ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে কোটা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মিথ্যা অভিযোগ

গত জুলাই মাসের শুরুতে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিস্তৃত হয়। গত ২ আগস্ট এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘সারা দেশে গণহত্যা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এবং শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি ঘোষণা করে।

সেদিন আন্দোলনে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন দাবি করে Sanjana Era Farhana নামের একটি ফেসবুক অ্যকাউন্টে একটি পোস্ট প্রচার করা হয়। 

যৌন হয়রানি

উক্ত পোস্টে দাবি করা হয়, “…শিক্ষার্থী ভাই বোনদের আহবানে প্রোগ্রামে গিয়ে আজকে নিজের ইজ্জতটা হারাতে হারাতে বেচে ফিরলাম। আমি কোনো রাজনীতি দল সাপোর্ট করিনা।ফেইসবুকে ছবি আর ভিডিও দেখলে চোখ দিয়ে পানি চলে আসে তাই আজকে বন্ধের দিনে ভাবলাম নিজে একটু স্বশরীরে গিয়ে ওদের পাশে দাড়ায়। আমার বাড়ি কক্সবাজার,ফ্রিপোটে থাকি ওখানে জব করি। বৃষ্টি হচ্ছিল আর গাড়িও অনেক কম ছিলো তারপরেও দোয়া দরুদ পড়ে বের হলাম। বারিক বিল্ডিং হয়ে মার্কেটে গিয়ে পৌছালাম।অনেকক্ষণ ছিলাম ওখানে,গলা ফাটিয়ে স্লোগানও দিলাম সবার সাথে মিলিয়ে। ছাতা ছিলো তারপরেও বৃষ্টিতে কাপড় ভিজে গায়ের সাথে লেগে যাচ্ছিল আমি বারবার তা ঠিক করতেছিলাম। ভীড়ের ভেতরে হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমার বুক ও বুকের নিচে কয়েকটা হাত ক্রমাগত উঠা নামা করছে। এক মুহূর্তের জন্য আমার পুরো শরীর জমে পাথর হয়ে গিয়েছিলো……”

পরবর্তীতে উক্ত অ্যকাউন্টর পোস্টের ভিত্তিতে কোটা আন্দোলনে গিয়ে এক নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন দাবিটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, Sanjana Era Farhana নামের এক নারী কোটা আন্দোলনে গিয়ে আন্দোলনকারী কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সত্য নয় বরং একটি ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে করা মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে এই দাবিটি প্রচারিত হয়েছে।

বিস্তারিত অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত আইডিতে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে গত ০২ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে প্রথমে একটি পোস্ট করা হয়। উক্ত পোস্টে আন্দোলনের একটি প্রতীকী ছবি যুক্ত ছিল। পরবর্তীতে প্রায় এক ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৭টা ২৪ মিনিটে একই পোস্ট পুনরায় করা হয়। তবে এবার পোস্টটিতে একটি ভিডিও ব্যবহার করা হয়, যেখানে একজন ব্যক্তিকে এক নারীর গলা চেপে ধরতে দেখা যায়।

উক্ত ভিডিওটির সত্যতা অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে সেদিন বার্তা বাজারে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। জানা যায়, উক্ত ভিডিওটি ঢাকার উত্তরার। গত ২ আগস্ট রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে মাইলস্টোন কলেজের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় মেহেদি হাসান কাউসার নামের এক ছাত্রলীগ নেতা আন্দোলনকারী মেয়ে শিক্ষার্থীর গলা চেপে ধরেন।

Screenshot: Barta Bazar. 

পরবর্তী অনুসন্ধানে Mumu Jabin নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গলা চেপে ধরার উক্ত ভিডিওটি পোস্ট করে জানানো হয়, ভিডিওতে থাকা নারীটি তিনি। ২ আগস্ট উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে তার সাথে এই ঘটনাটি ঘটে, এক ছাত্রলীগ নেতা তার গলা চেপে ধরে। তিনি আরও জানান, মুমু জাবিন নামে উক্ত আইডি বাদে তার অন্য কোনো আইডি নেই। তার এই ভিডিও দিয়ে একটি ভুয়া আইডি থেকে ভুয়া তথ্য প্রদান পূর্বক মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।

Screenshot: Facebook. 

অন্যদিকে Sanjana Era Farhana নামের আলোচ্য ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সম্পূর্ণ পোস্ট পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তিনি চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন এবং চট্টগ্রামের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন বলে দাবি করেছেন।

অর্থাৎ, রাজধানীর উত্তরার ভিডিও ব্যবহার করে চট্টগ্রামের আন্দোলনে গিয়ে যৌন হয়রানির দাবি করা হচ্ছে সানজানা নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে।

পরবর্তীতে রিউমর স্ক্যানার টিম Sanjana Era Farhana নামের আলোচ্য ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি পর্যালোচনা করে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ০২ আগস্ট যৌন হয়রানির অভিযোগ করে করা পোস্টটির আগে কেবল ২০১৮ সালে একটি কভার ফটো আপলোড করা হয়েছিল অ্যাকাউন্টটি থেকে। আলোচ্য পোস্টের আগে এই অ্যাকাউন্ট থেকে কভার ফটো বাদে কোনো পাবলিক পোস্টই করা হয়নি। ফেসবুক অ্যাকাউন্টটির ফ্রেন্ড লিস্টে কেবল ৫৯টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশই ভুয়া আইডি বলে প্রতীয়মান হয়। এছাড়া, ফেসবুক আইডিতে কোনো ব্যক্তির ছবিও নেই। যার ফলে এটি একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট বলে প্রতীয়মান হয়।

Screenshot: Facebook. 

এছাড়া কোটা আন্দোলনের গিয়ে নারীর যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আলোচ্য দাবিটি নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে পাওয়া যায়নি। সাধারণত, এ ধরনের ঘটনার পর বিভিন্ন মূলধারার গণমাধ্যমে ভুক্তভোগী নারীর বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, কিন্তু এই ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি।

মূলত, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরই মধ্যে Sanjana Era Farhana নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে গত ২ আগস্ট চট্টগ্রামের আন্দোলনে গিয়ে আন্দোলনকারী কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। দাবির সাথে একজন পুরুষ কর্তৃক এক নারীর গলা চেপে ধরার ভিডিও যুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত আইডিতে প্রচারিত পোস্টের ভিত্তিতে আন্দোলনে গিয়ে নারী আন্দোলনকারী কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন দাবিটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, নারীর গলা চেপে ধরার ভিডিওটি রাজধানীর উত্তরার। ১১ নম্বর সেক্টরে আন্দোলনরত অবস্থায় মুমু জাবিন নামের এক নারীর গলা চেপে ধরে ছাত্রলীগ নেতা মেহেদি হাসান কাউসার। এই ভিডিওটি ব্যবহার করে সানজানা ইরা ফারহানা নামের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আন্দোলনে যৌন হয়রানির দাবি করা হয়। রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে উক্ত ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি ভুয়া বলে প্রতীয়মান হয়।

সুতরাং, Sanjana Era Farhana নামের এক নারী কোটা আন্দোলনে গিয়ে আন্দোলনকারী কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img