ছবিগুলো এ২৩এ আইসবার্গের নয় এবং এর সাথে জড়িয়ে প্রচারিত তথ্যগুলোও সঠিক নয়

সম্প্রতি, বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম আইসবার্গ বিষয়ক কিছু তথ্য এবং এ সংক্রান্ত কোলাজ করা দুইটি ছবিসহ একটি পোস্ট ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছে৷ 

ভাইরাল পোস্টটির শুরুতে বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আইসবার্গের (Ice Berg) বিষয়ে দাবি করা হয়েছে, এটি ৬ হাজার বছর যাবত এক স্থানেই স্থির ছিল। এটি বাংলাদেশের ঢাকার চেয়েও বড় এবং বাংলাদেশের আয়তনের তিন ভাগের এক ভাগ। 

পোস্টে দাবি করা হয়, পৃথিবীর অতিরিক্ত গরমে অ্যান্টার্কটিকা থেকে ছুটে যাওয়ার আগে এখানে প্রায় ৮ রকমের প্রাণি বসবাস করত। ধারনা করা হচ্ছেিল, প্রায় ১০/১৫ হাজার এর চেয়েও বেশি মেরু ভাল্লুক (Polar bear) এবং লাখ এর চেয়েও বেশি পেঙ্গুইন ছিল। 

পোস্টে উল্লিখিত তথ্যগুলোর সূত্র হিসেবে  BBC Global এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। 

আইসবার্গের

আলোচিত দাবিগুলোর বিষয়ে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম আইসবার্গ বিষয়ক যেসব তথ্য এবং এ সংক্রান্ত কোলাজ করা দুইটি ছবি সমেত যে পোস্টটি ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছে সে ছবিগুলো আইসবার্গটির নয় বরং পুরোনো ও ভিন্ন দুইটি আইসবার্গের ছবি ব্যবহার করে বর্তমানে বৃহত্তম আইসবার্গটির এক স্থানে আটকে থাকার সময় এটিতে প্রাণিদের অবস্থান এবং বাংলাদেশের আয়তনের সাথে তুলনা বিষয়ক বেশকিছু ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। 

আলোচিত দাবিটির সূত্রপাত অনুসন্ধানে কিওয়ার্ড সার্চ করে ফেসবুকে গত ১০ ডিসেম্বর রাতে Md Talha নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে এ সংক্রান্ত সম্ভাব্য প্রথম পোস্টটির (আর্কাইভ) খোঁজ মেলে। 

Screenshot : Facebook 

জনাব তালহা তার পোস্টের শুরুতে মেরু ভাল্লুকের সংখ্যা লিখেছেন ৬০/৯০ হাজার। ১৪ ডিসেম্বর পোস্টের ক্যাপশন এডিট করে এই সংখ্যা ১০/১৫ হাজার উল্লেখ করেন। তালহা বিবিসি গ্লোবালকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করলেও এ সংক্রান্ত কোনো লিংক তার পোস্টে দেননি। 

Screenshot : Facebook

পরবর্তীতে পোস্টটি কপির মাধ্যমে ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। 

ভাইরাল পোস্টগুলোতে যে দুইটি আইসবার্গের ছবি রয়েছে সেগুলো যাচাই করে দেখা গেছে, এগুলো ভিন্ন আইসবার্গের পুরোনো ছবি। 

প্রথম ছবিটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এতে আইসবার্গটির নাম উল্লেখ রয়েছে A-76 এবং আকার বলা হয়েছে ৪৩২০ বর্গ কিলোমিটার। রিভার্স ইমেজ সার্চে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের মে মাসে প্রকাশিত একই ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। তখন এটিই ছিল বিশ্বের বৃহত্তম আইসবার্গ। সে সময় এটি কয়েক টুকরায় বিভক্ত হয়ে যায়৷ 

Screenshot: ESA

আইসবার্গটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মার্কিন সরকারের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা জানিয়েছে, গত মে মাসে এটি আরও সংকীর্ণ হয়েছে। 

দ্বিতীয় ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখা যায়, এই আইসবার্গের নাম A68A৷ সে সময় সর্বশেষ তথ্যমতে, এটির আকার ছিল ৪২০০ বর্গ কিলোমিটার। (শুরুতে ৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার ছিল A68 নামে) সে সময় এটি ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গিয়েছিল। ২০২১ সালে এই আইসবার্গটির অস্তিত্ব বিলীন হয়।  

Screenshot: The Guardian 

অর্থাৎ, দুইটি ভিন্ন আইসবার্গের ছবি ব্যবহার করে আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে। 

ভাইরাল পোস্টগুলোতে তথ্যের সূত্র হিসেবে বিবিসি গ্লোবালের নাম উল্লেখ থাকার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ব্রিটিশ এই সংবাদমাধ্যমটির ওয়েবসাইটে গত ২৪ নভেম্বর প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।  

এই প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, A23a নামের একটি আইসবার্গ যাকে বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম আইসবার্গ বলা হচ্ছে তা অ্যান্টার্কটিকা থেকে সরে যেতে শুরু করেছে। 

বিবিসি লিখেছে, প্রায় চার হাজার বর্গ কিলোমিটার আকারের এই আইসবার্গটি  ১৯৮৬ সালে অ্যান্টার্কটিকা উপকূল থেকে আলাদা হয়ে পড়েছিল। তিন দশকের বেশি সময় পর সম্প্রতি সমুদ্রের তলদেশে আটকে থাকা এই আইসবার্গ সরে যেতে শুরু করেছে।  

ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি বলছে, ২০২০ সালে এটি সমুদ্রতলের উপর তার দখল হারিয়ে ফেলে এবং ওয়েডেল সাগরে ভাসতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে আইসবার্গগুলির সমুদ্র তলে আটকে থাকা  অস্বাভাবিক নয়, তবে সময়ের সাথে সাথে তারা মাটির নিচে এবং ভাসতে ভাসতে যথেষ্ট সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাতাস এবং স্রোত দ্বারা চালিত হয়ে এটির সরে যাওয়া আরো ত্বরান্বিত করেছে এবং এখন অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপের উত্তর প্রান্ত অতিক্রম করছে এটি। 

অর্থাৎ, ৬ হাজার বছর ধরে নয়, তিন দশকের কিছুটা বেশি সময় ধরে এক স্থানে ছিল এ২৩এ নামের আইসবার্গটি। 

তাছাড়া, এই আইসবার্গের সর্বশেষ প্রকাশিত ছবির সাথে ভাইরাল পোস্টগুলোতে যুক্ত ছবিগুলোর মিল পাওয়া যায়নি। 

Screenshot: CBS

ভাইরাল পোস্টগুলোতে এই আইসবার্গের প্রাণিদের বিষয়ে যেসব তথ্য যেমন প্রায় ৮ রকমের প্রাণির বাস, ১০-১৫ হাজার পোলার বিয়ার এবং লক্ষাধিক পেঙ্গুইন থাকা বিষয়ক তথ্য উল্লেখ পাওয়া যায়নি বিবিসির প্রতিবেদনে। তবে বিবিসি জানিয়েছে, যদি এই আইসবার্গ দক্ষিণ জর্জিয়ার দিকে যায়, তবে এটি দ্বীপে প্রজননকারী লক্ষ লক্ষ সীল, পেঙ্গুইন এবং অন্যান্য সামুদ্রিক পাখির জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। 

তাছাড়া, মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফোর্বসের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, আন্টার্কটিকায় পোলার বিয়ার বা মেরু ভাল্লুক থাকে না। এরা থাকে আর্কটিক অঞ্চলে। তবে অ্যান্টার্কটিকার উপকূলে পেঙ্গুইন থাকার কথা জানা যায়।  

এছাড়া, ভাইরাল পোস্টগুলোতে এ২৩এ আইসবার্গের আকার বাংলাদেশের ঢাকা থেকে বড় দাবি করা হয়েছে যার সত্যতা মিলেছে। কারণ, ঢাকা জেলার আয়তন ১৪৬৩.৬০ বর্গ কিলোমিটার, যা আইসবার্গটির থেকে প্রায় তিন গুণ কম। তবে পোস্টগুলোতে আইসবার্গটি বাংলাদেশের আয়তনের তিন ভাগের এক ভাগ দাবি করা হলেও তা সঠিক নয়৷ কারণ, বাংলাদেশের আয়তন ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার। ফলে বাংলাদেশের আয়তনের তিন ভাগের এক ভাগ হবে ৪৯ হাজার ১৯০ বর্গকিলোমিটার। 

মূলত, গত ২৪ নভেম্বর থেকে অ্যান্টার্কটিকায় আটকে থাকা এ২৩এ নামের বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বৃহত্তম আইসবার্গটি তার অবস্থান থেকে সরে যেতে শুরু করে। এই ঘটনায় পুরোনো ও ভিন্ন দুইটি আইসবার্গের ছবি ফেসবুকে প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, আইসবার্গটি ৬ হাজার বছর ধরে এক জায়গায় আটকে ছিল, যা সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, তিন দশকের কিছু বেশি সময় এটি আটকে ছিল এক স্থানে। তাছাড়া, ভাইরাল পোস্টগুলোতে এই আইসবার্গের প্রাণিদের বিষয়ে যেসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে তারও সত্যতা মেলেনি। এমনকি আইসবার্গটি বাংলাদেশের আয়তনের তিন ভাগের এক ভাগ দাবি করা হলেও সেটিও ভুল তথ্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। 

সুতরাং, অ্যান্টার্কটিকায় পৃথিবীর বৃহত্তম আইসবার্গটি সম্প্রতি তার অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার ঘটনায় পুরোনো ও ভিন্ন দুইটি আইসবার্গের ছবি ফেসবুকে প্রচার করে বেশকিছু ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর। 

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img