বাংলাদেশে শান্তিসেনা মোতায়েনের ভুয়া তথ্য ভারতের গণমাধ্যমে

সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যম আজতক বাংলা কর্তৃক প্রকাশিত ভিডিও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, “ঠিক হল শান্তি সেনা ঢুকছে বাংলাদেশে”।

উক্ত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো হোক চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এবার বাংলাদেশ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রসংঘ/জাতিসংঘ এবং জল্পনা রয়েছে বাংলাদেশে এখন আর শান্তি সেনা ঢুকতে আর কোনো বাঁধা রইলো না। বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর প্রবেশ এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। এছাড়াও উক্ত ভিডিও প্রতিবেদনে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে কী কী তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে সে বিষয়েও বলা হয়।

উক্ত দাবিতে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন আজতক বাংলা (ইউটিউব)।

আজতক বাংলা কর্তৃক প্রকাশিত উক্ত প্রতিবেদনটি পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করেও দাবি করা হয়, “ঠিক হল শান্তি সেনা ঢুকছে বাংলাদেশে, রিপোর্ট মোদিকে দিল জাতিসংঘ”।

ফেসবুকে প্রচারিত এরূপ পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, অতিশীঘ্রই বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে কোনোরকম নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত আজতক বাংলার প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, এতে মূলত সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের বিষয়ে বলা হয়েছে, যেখানে গত জুলাই-আগস্টের বিষয়ে বিস্তর বর্ণনা রয়েছে। এছাড়াও দাবি করা হয়, জাতিসংঘের উক্ত প্রতিবেদনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়েও উল্লেখ রয়েছে এবং এসবেরই প্রেক্ষিতে দাবি করা হয়েছে, অতিশীঘ্রই বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী ঢুকতে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে গত ১২ ফেব্রুয়ারিতে “OHCHR Fact-Finding Report: Human Rights Violations and Abuses related to the Protests of July and August 2024 in Bangladesh” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমন্ত্রণে, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (OHCHR) ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত দেশব্যাপী চলমান বিক্ষোভ ও তার পরবর্তী সময়ে সংঘটিত অভিযোগকৃত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের বিষয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত পরিচালনা করে।  

সংগৃহীত সমস্ত তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ ও স্বাধীন মূল্যায়নের ভিত্তিতে, ওএইচসিএইচআর মনে করে যে সাবেক সরকার এবং এর নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত সহিংস গোষ্ঠীগুলোর সহায়তায়, পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে লিপ্ত ছিল। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যা, সহিংস বলপ্রয়োগের কারণে হাজারো বিক্ষোভকারীর গুরুতর আহত হওয়া, ব্যাপক মাত্রায় নির্বিচার গ্রেপ্তার ও আটককরণ, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ। ওএইচসিএইচআর –

এর মতে, এই নিপীড়নমূলক কার্যক্রম রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, সমন্বয়ের মাধ্যমে ও প্রত্যক্ষ নির্দেশে সংঘটিত হয়েছে, যার লক্ষ্য ছিল বিক্ষোভ ও ভিন্নমত দমন করা।  

এই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকেও উদ্বেগের বিষয়। তাই, অতিরিক্ত অপরাধ তদন্ত প্রয়োজন, যাতে নির্ধারণ করা যায়—এই ঘটনাগুলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে নির্যাতন, এবং দেশীয় আইনের আওতায় গুরুতর অপরাধের অন্তর্ভুক্ত কিনা।”

প্রতিবেদনটিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশে অতি শীঘ্রই মোতায়েন করা হবে জানিয়ে কোনো তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি, প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করেও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর সম্ভাবনারও কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে উক্ত প্রতিবেদনটির একটি প্রেস রিলিজ বাংলা ভাষায়ও প্রকাশ করা হয়েছে এবং আলোচিত দাবিটি প্রচারের পর প্রচারিত উক্ত প্রতিবেদনটির প্রায় দেড় মিনিট পরবর্তী সময়ে মূলত উক্ত প্রেস রিলিজটির তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে, প্রেস রিলিজটিতেও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশে পাঠানোর বিষয়ে কোনো উল্লেখ বা ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।

পাশাপাশি, প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলেও অতি শীঘ্রই বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর বিষয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

কোনো একটি দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনুসন্ধান করলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বিষয়ক ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে ‘Deploying Peacekeepers’ নামের একটি নিবন্ধ পাওয়া যায়৷ উক্ত নিবন্ধটি থেকে জানা যায়, কোনো একটি দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়নে নানা ধাপ পেরোতে হয় জাতিসংঘের। যেমন: ১. প্রাথমিক পরামর্শ: যখন কোনো সংঘাত শুরু হয়, তীব্রতর হয় বা সমাধানের পথে এগোয়, তখন জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে। এতে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, সম্ভাব্য হোস্ট দেশ, সদস্য রাষ্ট্র, আঞ্চলিক সংস্থা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদাররা জড়িত থাকে৷ এই পর্যায়ে, জাতিসংঘ মহাসচিব একটি কৌশলগত মূল্যায়ন চালানোর নির্দেশ দিতে পারেন।  

২. প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন মিশন: নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনুকূল হলে, জাতিসংঘ একটি প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন দল পাঠায়। এই দল সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের নিরাপত্তা, রাজনৈতিক, সামরিক, মানবিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে। এর সুপারিশের ভিত্তিতে মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন, যেখানে সম্ভাব্য শান্তিরক্ষা মিশনের কাঠামো ও আনুমানিক খরচ উল্লেখ থাকে।  

৩. নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত: নিরাপত্তা পরিষদ যদি মনে করে যে শান্তিরক্ষা মিশন সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ, তবে এটি একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব (রেজ্যুলেশন) গ্রহণ করে। এতে মিশনের দায়িত্ব, আকার এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। বাজেট এবং সম্পদের অনুমোদন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের উপর নির্ভর করে।  

৪. উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়োগ: মহাসচিব সাধারণত মিশনের প্রধান নিয়োগ করেন, যিনি তার বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন। এছাড়াও, বাহিনী কমান্ডার, পুলিশ কমিশনার এবং অন্যান্য বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়।  

৫. পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি: শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি সমন্বিত কর্মদল গঠন করা হয়, যেখানে জাতিসংঘের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থাগুলো অংশগ্রহণ করে। এতে রাজনৈতিক, সামরিক, কার্যক্রম এবং লজিস্টিক পরিকল্পনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।  

৬. মোতায়েন: মিশনের সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য প্রথমে একটি অগ্রবর্তী দল পাঠানো হয়। পর্যায়ক্রমে মিশনের সমস্ত উপাদান ও অঞ্চলসমূহে বাহিনী মোতায়েন করা হয়।  জাতিসংঘের নিজস্ব সেনাবাহিনী নেই, তাই সদস্য রাষ্ট্রগুলো থেকে সৈন্য ও পুলিশ সরবরাহ করতে হয়।  

৭. নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিবেদন ও পর্যালোচনা: মহাসচিব নিয়মিতভাবে নিরাপত্তা পরিষদে মিশনের কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রদান করেন। নিরাপত্তা পরিষদ মিশনের কার্যকারিতা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা সম্প্রসারণ করে, যতক্ষণ না মিশন শেষ হয় বা বন্ধ হয়ে যায়।

এছাড়া, এ বিষয়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষার ওয়েবসাইটের আরেকটি নিবন্ধ থেকে জানা যায়, জাতিসংঘের সেনা মোতায়েন করতে যথেষ্ট সময় লাগে, এবং জাতিসংঘের কোনো স্থায়ী রিজার্ভ বাহিনী নেই। জাতিসংঘ কেবল তখনই সামরিক বাহিনী মোতায়েন করতে পারে, যখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ বিষয়ে রেজ্যুলেশন অনুমোদন করে। নিরাপত্তা পরিষদ নির্ধারণ করবে কতজন সামরিক সদস্য প্রয়োজন, এবং জাতিসংঘ সদর দফতর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে এই সদস্যদের চিহ্নিত করে মোতায়েন করবে। এতে সময় লাগে, প্রায়শই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার তারিখ থেকে সেনা ও সরঞ্জাম স্থলে পৌঁছাতে ছয় মাসের বেশি সময় লেগে যায়।

বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কোনো রেজ্যুলেশন অনুমোদন করেছে কি না এ বিষয়ে অনুসন্ধানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ওয়েবসাইটে প্রদত্ত সাম্প্রতিক সময়ে গৃহীত রেজ্যুলেশনগুলো পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার। কিন্তু বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে কোনো অনুমোদিত রেজ্যুলেশন পাওয়া যায়নি। শান্তিরক্ষী বাহিনীর বিষয়ে সর্বশেষ গত ৩১ জানুয়ারিতে রেজ্যুলেশন অনুমোদিত হতে দেখা যায়, যেখানে সাইপ্রাসে থাকা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের সময় দীর্ঘায়িত করার বিষয়টি অনুমোদিত হয়।

তাছাড়া, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত প্রতিবেদনটিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদন জানিয়েছে এমনটা বোঝালেও প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের উক্ত প্রতিবেদনটিতে কেবল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয় বরং ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের সব ঘটনারই উল্লেখ ছিল।

সুতরাং, অতিশীঘ্রই বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img