সম্প্রতি জাতীয় সংসদ অধিবেশনে জাতীয় পার্টি’র সংসদ সদস্য জনাব ফখরুল ইমাম পাঠ্যসূচিতে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত তথ্য বাদ দিয়ে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কিত তথ্য যুক্ত করে পাঠ্যসূচীতে হিন্দুত্ববাদ আনা হয়েছে অভিযোগ তুলে একটি বক্তব্য দিয়েছেন। উক্ত বক্তব্যে তিনি দাবি করেছেন,
- ক্লাস টু’তে ‘সবাই মিলে কাজ করি’ শিরোনামে মহানবীর সংক্ষিপ্ত জীবনী ছিল সেটা বাদ দেয়া হয়েছে।
- থ্রিতে ‘খলিফা আবু বক্কর’ শিরোনামে সংক্ষিপ্ত জীবনী, সেটা বাদ দেয়া হয়েছে।
- ক্লাস ফোরে খলিফা হযরত ওমরের সংক্ষিপ্ত জীবনী সেটা বাদ দেয়া হয়েছে।
- ফিফথে ‘বিদায় হজ্ব’ শীর্ষক শেষ নবীর জীবনী একটা ছিল, সেটা বাদ দিয়েছে।
- পঞ্চম শ্রেণিতে ‘বই’ নামে একটা কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেটা ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন বিরোধী কবিতা।
- আর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ‘লাল গরু’ নামক একটি ছোট গল্প আনা হয়েছে। যা মুসলিম শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে— গরু হচ্ছে মায়ের মতো। তাই গরু জবাই করা ঠিক নয়। অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদ।
- সপ্তম শ্রেণির বইতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের ‘লালু’ নামক একটা গল্প ঢুকানো হয়েছে, যাতে শেখানো হচ্ছে হিন্দুদের কালিপূজা ও পাঠবলির কাহিনি।
- অষ্টম শ্রেণির বইতে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ, অর্থাৎ রামায়ণের সংক্ষিপ্ত রূপ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

তার বক্তব্য নিয়ে করা কয়েকটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
ফ্যাক্টচেক
জাতীয় সংসদে সাংসদ ফখরুল ইমামের পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন শ্রেণির বাংলা বই হতে ইসলামিক গল্প/প্রবন্ধ/কবিতা বাদ দিয়ে হিন্দুধর্ম সম্পর্কিত গল্প/প্রবন্ধ/কবিতা যুক্ত করা হয়েছে দাবিতে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সঠিক নয় বরং তিনি যেসকল ইসলামি গল্প/প্রবন্ধ/কবিতা বাদ দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলো বাদ দেওয়া হয়নি এবং হিন্দুত্ববাদী যেসকল গল্প/প্রবন্ধ/কবিতা যুক্ত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তা বর্তমান পাঠ্যক্রমেই নেই।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে তিনি যে সকল ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত গল্প/কবিতা/প্রবন্ধ বাদ দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন সেগুলো বাদ দেয়া হয়নি বরং যেগুলো যুক্ত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তা বর্তমান পাঠ্যক্রমে নেই এবং সেগুলো ২০১৭ সালেই বাদ দেয়া হয়েছে।
প্রথম দাবি যাচাই
দ্বিতীয় শ্রেণীর বাংলা বই হতে মহানবী (সা.) এর জীবনী শীর্ষক ‘সবাই মিলে করি কাজ’ প্রবন্ধটি বাদ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এটি বাদ দেওয়া হয়নি বরং বর্তমান পাঠ্যক্রমের দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৭১ পৃষ্ঠায় এটি বিদ্যমান রয়েছে।

দ্বিতীয় দাবি যাচাই
তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বই হতে খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) এর জীবনী বাদ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন।
তবে দেখা গেছে, এটি বাদ দেওয়া হয়নি বরং বর্তমান পাঠ্যক্রমের তৃতীয় শ্রেণির বইয়ে এটি রয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২২ সালের তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৯৯ তম পৃষ্ঠায় খলিফা আবু বকর (রাঃ) নামে তার জীবনী নিয়ে লেখা প্রবন্ধটি খুঁজে পাওয়া যায়।

তৃতীয় তথ্য যাচাই
তিনি তার বক্তব্যে ৪র্থ শ্রেণীর বাংলা বই হতে হযরত ওমর (রাঃ) এর জীবনী বাদ দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। তবে আমাদের অনুসন্ধানে দেখা যায় সেটি বাদ দেয়া হয়নি বরং বর্তমান পাঠ্যক্রমের চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ে এটি রয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২২ সালের চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৯৭ নম্বর পৃষ্ঠায় খলিফা হযরত ওমর (রা) নামে হযরত ওমর (রাঃ) এর জীবনী নিয়ে লেখাটি রয়েছে।

চতুর্থ তথ্য যাচাই
পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বই হতে ‘বিদায় হজ’ প্রবন্ধটি বাদ দেওয়া হয়েছে বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন ফখরুল ইমাম। তবে আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বই হতে ‘বিদায় হজ’ প্রবন্ধ টি বাদ দেওয়া হয়নি বরং বর্তমান পাঠ্যক্রমে পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে এটি বিদ্যামান রয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২২ সালের পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৯৫ তম পৃষ্ঠায় ‘বিদায় হজ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি খুঁজে পাওয়া যায়।

পঞ্চম তথ্য যাচাই
পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে ‘বই’ নামে একটা কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেটি কোরআন বিরোধী কবিতা বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে পঞ্চম শ্রেণির বর্তমান পাঠ্যক্রমে ‘বই’ নামের কোন কবিতা নেই।জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২২ সালের পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘বই’ নামে কোনো কবিতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ষষ্ঠ তথ্য যাচাই
ষষ্ঠ শ্রেণীর বাংলা বইতে ‘লাল গরু’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে গরু মায়ের মত, তাই জবাই করা উচিত না। অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদ। তবে অনুসন্ধানে ষষ্ঠ শ্রেণির বর্তমান পাঠ্যবইয়ে এ নামে কোন প্রবন্ধ নেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২২ সালের ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বই এবং সহপাঠে ‘লাল গরু’ নামের কোনো প্রবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়নি।


সপ্তম তথ্য যাচাই
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম এমপির দাবি, সপ্তম শ্রেণীতে ‘লালু’ নামের একটি গল্প আনা হয়েছে, যেখানে কালী পূজা এবং পাঠা বলির গল্প রয়েছে৷ তবে অনুসন্ধানে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে লালু নামের কোন গল্প পাওয়া যায়নি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২২ সালের সপ্তম শ্রেণির বাংলা বইয়ে এবং সহপাঠে এই নামের কোনো গল্প নেই।


অষ্টম তথ্য যাচাই
সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম অষ্টম শ্রেণির বাংলা বইয়ে রামায়ণ-কাহিনির সংক্ষিপ্তরূপ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন।
তবে অনুসন্ধানে অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে রামায়ণ কাহিনীর সংক্ষিপ্তরূপের বর্ণনা দিয়ে কোনো অধ্যায় পাওয়া যায়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর ২০২২ সালের অষ্টম শ্রেণির বাংলা বইয়ে এবং সহপাঠে এই নামের কোনো গল্প নেই।


অপরদিকে অনুসন্ধানে ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি দৈনিক সমকালে “পাঠ্যপুস্তকে বাদ যাওয়া লেখা পড়বে শিশুরা” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হিন্দুয়ানি লেখা অভিযোগ তুলে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ২০১৬ সালের ৮ এপ্রিল একটি যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত ১২টি কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধকে বাদ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়। হেফাজতের বাদ দেয়ার সুপারিশকৃত ১২ টি গল্প, প্রবন্ধ-কবিতাগুলো হলো-
হুমায়ুন আজাদের কবিতা ‘বই’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, সত্যেন সেনের ছোটগল্প ‘লাল গরুটা’, এস ওয়াজেদ আলীর ভ্রমণ কাহিনী ‘রাঁচি ভ্রমণ’, শরৎচন্দ্র চট্টোপ্যাধায়ের ‘লালু’, ‘রামায়ণ’ সংক্ষিপ্ত রূপ, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের কবিতা ‘আমার সন্তান’, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণ কাহিনী ‘পালামৌ’, লালন শাহের গান ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা ‘সাঁকোটা দুলছে’, জ্ঞানদাসের কবিতা ‘সুখের লাগিয়া’। এই ১২টি লেখা ২০১৩ সালে পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা হয়েছিল।
হেফাজতের সুপারিশে পরবর্তীতে ২০১৭ সালের পাঠ্যক্রম থেকে পুরনো ২২টি কবিতা এবং গল্প-প্রবন্ধ বাদ দেওয়া হয়। সেসময়-ই সাংসদ ফখরুল ইমাম এর বক্তব্য উল্লেখিত হিন্দুয়ানি যে কবিতা-গল্প-প্রবন্ধগুলো উল্লেখ করা হয় তা বাদ দেয়া হয়।
এছাড়াও ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হেফাজতের সুপারিশে ২০১৭ সালের পাঠ্যক্রমে দ্বিতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’য়ে ‘সবাই মিলে করি কাজ’, তৃতীয় শ্রেণিতে ‘খলিফা হযরত আবু বকর’, চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘খলিফা হযরত উমর (রা.) এবং ৫ম শ্রেণির বইয়ে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’, ‘বিদায় হজ’ ও ‘শহিদ তিতুমীর’ যুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য এ গল্প-কবিতা-প্রবন্ধগুলো পূর্বে ছিলো এবং তা ২০১৩ সালের বাদ দেয়া হয়েছিল যা হেফাজতের সুপারিশে ২০১৭ সালে পাঠ্যসূচিতে পুনরায় যুক্ত করা হয়।
অর্থাৎ, সাংসদ ফখরুল ইমাম বর্তমান পাঠ্যক্রম সম্পর্কে না জেনে, ২০১৭ সালে পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন করার বিষয়টি না জেনে ভুল বক্তব্য দিয়েছেন।
আরো পড়ুনঃ অক্টোবরের ৮ তারিখ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার দাবিটি মিথ্যা
মূলত, জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম যে বিষয়গুলো নিয়ে সংসদে কথা বলেছেন তা ২০১৪ এরপর এবং ২০১৭ এর পূর্বের সময়ের আলোচ্য বিষয় ছিলো। সেসময় পাঠ্যবইয়ে তার বক্তব্যে উল্লিখিত বিষয় বাদ দেয়া এবং যুক্ত করার বিষয়টি ঘটেছিল। তবে ২০১৭ সালে হেফাজতে ইসলামের সুপারিশে তার উল্লিখিত বাদ দেওয়া বিষয়গুলো ফিরিয়ে আনা হয় এবং ২০১৪ তে পাঠ্যক্রমে যুক্ত হওয়া তার উল্লিখিত যুক্ত করার বিষয়গুলো বাদ দেওয়া হয়।
অর্থাৎ, পাঠ্যসূচির পরিবর্তন নিয়ে সাংসদ ফখরুল ইমামের জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তব্যটি বর্তমান পাঠ্যক্রম অনুযায়ী মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
National Curriculum and Textbook Board (NCTB): http://www.nctb.gov.bd/
The Daily Prothom Alo: গোলমেলে পাঠ্যবই—১
The Daily Prothom Alo: ছাপার পরও পাঠ্যবই সংশোধন, দায় নিচ্ছে না কেউ