মেঘের কারণে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল সৃষ্টির দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি মিথ্যা

সম্প্রতি ‘মেঘের কারণেই সৃষ্টি-বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’ শীর্ষক শিরোনামে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ষড়ভুজাকৃতির মেঘের কারণেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের সৃষ্টি দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া তথ্যটি সঠিক নয় বরং ২০১৬ সালে আমেরিকার সায়েন্স টিভি চ্যানেল তাদের একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত দুইজন বিশেষজ্ঞের বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে এই দাবিতে সর্বপ্রথম প্রচার করে।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য সমাধানে ষড়ভুজাকৃতি মেঘের ব্যাপারটি যেভাবে এলো

কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমেরিকান ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান Snopes এ ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর ‘Scientists Finally Solve the Mystery of the Bermuda Triangle?‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Snopes.com

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল সায়েন্স চ্যানেল “What on Earth?” নামের শো এর একটি পর্ব মুক্তি দেয়। যেখানে চ্যানেলটি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল অঞ্চলে জাহাজ এবং প্লেন হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে Microbursts নামে পরিচিত আবহাওয়া সংক্রান্ত একটি প্রাকৃতিক ঘটনাকে দায়ী করে।

Screenshot: Snopes.com

পরবর্তীতে সায়েন্স চ্যানেলের এই পর্বটিকে ব্রিটিশ দৈনিক ডেইলি মেইল, মিরর অনলাইন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য নিয়ে নতুন ফলাফল পাওয়ার দাবিতে প্রচার করে।

Screenshot: Mirror Online

Snopes এর প্রতিবেদনটি থেকে সায়েন্স চ্যানেলের উল্লেখিত পর্বটি সম্পর্কে যা জানা যায়, তা হলো:

১. মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার একটি স্যাটেলাইট বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের উপরে মেঘে কিছু ষড়ভুজ আকৃতির ফাঁকা জায়গার ছবি তুলেছে।

২. সমুদ্রের ঢেউ এবং বাতাসের গতিপ্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করার অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি স্যাটেলাইট উত্তর সাগরের উপর একই ধরনের কিছু মেঘের ছবি ধারণ করে।

Screenshot: Snopes.com

৩. আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এই ধরনের মেঘ মাইক্রোবার্স্ট (microburst) নামক একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, যা শক্তিশালী বাতাস তৈরি করে।

৪. যেহেতু বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের উপর এমন মেঘ দেখা গিয়েছে, এর মাধ্যমেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে।

সায়েন্স চ্যানেলের উল্লেখিত পর্বটিতে থাকা বিশেষজ্ঞরা কি বলেছিলেন?

সায়েন্স চ্যানেলের এই পর্বটিতে উপস্থিত থাকা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির জলবায়ু বিশেষজ্ঞ রান্ডাল সার্ভেনি এই ষড়ভুজাকৃতির মেঘ সম্পর্কে বলেন, সমুদ্রের উপর এই ষড়ভুজ আকৃতিগুলো মূলত এয়ার বোমা, এগুলোকে মাইক্রোবার্স্ট বলা হয়। মাইক্রোবার্স্ট মূলত বাতাসের প্রবল প্রবাহ যা মেঘের তলদেশ থেকে নেমে এসে সমুদ্রে আঘাত করে এবং ঢেউ তৈরি করে, যা কখনও কখনও আকারে বিশাল হতে পারে। 

Screenshot: Mirror Online

অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা আরেক অতিথি কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির স্যাটেলাইট আবহাওয়াবিদ স্টিভ মিলার বলেন, বেশিরভাগ সময় মেঘের চলাচল হয় এলোমেলোভাবে।

Screenshot: Daily Mail

Snopes এর উল্লেখিত প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, উভয় বিজ্ঞানীর বক্তব্যই বাস্তবসম্মত। তবে সায়েন্স চ্যানেলের ঐ পর্বে এই দুইজনের কোনো বিজ্ঞানীই দাবি করেননি যে, তারা যে প্রক্রিয়াটি বর্ণনা করছে তাতে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল রহস্যের সমাধান আছে।

Screenshot: Snopes.com

পরবর্তীতে আমেরিকান আরেকটি ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান USA Today তে ২০১৬ সালের ২১ অক্টোবর ‘What are these hexagonal clouds found over the Bermuda Triangle?‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের উপর যে ধরনের মেঘ দেখা গিয়েছে, তা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যের সমাধান দেয় না। এ ধরনের মেঘ দেখতে অদ্ভুত হলেও অস্বাভাবিক না৷ এই ধরনের ঘটনা ঘটে মূলত উষ্ণ পানির উপরে ঠান্ডা ও শুষ্ক বায়ুর সংমিশ্রণে।

Screenshot: USA Today

USA Today তাদের প্রতিবেদনে সায়েন্স চ্যানেলের বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে পর্বটিতে উপস্থিত থাকা ঐ দুইজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গেও যোগাযোগ করে।

এদের মধ্যে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির জলবায়ু বিশেষজ্ঞ রান্ডাল সার্ভেনি বলেন, সায়েন্স চ্যানেলের এই কাজটির ব্যাপারে তিনি অনেক অবাক হয়েছিলেন। কারণ তিনি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে মৌলিক কোনো কাজই করেননি। তারা (সায়েন্স চ্যানেল) এটাকে এমনভাবে দেখিয়েছে, যেন রান্ডাল সার্ভেনি এই বিষয়ে একটা বড় অগ্রগতি বা বিশেষ কিছু করেছেন। দুঃখজনকভাবে ব্যাপারটি এমন নয়। 

Screenshot: USA Today

আরেক অতিথি কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির স্যাটেলাইট আবহাওয়াবিদ স্টিভ মিলার বলেন,   আবহাওয়ার এই ধরণটিকে (ষড়ভুজাকৃতির মেঘ) বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যের জন্য দায়ী করা যায় না। এটি বিশ্বব্যাপী ঘটতে থাকা একটি সাধারণ ঘটনা। 

Screenshot: USA Today

এছাড়া মার্কিন গণমাধ্যম Washington Post এ ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর ‘The ‘Bermuda Triangle mystery’ isn’t solved, and this scientist didn’t suggest it was‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Washington Post

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, মাইক্রোবার্স্ট স্থলে মারাত্মক ধ্বংস সাধন এবং সাগরে জাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারে। অনুরূপভাবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলেও মাইক্রোবার্স্ট কিছু জাহাজ এবং বিমানকে ডুবিয়ে দিতে পারে। তার মানে এই না যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে এবং রান্ডাল সার্ভেনি এমনটি উল্লেখও করেননি।

Screenshot: Washington Post

প্রতিবেদনটিতে এ প্রসঙ্গে রান্ডাল সার্ভেনি বলেন, সায়েন্স চ্যানেলের ভিডিওটি মুক্তি দেওয়ার আগে তার দেখার ও সংশোধনী দেওয়ার সুযোগ হয়নি। অনুষ্ঠানটি দেখার আগ পর্যন্ত তিনি জানতেন না কি প্রচার করা হচ্ছে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে তার কোনো আগ্রহই নেই।

Screenshot: Washington Post

তিনি মূলত সায়েন্স চ্যানেলের অনুষ্ঠানটিতে ষড়ভুজাকৃতির মেঘ ও মাইক্রোবার্স্ট নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। যেটিকে পরবর্তীতে সায়েন্স চ্যানেলের অনুষ্ঠানটিতে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যের সমাধানের দাবিতে প্রচার করা হয়।

অপরদিকে কানাডা ভিত্তিক গণমাধ্যম National Post এ ২০১৬সালের ২৬ অক্টোবর এক ইমেইলের উত্তরে স্টিভ মিলার সায়েন্স চ্যানেলের অনুষ্ঠানটির সমালোচনা করে বলেন, সেখানে বিজ্ঞানীদের ভুলভাবে এবং পুরো বিষয়টিকেই চমকপ্রদ করে উপস্থাপন করা হয়েছে।

Screenshot: National Post

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল সম্পর্কে যা জানা যায় 

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল হল বারমুডা, পুয়ের্তো রিকো এবং ফ্লোরিডার দক্ষিণ প্রান্তের তিনটি “বিন্দু” এর সমন্বয়ে গড়ে উঠা সমুদ্রের ত্রিভুজাকার একটি অঞ্চল।

Screenshot: National Post

এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে জাহাজ ও বিমান অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মতো অস্বাভাবিক ঘটনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত। এসব ঘটনাকে বিভিন্ন সময়ে রহস্যজনক চৌম্বকক্ষেত্র, অতিপ্রাকৃত ঘটনা সহ নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল প্রকৃত অর্থে রহস্যময় কিছু নয়।

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্র বিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠান United States National Ocean Service জানায়, সমুদ্র সবসময়ই মানুষের কাছে রহস্যময়। আবহাওয়া খারাপ হলে সমুদ্র আরও ভয়ংকর হতে পারে। এটা সারা বিশ্বের জন্যই সত্য। পৃথিবীর অন্যান্য অংশের সমুদ্রের চেয়ে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে অধিক পরিমাণে জাহাজ অদৃশ্যের ঘটনা ঘটে এমন তথ্যের কোনো প্রমাণ নেই।

Screenshot: US National Ocean Service

এছাড়া ২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড (WWF) বিশ্বের মহাসাগরে সবচেয়ে বিপজ্জনক অঞ্চলগুলোর একটি তালিকা সম্বলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সে তালিকাতেও বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের জায়গা হয়নি। 

Screenshot: WWF

বরং তাদের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালের আগের শেষ দশকে সমুদ্রে সবচেয়ে বেশি জাহাজ দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরে। সংগঠনটির তালিকায় জায়গা পাওয়া স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়া, বিশেষ করে কোরাল ট্রায়াঙ্গেল, পূর্ব ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণসাগর, উত্তর সাগর ও ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ। 

এছাড়া কার্ল ক্রুজেলনিকি নামে একজন অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যম news.com.au কে ২০১৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে এমন কোনো রহস্য নেই যে তার সমাধান করতে হবে৷  কারণ এ অঞ্চলে ঘটা দূর্ঘটনাগুলো মানবিক ত্রুটির কারণে ঘটার সম্ভাবনাই বেশি।

Screenshot: News.com.au

তিনি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ইনস্যুরেন্স প্রতিষ্ঠান লয়েডস অব লন্ডন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ডের বরাতে আরও বলেন, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে নিখোঁজ হওয়া বিমানের সংখ্যা শতাংশের ভিত্তিতে বিশ্বের যে কোনও জায়গার সমান।

মূলত, ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল আমেরিকার সায়েন্স নামের একটি চ্যানেলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। অনুষ্ঠানটিতে দাবি করা হয়, মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার একটি স্যাটেলাইটে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের ষড়ভুজাকৃতির এমন কিছু মেঘ দেখা গিয়েছে, যা আরেকটি স্যাটেলাইটে উত্তর সাগরের উপরও দেখা গিয়েছে। এই ধরনের মেঘ  মাইক্রোবার্স্ট (microburst) নামক একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, যা শক্তিশালী বাতাস তৈরি করে। অনুষ্ঠানটিতে আমন্ত্রিত দুইজন বিশেষজ্ঞ অতিথির  এই মেঘ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে সায়েন্সে চ্যানেলটি এক পর্যায়ে দাবি করে, বিজ্ঞানীরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল রহস্যের সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। তবে রিউমর স্ক্যানারে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত দুইজন অতিথিই পরবর্তীতে একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জানান, তাদের বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে সায়েন্স চ্যানেলটি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল রহস্যের সমাধান খুঁজে পাওয়ার দাবিতে প্রচার করেছে।  

সুতরাং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল মেঘের কারণেই সৃষ্টি দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img