প্রকল্পের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলো ভুয়া

প্রগতি স্কুল গণশিক্ষা প্রকল্প-এ নিয়োগ শিরোনামে কিছু চাকরির বিজ্ঞপ্তি গত বছর দুয়েক ধরে ইন্টারনেটে  প্রচারিত হয়ে আসছে। এই চাকরির বিজ্ঞপ্তিগুলো প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে চাকরির প্রস্তুতি ফেসবুক গ্রুপগুলো। এছাড়াও বিডিজবসেও তাদের নিয়োগের বিজ্ঞাপন প্রচার হতে দেখা যায়। গেল বছরের সেপ্টেম্বরে ফেসবুকে প্রচারিত প্রগতি স্কুল গণশিক্ষা প্রকল্পের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত সর্ববৃহৎ আত্মনির্ভর বেসরকারী স্থায়ী গণশিক্ষা প্রকল্প (প্রগতি স্কুল গণ শিক্ষা প্রকল্প)। যার সেবার আওতায় রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণ শিক্ষা কার্যক্রম। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিশ্ব বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে ২০০৬ সালে প্রগতি স্কুল (গণ শিক্ষা প্রকল্প) বিশ্বের ০৮তম শিক্ষা সেবা দান কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মর্যাদা লাভ করে।”

গণশিক্ষা প্রকল্পের নিয়োগ

অপরদিকে, গেল অক্টোবরে প্রচারিত আরেক বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “বেসরকারী শিক্ষা সংস্থা প্রগতি স্কুল ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশের দুস্থ, গরিব, এতিম, অসহায় ও পথশিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিচ্ছে। বিশ্বের মোট ০৭টি দেশে গণশিক্ষা প্রকল্প প্রগতি স্কুল শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করে। বাংলাদেশ সরকারের “শিক্ষা অধিদপ্তর” কর্তৃক অনুমতি সাপেক্ষে দাতা সংস্থা “আল-মাকতুম ফাউন্ডেশন, ১১৮ আল মানখুল রোড়, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত” এর সহায়তায় গণশিক্ষা প্রকল্প প্রগতি স্কুল বাংলাদেশের সকল জেলা, থানা, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করবে। উক্ত প্রকল্পে কাজ করতে আগ্রহী ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের নিম্নলিখিত পদসমূহে আবেদন করার জন্য আহ্বান করা হচ্ছে।”

এ বিজ্ঞপ্তি দুইটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বিজ্ঞপ্তি দুইটিতে দুটি ভিন্ন অফিস লোকেশন দেওয়া হয়েছে। ইমেইল এড্রেসেও কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করা হয়েছে। 

২০২৩ সালে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পোস্ট এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

২০২২ সালে প্রচারিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কিছু পোস্ট এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রগতি স্কুল গণশিক্ষা প্রকল্পে নিয়োগ শীর্ষক প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিগুলো ভুয়া। প্রকৃতপক্ষে কথিত এ প্রগতি স্কুলের বাস্তবিক কোনো অস্ত্বিত্ব নেই। ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচারের মাধ্যমে চাকরি দেওয়ার নাম করে চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য। 

বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে রিউমর স্ক্যানার প্রগতি স্কুল গণশিক্ষার একাধিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পর্যবেক্ষণ করে সেখানে অসংখ্য বানান, ভাষা ও বাক্যগত অসঙ্গতি এবং বিরামচিহ্নের ব্যবহারজনিত ভুল দেখতে পায়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেই এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নানান অসঙ্গতি দেখা যায়। 

বিশাল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, তবে নেই কোনো অফিস বা স্কুল

কথিত প্রগতি স্কুলের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলোতে দেখা যায় তারা বিশাল জনবল নিয়োগের কথা বলে। তাদের চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে পদের সংখ্যা থাকে অনেক অনেক বেশি। থানা শিক্ষা অফিসার, ইউনিট অফিসার, ইউনিয়ন শিক্ষা অফিসার, শিক্ষক ও অফিস সহকারী সহ বিভিন্ন পদে নিয়োগের বিশাল সংখ্যা তারা উল্লেখ করে থাকে। কথিত এ স্কুলের ২০২২ সালের ২৪ জুনের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পদের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৭৫৩০ জন, ২০২৩ সালের মে মাসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পদের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৭৫০ জন, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের আরেক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও পদ সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৭৫০ জন। লোভনীয় বেতন ও বিশাল সংখ্যায় নিয়োগের কথা বলে মূলত তারা চাকরি প্রার্থীদের আবেদন করতে প্রলুব্ধ করে। আবেদন করার পর আবেদনকারী প্রত্যেককেই নিয়োগের কথা বলে অগ্রিম টাকা চাওয়া হয়। ইউনিয়ন পর্যায় অব্দি বিশাল নিয়োগ দেওয়ার কথা বললেও আদতে কথিত এ স্কুলের কোথাও কোনো স্কুল বা অফিস নেই। অনুসন্ধানে তাদের কোনো স্কুলের সন্ধান মেলেনি– পুরোটাই যেন কাল্পনিক!

কথিত প্রগতি স্কুল তাদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে লিখেছে– “বাংলাদেশের সকল জেলা, থানা, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে সকল জেলা/থানা/ইউনিয়নের প্রকৃত পুরুষ/মহিলাগনের নিকট থেকে ১২ বছর স্থায়ীভাবে মানবতার কল্যাণে কাজ করার নিমিত্তে দরখাস্ত আহবান করা যাচ্ছে। নির্বাচিত সকল প্রার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে এবং প্রশিক্ষণ চলাকালীন ভাতা প্রদান করা হবে। নির্বাচিত সকল প্রার্থীদের কর্মস্থল ও প্রশিক্ষণ নিজ জেলায় রাখা হবে।” 

একে তারা কোথাও বলছে তারা ১৯৭৬ সাল থেকে কার্যক্রম চালাচ্ছে, বাংলাদেশসহ ২৬টি দেশে তাদের কার্যক্রম রয়েছে, তারা ২০০৬ সালে টাইম ম্যাগাজিনেও জায়গা পেয়েছে সহ নানান গল্প। অন্যদিকে আবার তারাই ২০২৩ সালের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলছে– ‘স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্য’ এর কথা! এই কথার দ্বারা বোঝায় তাদের প্রতিষ্ঠিত কোনো স্কুল নেই। আরেক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে তারা পাহাড়ি জেলা সহ কয়েকটি জেলায় স্কুল রয়েছে বলেও উল্লেখ করে, তবে অনুসন্ধানে এমন কোনো স্কুল থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। 

টাইম ম্যাগাজিনের ভুয়া স্বীকৃতি 

প্রগতি স্কুল গণশিক্ষা প্রকল্পের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিশ্ব বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে ২০০৬ সালে প্রগতি স্কুল বিশ্বের ০৮ তম শিক্ষা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। তবে অনুসন্ধানে টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে প্রগতি স্কুল নামের কোন কিছুর ফিচার হওয়ার কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি। সম্পূর্ণ ভুয়া ভাবে তারা টাইম ম্যাগাজিনের গল্প নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে আসছে।

উপরের বিজ্ঞপ্তিতে প্রগতি স্কুল এর লোগোতে দেখা যায় ২০২০ সাল। তবে অন্য আরেক লোগোতে দেখা যায় ২০২২ সাল। তাদের ২০২০ সালের চেয়ে পুরোনো কোনো লোগো পাওয়া যায়নি। তবে একটি বিজ্ঞপ্তিতে ১৯৭৬ সাল থেকে প্রগতি স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার দাবি দেখা গেছে।

বিভিন্ন দেশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ভুয়া দাবি

কথিত প্রগতি স্কুলের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলোতে দেখা গেছে বাংলাদেশ ছাড়াও তারা বিভিন্ন দেশে তাদের গণশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের বিভিন্ন সময়ের বেশ কয়েকটি বিজ্ঞপ্তি পর্যবেক্ষণ করে তথ্যের গড়মিল ও অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। যেমন ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের একটি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয় বিশ্বের মোট ৭টি দেশে প্রগতি স্কুল গণশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বলা হয়– “বিশ্বের মোট ০৭টি দেশে গণশিক্ষা প্রকল্প প্রগতি স্কুল শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করে। বাংলাদেশ সরকারের “শিক্ষা অধিদপ্তর” কর্তৃক অনুমতি সাপেক্ষে দাতা সংস্থা “আল-মাকতুম ফাউন্ডেশন, ১১৮ আল মানখুল রোড়, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত” এর সহায়তায় গণশিক্ষা প্রকল্প প্রগতি স্কুল বাংলাদেশের সকল জেলা, থানা, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করবে।”

আবার ২০২২ সালের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় বর্তমানে ২৪তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমতি সাপেক্ষে বাংলাদেশে তারা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, “বর্তমানে ২৪তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের “শিক্ষা অধিদপ্তর” কর্তৃক অনুমতি সাপেক্ষে দাতা সংস্থা “শিশু কল্যাণ ট্রাষ্ট- দুবাই ও প্রগতি স্কুল (গণ শিক্ষা প্রকল্প) ২২৪/বি শিল্প নগরী তেজগাঁও, ঢাকা-১২১৫ এর যৌথ উদ্যোগে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে কাজ করে আসছে।”

একই বিষয় উল্লেখ করতে গিয়ে ২০২৩ সালের মে মাসে বলা হয়েছে ২৬ তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে তারা এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, “প্রগতি স্কুল (গণশিক্ষা প্রকল্প) সাউথ কুরিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্থান, কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে ও লাইবেরিয়াসহ বিশ্বের ২৫টি দেশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বর্তমানে ২৬তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের “শিক্ষা অধিদপ্তর” কর্তৃক অনুমতি সাপেক্ষে দাতা সংস্থা তারাহুম চ্যারিটি ফাউন্ডেশন, দুবাই ও প্রগতি স্কুলগণ শিক্ষা প্রকল্প হাউজ – ২২৪.বি শিল্পনগরী এলাকা তেজগাও, ঢাকা- এর যৌথ উদ্যোগে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে কাজ করে আসছে প্রগতি স্কুল (গণশিক্ষা প্রকল্প) কার্যক্রম টি দুস্থ, গরিব, এতিম ও অসহায় শিশুদের মাঝে স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার আলো পৌছে দেবার লক্ষ্যে এবং নিরক্ষতামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যায়ে কাজ করে আসছে।”

এখান থেকে বেশ কয়েকটি বড় অসঙ্গতি পাওয়া যায়– 

এক. শিক্ষা অধিদপ্তর নামে একটি দপ্তরের অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবি করা হয়। তবে এ নামে বাংলাদেশে নির্দিষ্ট করে কোনো অধিদপ্তর নেই। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থাকলেও কেবল ‘শিক্ষা অধিদপ্তর’ নামে কোনো অধিদপ্তর নেই। 

দুই. কথিত প্রগতি স্কুল তাদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন সময়ে দুবাই ভিত্তিক কথিত কিছু দাতা সংস্থার নাম উল্লেখ করতে দেখা যায়। যেমন উপরের তিনটি বিজ্ঞপ্তিতে তারা দাতা সংস্থা আল-মাকতুম ফাউন্ডেশন, দুবাই, শিশু কল্যাণ ট্রাষ্ট, দুবাই এবং দাতা সংস্থা তারাহুম চ্যারিটি ফাউন্ডেশন, দুবাই নামের তিনটি সংস্থার নাম উল্লেখ করেছে। 

তিন. একটি বিজ্ঞপ্তিতে তারা ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রগতি স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমের কথা বললেও তারা অন্তত তিনটি বিজ্ঞপ্তিতে ২৩তম দেশ হিসেবে, ২৪তম দেশ হিসেবে এবং ২৬ তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কথা বলেছে। অর্থাৎ, প্রগতি স্কুল বাংলাদেশের কথিত শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করার কথা বলে পরবর্তীতে বাইরের বিভিন্ন দেশে আগে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর এ প্রকল্প বাংলাদেশে এসেছে বলে বুঝিয়েছে। ২০২৩ সালের একটি বিজ্ঞপ্তিতে এমন কি ৭ দেশের কথাও উল্লেখ রয়েছে। 

প্রগতি স্কুল নামে ভিন্ন কেনো দেশে কোনো স্কুল আছে কিনা তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভারতে প্রগতি স্কুল নামের একটি স্কুল খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৬৯ সালে জনাব এম. পি. জৈন প্রগতি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়ের সকল তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে রয়েছে। বাংলাদেশের কথিত প্রগতি স্কুলের সাথে ভারতের গুজরাটের এই প্রগতি স্কুলের যোগসূত্র অনুসন্ধান করে এ দুটির মধ্যে কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। উপরন্তু, দেখা গেছে ভারতের প্রগতি স্কুলের লোগো নকল করে কথিত প্রগতি স্কুল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির একটি বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছে।

Logo Comparison by Rumor Scanner 

বিভিন্ন চাকরির গ্রুপে ভুয়া ফেসবুক আইডি দিয়ে প্রচার করা হয় বিজ্ঞাপন 

অনুসন্ধান দেখা গেছে প্রগতি স্কুল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলো প্রচারের জন্য মূলত ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন চাকরি প্রস্তুতি ভিত্তিক ফেসবুক গ্রুপ। চাকরির ফেসবুক গ্রুপগুলোতে লোভনীয় বেতনের বিশাল এ নিয়োগ বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো বিভিন্ন ভুয়া ফেসবুক আইডির মাধ্যমে। প্রগতি স্কুল, প্রগতি স্কুল গণশিক্ষা প্রজেক্ট, প্রগতি স্কুল বাংলাদেশ,  Pragati School নামের ফেসবুক আইডিসহ আরও ভিন্ন ভিন্ন ফেসবুক আইডি থেকে গ্রুপগুলোতে পোস্ট করা হতো। তাদের নেই কোনো অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ। ১৯৭৬ সাল থেকে বিশ্বের ২৬ দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা টাইম ম্যাগাজিনে ফিচার হওয়া প্রতিষ্ঠানের অফিশিয়াল কোনো ফেসবুক পেজ কিংবা সোস্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নেই– ভাবা যায়! আরেকটা মজার ব্যাপার হলো ২০২২ সালের পূর্বে কথিত স্কুল সম্পর্কে ফেসবুকে কোনো তথ্য বা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পাওয়া যায়না। ২০২২ ও ২০২৩ সালেই কেবল এ কথিত স্কুলের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলো পাওয়া যায়।

Screenshot: Pragati School FB accounts

এছাড়াও, www.pragatischoolbd.net এবং https://pragatischoolbd.com/ নামের দুটি ওয়েবসাইটেও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি তারা প্রচার করতো। বর্তমানে ওয়েবসাইট দুটি এভাইলেবল নেই। ওয়েবসাইট দুটিতে প্রবেশ করতে গেলে ডোমেইন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে প্রদর্শিত হয়। এছাড়াও, কথিত এ প্রতিষ্ঠান বিডিজবসেও তাদের চাকরির বিজ্ঞপ্তি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচার করতো। ইউনিসেফ সংস্থা নামের একটি ভুয়া আইডি থেকেও প্রগতি স্কুলের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে প্রচার করা হয়। ওই একই পেজে ইউনিসেফ স্বাস্থ্য প্রকল্পে নিয়োগ নামের একটি ভুয়া চাকরির বিজ্ঞপ্তিও প্রচার করতে দেখা গেছে, যা নিয়ে ইতিপূর্বেই “ইউনিসেফের স্বাস্থ্য প্রকল্পে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি ভুয়া” শিরোনামে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছিল রিউমর স্ক্যানার। 

Screenshot: Facebook post

কথিত প্রগতি স্কুলে আবেদনকারী কিছু ব্যক্তির অভিজ্ঞতা 

রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধানে অসংখ্য চাকরি প্রার্থীর মন্তব্য দেখেছে যারা কথিত এ প্রগতি স্কুলে আবেদন করে প্রতারিত হয়েছে। তেমন কয়েকটি মন্তব্য থাকছে এ পর্বে।

প্রগতি স্কুলের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির একটি পোস্টে Mahmudul Hasan Akash নামের এক ব্যাক্তির মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে তিনি প্রগতি স্কুলের অফিস খুঁজতে গিয়ে তার কোনো অস্ত্বিত্ব পাননি। মন্তব্যে তিনি লিখেছেন,

 “ঢাকা থাকার সুবাদে আজকে তাদের অফিস ভিজিট করতে গিয়েছিলাম। যখন তারা বুঝতে পারে যে আমি ঢাকায় থাকি এবং তাদের অফিসের সামনে আমাকে যেতে বলে তাতে অফিস থেকে প্রথমে বলে ভূমি অফিসের সামনে তো আমি ভূমি অফিসের সামনে যাইয়া তাদের ফোন দিই। ও তারা মনে হয় তখন বুঝে গেছে যে আমি আসলেই ভূমি অফিস চিনি তো তারপরে ভূমি অফিসের সামনে যেয়ে ফোন দেওয়ার পরে তারা ফোন রিসিভ করেনা চার-পাঁচবার পর ফোন রিসিভ করার পরে তারা বলে আগোরার সামনে যেতে কিন্তু  সাত রাস্তার মাথায় আগোরার কোন সপ নেই। তারপরে বললাম যে ভাই আমি ব্যস্ত মানুষ  আইসা নিয়া যান তাহলে ভালো হয় তো তারা বলে আচ্ছা ঠিক আছে আসতেছি ওয়েট করেন। এরকম ওয়েট করতে করতে প্রায় ১৫ ২০ মিনিট হয়ে যাওয়ার পর ফোন দিচ্ছি তো তারা আবার বলল রাবেয়া মেনশন এর সামনে যে। তো তেজগঞ্জ এরিয়াতে আপনার রাবেয়া মেনশন নামেও কোনো বাড়ি নেই। বিজ্ঞাপনে এমন অ্যাড্রেস দিছে যে আপনি এই এড্রেসে কোন ঠিকানাই খুঁজে পাবেন না।মানে এক কথায় পুরা ভুয়া পোস্ট তো কেউ অগ্রিম টাকা দিবেন না আর যারা দিছেন তো দিছেন ই।”

প্রগতি স্কুলের অপর আরেকটি নিয়োগ পোস্টের কমেন্টে Masud Saodagar নামের এক ব্যক্তি লিখেছেন, 

সালারা ভুয়া, চিটার, বাটপার, কেউ এদের এখানে এপ্লাই করিবেন না। এরা আপনাদের কল দিবো বলবে ১ ঘন্টার মধ্যে ১৭৫০/১৯৫০/২২৫০ ইত্যাদি পরিমান টাকা পাঠান, নয়লে আপনার এপ্লাই বাতিল হবে। সারাদেশে এদের কোন অফিস নাই। এদের থেকে সাবধান হন। কোন প্রকার টাকা দিবেন না।”

ডিসেম্বর-২০২২ এর আরেকটি নিয়োগ পোস্টে তিনজন ব্যক্তির টাকা পাঠিয়ে কথিত প্রগতি স্কুল এর কাছে প্রতারিত হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন। Saiful Alam নামের এক ব্যক্তি লিখেছেন, 

 “সাবধান, প্রতারক,আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। শুধু টাকা নিবে মোবাইল ব্যাংকিং এর মধ্যেমে। যে সার্কুলার ঐ অফিস এটা না। যারা আবেদন করবেন  ঐ অফিস এর অনলাইনে চেক করে তারপর সিভি পাঠাবেন। প্রতারক থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখবেন।”

Md Dedar Mazumdar নামে এক ব্যক্তি লিখেছেন, “সাবধান, প্রতারক,আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আর যোগাযোগ করে না।” 

Md Dedar Mazumder এর কমেন্টের রিপ্লাইয়ে Shakila Azad Shakila নামের আরেকজন মন্তব্য করেছেন,  “সঠিক বলেছেন ভাই। আমার কাছ থেকেও টাকা নিয়ে আর খবর নাই।”

অপর আরেক পোস্টে উম্মে আইমান নামের একজন লিখেছেন, “এটা ফেক। কেউ এপ্লাই কইরেন না….তাদের নাকি স্কুলটা এখনও স্থাপনই হয় নাই.. তারা লোক নিয়োগ নিচ্ছে তারপর স্কুলটা করবে। সব টাকা নেওয়ার ধান্দা। ”

এছাড়াও আরও অসংখ্য মন্তব্য আমরা দেখেছি যেখানে কথিত এ স্কুলে আবেদন করে আগে টাকা পাঠিয়ে লোকজন প্রতারিত হওয়ার কথা জানিয়েছে। এ স্কুলের কোনো অস্তিত্ব না থাকার কথা জানিয়েছে। উপরের মন্তব্যগুলোসহ আরও এমন মন্তব্যের স্ক্রিনশটগুলো থাকছে এখানে

কথিত এ প্রগতি স্কুল গণশিক্ষা প্রকল্প কিংবা এর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আরও অনেক অসঙ্গতি আমরা দেখতে পেয়েছি। ইতিমধ্যে যেগুলো উল্লেখ করা হয়েছে তার ভিত্তিতেই বলা যায়– প্রগতি স্কুল নামের কথিত এ স্কুলের বাস্তবিক কোনো অস্তিত্ব নেই, পুরোটাই কাল্পনিক।

ইতিপূর্বে,  আনন্দ স্কুল গণশিক্ষা প্রকল্প নামে একটি চক্র ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে একইভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। কথিত ওই আনন্দ স্কুলের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিকে ভুয়া চিহ্নিত করে ফ্যাক্টচেক করেছিল রিউমর স্ক্যানার। 

সুতরাং, প্রগতি স্কুল গণশিক্ষা প্রকল্পের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলো সম্পূর্ণ ভুয়া। 

তথ্যসূত্র

  •  Rumor Scanner Investigation 

আরও পড়ুন

spot_img