সম্প্রতি, “সমাবেশে লাখ লাখ লোকের গল্প বলা বিএনপি শেষ পর্যন্ত ফটোশপে ছবি এডিট করে আপলোড করলো” শীর্ষক শিরোনামে একটি ব্যানার বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে প্রচারের মাধ্যমে ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

ছড়িয়ে পড়া কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলিতে দুটি ছবিকে চিহ্নিত করে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে খুলনায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ নিয়ে প্রকাশিত এ ছবি দুটিকে ফটোশপের মাধ্যমে এডিট করে মানুষের উপস্থিতি বেশি দেখিয়েছে।

ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে খুলনায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ নিয়ে প্রকাশিত ছবিগুলোর যে দুটি ছবিকে লাল মার্ক করে ফটোশপের মাধ্যমে এডিট দাবি করা হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে এডিট করা হয়নি। মূলত একই রঙের কাপড়ে সমাবেশ মঞ্চ ও পাশে ডক্টর এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) এর মেডিকেল ক্যম্পের ছাউনি থাকায় এবং ফেসবুকে আপলোডের পর ছবির রেজুলেশন কমে যাওয়ায় উক্ত বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার টিম একাধিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে ছবিগুলো বিকৃত করে জনসমাগম বেশি দেখানোর দাবিটির কোন সত্যতা পায়নি।
এডিটেড দাবির পোস্ট বিশ্লেষণ
এডিটেড দাবির পোস্টগুলোতে দেখা যায় সেখানে আকাশি-সাদা রঙের কাপড়ে তৈরি মঞ্চ এবং পাশের একই রঙের কিছু একটা কে লাল রঙ দিয়ে চিহ্নিত করে দেখাতে চেয়েছে যে এডিট করে এক করা হয়েছে। পাশাপাশি একটা অংশে মানুষের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়া এবং আকার ছোট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি মার্ক করে দেখিয়েও সেখানে ফটোশপে এডিটেড দাবি করা হয়েছে।

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধান
১. অনুসন্ধানে সমকালের ফেসবুক পেজে বিএনপির খুলনার সমাবেশ নিয়ে আপলোড করা একটি ছবি পাওয়া যায়। ছবিটি দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় সেখানে একই রঙের কাপড়ে একটি ছাউনি ছিলো। ছবিটি দেখুন— এখানে। সমকালের আপলোড করা এই ছবি দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় সেখানে একই রঙের কাপড়ে একটি ছাউনি ছিলো।

বিএনপির মিডিয়া সেলের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে আপলোড করা ড্রোনে ধারণ করা সমাবেশের একটি ভিডিও থেকেও পাশে একই রঙের কাপড়ের তৈরি ছাউনি দেখা যায়। ভিডিওটি দেখুন– এখানে।

সাংবাদিক জাকারিয়া ইবনে ইউসুফ এর সমাবেশস্থল থেকে করা একটি লাইভ ভিডিও থেকেও পাশে মঞ্চের কাপড়ের রঙের ছাউনি দেখা যায়।

এছাড়াও আর বেশকিছু মাধ্যমে আপলোড করা ফুটেজ থেকে পাশে একই রঙের কাপড়ে তৈরি ছাউনি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে রিউমর স্ক্যানার।
পরবর্তীতে নিশ্চিত হওয়া গেছে পাশের ছাউনিটি ছিলো ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) এর অস্থায়ী জরুরী স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের মেডিকেল ক্যাম্পের ছাউনি।

২. পোস্টের ছবিগুলো এডিটের মাধ্যমে একাধিক ছবি একসাথে যুক্ত করে লোকসংখ্যা বেশি দেখানো হয়েছে শীর্ষক যে দাবি করা হয় সেটি নিয়েও কয়েক স্তরের পর্যালোচনা করেছে রিউমর স্ক্যানার। যার মধ্যে ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ, গণমাধ্যমে প্রাপ্ত সেদিনের ছবি বিশ্লেষণ, মূল ছবি সংগ্রহ করে ছবির ফরেনসিক বিশ্লেষণ এবং মেটাডাটা বিশ্লেষণ করেছে রিউমর স্ক্যানার। সকল পর্যবেক্ষণ শেষে রিউমর স্ক্যানার টিম নিশ্চিত হয়েছে যে একধিক ছবি যুক্ত করে লোক সংখ্যা বেশি দেখানোর দাবিটি সঠিক নয়।
ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ
রিউমর স্ক্যানার টিম বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ছবির অনুরূপ উপস্থিতি বা জনসংখ্যার ঘনত্ব সেখানে দেখতে পেয়েছে। অনুসন্ধানে বিএনপির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে আপলোডকৃত ছবিগুলোর চিত্রগ্রাহক বাবুল তালুকদারের ফেসবুক আইডিতে প্রায় কাছাকাছি কোণ থেকে ধারণ করা একটি ভিডিও ফুটেজ পাওযা যায়। ভিডিও ফুটেজটি বিশ্লেষণে ছবির অনুরুপ ঘনত্ব দেখা গেছে। ভিডিওটি দেখুন– এখানে।

পরবর্তীতে খুলনায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ নিয়ে বিএনপির অফিশিয়াল পেজে প্রচারিত লাইভটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। পর্যবেক্ষণে সেখানেও অনুরুপ উপস্থিতি পাওয়া যায়। লাইভটির ১ ঘন্টা ৫২ বা ১ ঘন্টা ৫৭ তম মিনিট সময়ে দেখুন– এখানে।

গণমাধ্যমে প্রাপ্ত ছবি বিশ্লেষণ
খুলনায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুরুপ ফ্রেম খোঁজার চেষ্টা করেছে রিউমর স্ক্যানার। অনুসন্ধানে প্রথম আলো তে প্রায় কাছাকাছি কোণের অনুরুপ ফ্রেমের একটি ছবি পাওয়া গেছে। প্রথম আলো উল্লেখ করেছে উক্ত ছবিটি প্রথম আলোর চিত্রগ্রাহক সাদ্দাম হোসেন তুলেছেন। প্রথম আলোতে প্রকাশিত এই ছবিটি পর্যবেক্ষণেও ছবির ঐ অংশ অনুরুপ পাওয়া গেছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে সংযুক্ত ছবিটি– এখানে।

DW বাংলা এর ফেসবুক পেজে আপলোড করা প্রায় অনুরুপ কোণ থেকে তোলা প্রায় অনুরুপ অংশের তোলা একটি ছবিতেও একই রকমের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ছবিটি দেখুন– এখানে।


খুলনায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ নিয়ে প্রকাশিত আজকের পত্রিকার একটি প্রতিবেদনেও প্রায় কাছাকাছি ফ্রেমের একটি ছবি পাওয়া যায়। ছবিটিতেও জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় অনুরুপ লক্ষ করা গেছে।

অধিকতর নিশ্চয়তার জন্য রিউমর স্ক্যানার টিম বিএনপির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে পাওয়া [email protected] মেইলটিতে যোগাযোগ করে অনুসন্ধানের স্বার্থে আপলোডকৃত ছবিগুলোর মূল ফাইলগুলো পাঠানোর অনুরোধ করে। পরবর্তীতে বিএনপির পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে তারা ছবিগুলোর চিত্রগ্রাহক বাবুল তালুকদারের কাছে ই-মেইলের মাধ্যমে ছবিগুলো নিয়ে সরাসরি বাবুল তালুকদারের মেইলগুলি আমাদের ফরোয়ার্ড করে দেয়। সেখান থেকে আমরা মূল ছবিগুলো পাই। মূল ছবিগুলো পাওয়ার পর টুলসেরর সহায়তায় সেগুলোর ফরেনসিক এবং মেটাডাটা সংগ্রহ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।
চিত্রগ্রাহকের পাঠানো ছবির মূল ফাইল এবং বিএনপির অফিশিয়াল পেজে আপলোড করা ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করে কোন বিকৃতিজনিত পরিবর্তন পায়নি রিউমর স্ক্যানারের পর্যবেক্ষক দল। তবে দুটি ছবির মধ্য কোয়ালিটি বা রেজুলেশনে বিস্তর পার্থক্য দেখা গেছে। আমাদের মেইলের উত্তরে দেয়া তথ্য অনুযায়ী বিএনপির অফিশিয়াল পেজের একজন এডিটর ছবিগুলো চিত্রগ্রাহকের কাছে থেকে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সংগ্রহ করে ফেসবুকে আপলোড করেছে৷ যার ফলে হাই রেজুলেশনের ছবি হওয়া সত্ত্বেও ছবির কোয়ালিটি তুলনামূলক বেশি লোপ পেয়েছে।

এছাড়াও মূল ছবিগুলো জুম করে পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম নিশ্চিত হয়েছেে জনসংখ্যা বেশি দেখানোর জন্য ছবিগুলোতে বিকৃতি করার মতো কোন ফটোশপ এডিট ঘটেনি। নিচে একটি মূল ছবি দেখুন-

ছবিটির জুম ভিউ–

মূল ছবির জুম ভিউ অধিকতর বিশ্লেষণে প্রায় প্রতিটি মাথা পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম কোন বিকৃতি হয়নি বলে নিশ্চিত হয়েছে।
ছবির ফরেনসিক বিশ্লেষণ
একাধিক ছবি একত্রে করে লোক বেশি দেখানোর দাবি করে যে ফেসবুক পোস্ট করা হয়েছে, সেই পোস্টের মার্ক করা দুইটি ছবি টুলসের সহায়তায় ফরেনসিক বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। ফরেনসিক বিশ্লেষণে ছবি দুটিতে এডিট করার কোনো প্রমান খুঁজে পাওয়া যায় নি।


মেটা ডাটা বিশ্লেষণ
মূল ছবিগুলো পাওয়ার পর টুলসের সহায়তায় রিউমর স্ক্যানার টিম ছবিগুলোর মেটাডাটা বিশ্লেষণ করেছে। মেটাডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ছবিগুলোতে ডাটার কোন বিকৃতি হয়নি। মেটাডাটা বিশ্লেষণে জানা যায় ছবি দুইটি ২২ অক্টোবর বিকেল ৪.৪৮ মিনিট এবং ৪.৪৯ মিনিটে ধারণ করা হয়েছে।

ঠিক সেসময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তব্য দিচ্ছিলেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য দেওয়ার সময় এবং ছবি তোলার সময় ক্রস চেক করে সময়ের মিল পাওয়া যায়। দেখুন– এখানে।

মূলত, গত ২২ আগস্ট খুলনায় অনুষ্ঠিত বিভাগীয় গণসমাবেশ নিয়ে বিএনপির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে বেশকিছু ছবি প্রকাশ করা হয়। তবে উক্ত পোস্টের দুটি ছবির ‘কাপড়ের রঙ এবং ঘনত্ব চিহ্নিত করে দেখানোর মাধ্যমে’ ‘ছবি দুটি ফটোশপে এডিট করে প্রচার করা হয়েছে’ বলে আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে দাবি করা হয়। তবে রিউমর স্ক্যানারের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে উক্ত ছবিটি এডিটেড নয় বরং একই রঙের কাপড়ে স্টেজ এবং পাশে একটি ছাউনি থাকায় এবং ফেসবুকে আপলোডের পর ছবির রেজুলেশন কমে যাওয়ার কারণে এডিট দাবি শীর্ষক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ছবিটি আসল।
আরো পড়ুনঃ বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা?
সুতরাং, বিএনপির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে আপলোডকৃত ছবিগুলো ফটোশপের মাধ্যমে এডিট করে লোকসমাগম বেশি দেখানো হয়েছে শীর্ষক দাবিটি সত্য নয়।
তথ্যসূত্র
- Samakal – Stage and Medical Camp joint view
- DW & Prothom Alo – Smilar Photo Analysis
- Video footage analysis
- Photo Metadata Analysis
- Photo Forensic Analysis