বুধবার, সেপ্টেম্বর 27, 2023
spot_img

শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য না নেয়া সংক্রান্ত কোনো মন্তব্য গোয়েন লুইস করেননি

সম্প্রতি, “মানবধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য নেবে না জাতিসংঘ” শীর্ষক একটি মন্তব্য বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস করেছেন দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস ”মানবধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য নেবে না জাতিসংঘ” শীর্ষক কোনো মন্তব্য করেননি বরং কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই ভিত্তিহীনভাবে উক্ত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।

বিভ্রান্তির শুরু

অনুসন্ধানে গত ৭ জুলাই রাত  ৯ টায় ‘Abdur Rab Bhuttow’ নামক ফেসবুক পেজ থেজে উক্ত দাবিতে একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। তবে পরবর্তীতে সেই পোস্টটি তিনি মুছে ফেলেন।

Screenshot from ‘Crowdtangle’

উল্লিখিত দাবির সত্যতা যাচাইয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সৈন্য নিয়ে নিয়ে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।

অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘বিবিসি বাংলা’ এর ওয়েবসাইটে গত ২৭ জুন “জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সদস্য পাঠানোর বিষয়টি কেন আলোচনায়?” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত  প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot from ‘BBC বাংলা’

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, গত ২৫-২৬শে জুন বাংলাদেশে সফর করেছিলেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জাঁ পিয়ের ল্যাক্রোয়ার। তিনি আগামী ডিসেম্বরে ঘানায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের আগে ঢাকায় প্রথম প্রস্তুতি সভায় অংশ নেন। সভায় জাঁ পিয়ের ল্যাক্রোয়ার তার বক্তব্যে অন্যান্য বিষয়ের সাথে শান্তিরক্ষা মিশনে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি নিয়েও কথা বলেন।

উক্ত সভায় জাঁ পিয়ের ল্যাক্রোয়ার বলেন, বিভিন্ন কমিউনিটির সাথে জাতিসংঘের সংযুক্তিকে সফল করতে তাদের সব কাজের পূর্বশর্ত থাকে যে, সব শান্তিরক্ষীর আচরণ যাতে সর্বোচ্চ মানের হয়। তাদের যাতে সততা, যোগ্যতা এবং দক্ষতার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা হয়। একইসাথে যেসব দেশ সেনা এবং পুলিশ সদস্যদের পাঠাচ্ছে সেসব দেশকে নিশ্চিত করতে হয় যে, তাদের পাঠানো আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর কোন সদস্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘনের সাথে জড়িত নয় বা তাদের বিরুদ্ধে এমন কোন অভিযোগও নেই।

এছাড়া, দেশীয় মূলধারার গণমাধ্যম ডেইলি স্টার এর ওয়েবসাইটে গত ২৬ জুন “‘নিশ্চিত হতে হবে কোনো শান্তিরক্ষী মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত নয়” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot from ‘The Daily Star’

উক্ত প্রতিবদন থেকে জানা যায়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ ২৫ জুন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জাঁ পিয়ের ল্যাক্রোয়ারের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। সেই স্মারকলিপির জবাবে জাঁ পিয়ের ল্যাক্রোয়ার ইমেলের মাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠান।

ঐ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শান্তিরক্ষায় যেসব দেশ সেনা ও পুলিশ পাঠায় তাদের নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের কেউ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে না বা তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই।’

পরবর্তীতে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘বিবিসি বাংলা’ এর ওয়েবসাইটে গত ২৪ জুন “বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িতদের শান্তিরক্ষা মিশনে না নিতে জাতিসংঘকে অ্যামনেস্টির আহবান” শীর্ষক শীরোনামে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot from ‘BBC বাংলা’

প্রকাশিত প্রতবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলের বাংলাদেশ সফরে আসা উপলক্ষে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

একইসঙ্গে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনে যারা জড়িত তারা যেন জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে যেতে না পারে সেটিও নিশ্চিতের আহ্বান জানায় তারা।

এছাড়া, মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন হিউম্যান রাইট ওয়াচ এর ওয়েবসাইটে

গত ১২ জুন “UN Should Enhance Screening of Bangladesh Peacekeepers” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি বিবৃতি খুঁজে পাওয়া যায়।

বিবৃতিতে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয় যাচাই বাছাইয়ের আহ্বান জানানো হয়। 

এইচআরডব্লিউর দাবি, বাংলাদেশে ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যেন দেশের বাইরে শান্তি রক্ষা মিশনে অংশ না নিতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত নীতিমালা ব্যর্থ হয়েছে। শুধু উচ্চপদস্থ কর্তকর্তাদের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয় যাচাই বাছাই করে জাতিসংঘ।

র‍্যাবকে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত বাহিনী হিসেবে দাবি করে বিবৃতিতে আরো বলা হয়, জাতিসংঘের উচিত কোনো বাংলাদেশি কর্মকর্তা র‍্যাবের সঙ্গে জড়িত থাকলে, তা প্রকাশ করা এবং বাহিনী–সংশ্লিষ্ট কাউকে শান্তি রক্ষা মিশনে যোগদানে বিরত রাখা। শুধু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নয়, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সব সদস্যের মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয় যাচাই–বাছাই করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশন বিভাগকে।

উক্ত প্রতিবেদন গুলোর কোথাও বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস “মানবধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য নেবে না জাতিসংঘ” শীর্ষক কোনো বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এছাড়া বিষয়টি অধিকতর নিশ্চিতে গোয়েন লুইস এর টুইটার অ্যাকাউন্ট  পর্যবেক্ষণ করে এমন কোনো বক্তব্য বা এই সম্পর্কিত কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

Screenshot from Twitter

বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট জাতিসংঘের টুইটার অ্যাকাউন্টেও গোয়েন লুসের দেওয়া এমন কোনো বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

Screenshot from Twitter

অনুসন্ধানের মাধ্যমে জাতিসংঘ বাংলাদেশ এর ওয়েবসাইটে গত ২৯ মে “আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবসে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস এর বানী” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত বিবৃতি খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot from UN Bangladesh

তবে উক্ত বিবৃতিতে গোয়েন লুইসের “মানবধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য নেবে না জাতিসংঘ” শীর্ষক বক্তব্য প্রদান করেননি।

মূলত, সম্প্রতি “মানবধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য নেবে না জাতিসংঘ” শীর্ষক একটি তথ্য বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস বক্তব্য দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গোয়েন লুইস এমন কোনো বক্তব্য দেননি। জাতিসংঘের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, মূলধারার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মাধ্যমে গোয়েন লুইসের এমন মন্তব্যের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, পূর্বেও বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি. হাসের মন্তব্য দাবিতে ইন্টারনেটে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হলে সেসময় বিষয়টি নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার। 

সুতরাং,”মানবধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য নেবে না জাতিসংঘ” শীর্ষক একটি তথ্যকে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস মন্তব্য দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

RS Team
RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img