জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছেন ড. ইউনূস। গত ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রতিষ্ঠান ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’–এর একটি আয়োজনে অংশ নেন তিনি। এসময় মঞ্চে তার সঙ্গে তার কয়েকজন সফরসঙ্গী উপস্থিত ছিলেন।
এ আয়োজনের মঞ্চে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং আরো তিনজন ব্যক্তির একই সাথে অবস্থানের কয়েকটি ছবি প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে মঞ্চে দেখা যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বাংলাদেশের ছাত্র বিপ্লবের তিন সমন্বয়ককে। অনুষ্ঠানে বক্তব্যের শেষ দিকে প্রধান উপদেষ্টা তার বিশেষ সহকারী মাহফুজসহ দুই সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি এবং নাঈম আলীকে ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দেন।
উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ দেখুন এটিএন বাংলা (ইউটিউব), একুশে টিভি, বাংলাভিশন, কালবেলা, মানবজমিন, কালের কণ্ঠ, নয়া দিগন্ত, যুগান্তর, দেশ রূপান্তর (ই-পেপার), দৈনিক সংগ্রাম, যায়যায়দিন, দৈনিক আমাদের সময়, আমাদের সময়.কম, মানবকণ্ঠ, প্রতিদিনের বাংলাদেশ (ইউটিউব), ভোরের কাগজ (ইউটিউব), গ্লোবাল টিভি, ডেইলি বাংলাদেশ, দ্য রিপোর্ট লাইভ, দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস, দৈনিক করতোয়া, সংবাদ প্রকাশ, আমার সংবাদ, বাংলাদেশ টুডে, সাউথ এশিয়ান টাইমস বিডি, আজকের দর্পণ, জাস্ট নিউজবিডি, লেটেস্ট বিডি নিউজ, দৈনিক সকালের সময়, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, দৈনিক পূর্বকোণ, সময়ের কণ্ঠস্বর, নিউজ ফ্ল্যাশ৭১, নিউজ নাউ বাংলা, সুরমাভিউ২৪, দেশে বিদেশে, সোনালী নিউজ, এমটিনিউজ২৪, নিউজনাউ২৪, দ্য রাইজিং ক্যাম্পাস, দৈনিক সরোবর, ব্রেকিং নিউজ, ঢাকা জার্নাল, আলোচিত বাংলাদেশ, সময় জার্নাল, সিলেট প্রতিদিন২৪, খবর সংযোগ, প্রবাস টাইম, আপন দেশ, ভিন্ন বার্তা, ঢাকা টুডে, দৈনিক সময়ের সমীকরণ, বাংলাদেশের সময়.কম, নবীন নিউজ এবং দৈনিক মতবাদ।
যুগান্তর এবং কালবেলা এর ই-পেপারে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন এখানে এবং এখানে।
এছাড়া, জাগোনিউজ২৪ এবং দীপ্ত নিউজ উক্ত দাবিতে সংবাদ প্রকাশ করলে পরবর্তীতে তা সংশোধন করে নিয়েছে। উক্ত সংবাদের আর্কাইভ সংস্করণ পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, কিছু সংবাদমাধ্যম মঞ্চে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সাথে নাঈম আলীর উপস্থিতির বিষয়ে কিছু না বললেও সুচিস্মিতা তিথির উপস্থিত থাকার কথা উল্লেখ করেছে। এমন দাবিতে প্রচারিত সংবাদ প্রতিবেদন নিউজ২৪ (ফেসবুক), ইনকিলাব, ইত্তেফাক, ঢাকা পোস্ট, ঢাকা প্রকাশ, অর্থসূচক, পদ্মা টাইমস২৪.কম নিউজ জি২৪, ছাড়পত্র।
তাছাড়া, উক্ত দাবিতে ওপার বাংলার সংবাদমাধ্যমেও সংবাদ প্রচার করা হয়। উক্ত দাবিতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন আনন্দবাজার পত্রিকা।
আনন্দবাজার পত্রিকা এর ই-পেপারে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, নিউইয়র্কে ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’–এর অনুষ্ঠান মঞ্চে আলোচিত ছবিগুলোতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও ইউনূসের বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমের সাথে উপস্থিত দুই ব্যক্তি ইউনূসের সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি ও নাঈম আলী নন। এই দুই ব্যক্তি হলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা তিথী এবং হাইড্রোকো+ এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিন রাজিন। তাছাড়া, সুচিস্মিতা তিথি এবং নাঈম আলীকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক দাবি করা হলেও তারা এই আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন না এবং তারা প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রেও যাননি। তারা দুইজনই বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে ৫৭ সফরসঙ্গী নিয়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক গেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সকল সফরসঙ্গীর পরিচয় জানা না গেলেও গত ০৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জাতিসংঘের তার সাত সফরসঙ্গীর একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। এই সাত প্রতিনিধি হলেন, ড. ইউনূসের মেয়ে দিনা আফরোজ ইউনূস, এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল আলম, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম, প্রধান উপদেষ্টার একান্ত সচিব শাব্বীর আহমদ, বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা তিথি।
অর্থাৎ, সফরসঙ্গীর সাত সদস্যের এই তালিকায় প্রধান উপদেষ্টার দুই সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি কিংবা নাঈম আলীর নাম নেই।
এ বিষয়ে অধিকতর নিশ্চিত হতে রিউমর স্ক্যানার টিম যোগাযোগ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি এবং নাঈম আলীর সাথে। তারা জানান, তাদের কেউই উক্ত সফরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী নন এবং তারা নিউইয়র্কে যাননি। দুজনই ঢাকাতেই অবস্থান করছেন।
মঞ্চে ধারণকৃত প্রচারিত উক্ত ছবিতে তাহলে কারা দৃশ্যমান এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি জানান, মঞ্চে সুচিস্মিতা তিথি দাবিতে যাকে প্রচার করা হচ্ছে, তিনি প্রকৃতপক্ষে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা তিথি এবং নাঈম আলী দাবিতে যাকে প্রচার করা হচ্ছে তিনি হাইড্রোকো+ এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিন রাজিন।
পাশাপাশি সুচিস্মিতা জানান, ‘জাহিন রাজিনকে মঞ্চে দেখা গেলেও তিনি প্রধান উপদেষ্টার অতিথি তালিকার কেউ নন৷ তিনি সিজিআই দলের ভূমিকায় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন৷ প্রচারিত ছবিতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে মঞ্চে দেখা যাওয়া প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীরা হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা মাহফুজ আলম এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা তিথি।’
উল্লেখ্য, মঞ্চে থাকা ব্যক্তিবর্গদের নাম জানিয়ে সুচিস্মিতা তিথি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্টও করেছেন।
অতঃপর মঞ্চে ধারণকৃত ছবিটি পর্যবেক্ষণ করলে উপস্থিত থাকা নারীর সাথে প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথির মুখমণ্ডলের তুলনা করলে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
একইভাবে প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব নাঈম আলী দাবিতে প্রচারিত ব্যক্তির সাথে প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব নাঈম আলীর মুখাকৃতির পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
যা নিশ্চিত করে মঞ্চে উপস্থিত থাকা ব্যক্তি দুইজন সুচিস্মিতা তিথি এবং নাঈম আলী নন।
তাছাড়া, হাইড্রোকো+ এর প্রতিষ্ঠাতা জাহিন রাজিন নিয়ে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে ব্যবহৃত জাহিনের ছবি এবং জাহিনের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে থাকা তার ছবির সাথেও মঞ্চে প্রধান উপদেষ্টার বামে উপস্থিত থাকা ঐ ব্যক্তির মুখমণ্ডলের সাদৃশ্য পাওয়া যায় যা নিশ্চিত করে তৃতীয় ঐ ব্যক্তি নাঈম আলী ছিলেন না বরং জাহিন রাজিন নামের ভিন্ন এক ব্যক্তি ছিলেন।
অনুসন্ধানের এ পর্যায়ে সুচিস্মিতা তিথি এবং নাঈম আলী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন কি না তা যাচাই করে রিউমর স্ক্যানার টিম। সমন্বয়কদের নামের তালিকার অনুসন্ধান করলে গত ০৩ আগস্ট তারিখে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক রিফাত রশিদের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ৪৯ জন সমন্বয়ক এবং ১০৯ জন সহ-সমন্বয়ক সহ ১৫৮ জনের নামের একটি তালিকা পাওয়া যায়। সমন্বয়কদের নামের উক্ত তালিকায় সুচিস্মিতা তিথি বা নাঈম আলী নামের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, উক্ত তালিকায় বলা হয়েছিল, তালিকাটি সম্প্রসারিত হতে পারে। তবে পরবর্তীতে উক্ত তালিকা সম্প্রসারিত হওয়ার বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সমন্বয়কদের উক্ত তালিকায় নাঈম আলী বা সুচিস্মিতা তিথির নাম না পাওয়া যাওয়ার দরুন প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায় তারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সমন্বয়কের ভূমিকায় ছিলেন না।
এ বিষয়েও প্রধান উপদেষ্টার দুই সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি এবং নাঈম আলীর সাথে কথা হয় রিউমর স্ক্যানার টিমের। তারা জানান, তাদের (সুচিস্মিতা তিথি এবং নাঈম আলী) কেউই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সমন্বয়কের ভূমিকায় ছিলেন না।
সুতরাং, ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’–এর উক্ত আয়োজনের মঞ্চে প্রধান উপদেষ্টা, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও ইউনূসের বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমের সাথে প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি ও নাঈম আলীকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে মর্মে প্রচারিত দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Rifat Rashid – Facebook Post
- Shuchismita Tithi – Facebook Post
- Naya Diganta – জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী ৭ জন
- Prothom Alo – পানি ব্যবস্থাপনায় নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন যে বাংলাদেশী তরুণ
- Statement of Shuchismita Tithi, Assistant Press secretary, Chief Adviser, Interim Government
- Statement of Nayem Ali, Assistant Press secretary, Chief Adviser, Interim Government
- Rumor Scanner’s own analysis
হালনাগাদ/ Update
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ : এই প্রতিবেদন প্রকাশ পরবর্তী সময়ে সংবাদমাধ্যমে একই দাবি সম্বলিত আরো প্রতিবেদন আমাদের নজরে আসার প্রেক্ষিতে উক্ত সংবাদ প্রতিবেদনগুলো এই ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে দাবি হিসেবে যুক্ত করা হলো।