সংগীত শিল্পী সুস্মিতা আনিস প্রকাশিত জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সনটি কি প্রথম অর্কেস্ট্রা ভার্সন?

গত বছরের ডিসেম্বরে সঙ্গীত শিল্পী সুস্মিতা আনিস “বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের মহান জাতীয় সঙ্গীতের সর্বপ্রথম অর্কেস্ট্রা ভার্সন।” শীর্ষক শিরোনামে ১ম দাবি করে জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সন প্রকাশ করে।

Screenshot from Susmita anis facebook post

উক্ত বিষয়টি নিয়ে সেসময়ে গণমাধ্যমেও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের প্রথম অর্কেস্ট্রা ভার্সন উল্লেখ করে সংবাদ প্রচার করা হয়।

Screenshot from The Daily Star website

এছাড়া মূলধারার গণমাধ্যম সময় টিভির ওয়েবসাইটে একই দাবিতে একটি সংবাদ প্রচারিত হয়। 

তবে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী সেটিকে প্রথম অর্কেস্ট্রা ভার্সন নয় উল্লেখ করে লেখালেখি এবং মন্তব্য প্রকাশ করলে তা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় এবং বিষয়টির সত্যতা জানতে চেয়ে রিউমর স্ক্যানার টিমের নিকট ফ্যাক্টচেক অনুরোধ আসে। পরবর্তীতে ফ্যাক্টচেক অনুরোধ স্বাপেক্ষে এবং বিষয়টির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে এটি নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় রিউমর স্ক্যানার।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে সঙ্গীত শিল্পী সুস্মিতা আনিস কর্তৃক প্রকাশিত জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সনটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের প্রথম অর্কেস্ট্রা ভার্সন নয় বরং পূর্বেও একাধিক ব্যক্তি/সংগঠন জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সন নিয়ে কাজ করেছে এবং প্রকাশ করেছে।

কি-ওয়ার্ড সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ Banglapedia এর ওয়েবসাইটে সুরকার ও সংগীত পরিচালক সমর দাসের জীবনীতে ১৯৭২ সালে বিবিসির স্টুডিওতে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের অর্কেস্ট্রেশনের জন্য লন্ডন যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।

Screenshot from BanglaPedia website

একই বিষয়টি নিয়ে ২০১৪ সালে সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয় –

‘সমর দাস ১৯৭২ সালে বিবিসিতে গিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের অক্রেস্ট্রেশন রেকর্ড করে আনেন।’

Screenshot from Samakal website

কালের কন্ঠে ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে একই কথা উল্লেখ করা হয়।

The Daily Star এর একটি প্রতিবেদনে বিষয়টি নিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে-

যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  “আমার সোনার বাংলা” বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিল, সমর দাস তখন গানটিকে অর্কেস্ট্রেশনের জন্য পশ্চিমা স্বরলিপিতে প্রতিলিপি করেছিলেন, যেটি জাতীয় সঙ্গীতের জন্য প্রচলিত একটি ধারা।

Screenshot from The Daily Star website

এছাড়াও ২০১৬ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে

“১৯৭২ সাল। বাংলাদেশ নামে নতুন দেশটির জন্য একটি উপহার পাঠাল বিবিসি। সেটি হচ্ছে দেশটির জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রেশন। সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের আকারমাত্রিক স্বরলিপির ওপর ভিত্তি করে আগেই গানটির পাশ্চাত্য সুরলিপি বা স্টাফ নোটেশন লিখেছিলেন সংগীতজ্ঞ ভি. ভালসারা। অর্কেস্ট্রেশনের জন্য তাঁর কাছ থেকে ওই নোটেশনটি নিয়েছিলেন বিবিসি বাংলার কর্মী তৃপ্তি দাস। সেটি বাজিয়েই ধারণ করা হয় ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের অর্কেস্ট্রেশন। পাঠানো হয় বাংলাদেশে।

সে সময় জাতীয় সংগীত কমিটির প্রধান সংগীতজ্ঞ সমর দাস ওই অর্কেস্ট্রেশনের অনুমোদন দেননি। বরং বিবিসিকে তিনি জানিয়েছিলেন, এতে গন্ডগোল আছে। তাঁর উপস্থিতিতে নতুন করে অর্কেস্ট্রেশনটি করতে হবে। বিবিসি তখন সমর দাসকে নিয়ে যায় লন্ডনে। তাঁরই তত্ত্বাবধানে সে বছর ধারণ করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’র অর্কেস্ট্রেশন। “

Screenshot from Prothom Alo website

সেসময় অনুমোদিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সেই টেপটি যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বিবিসির বাংলা বিভাগের প্রধান মার্ক ডড।

২০১৪ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত অন্য একটি প্রতিবেদনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, বিশিষ্ট সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম এর একটি সাক্ষাৎকার পাওয়া যায়, সেখানে তিনি বলেন

“সমর দাস ভারত থেকে প্রথম আমাদের জাতীয় সংগীতের একটা অর্কেস্ট্রা তৈরি করে আনেন। তখন তাতে বাধা দিয়েছিলেন সন্জীদা খাতুন। তিনি বলেছিলেন সুর ভুল হয়েছে। কিন্তু তখন কেউ তাঁর বাধা শোনেননি। তবে শুদ্ধ সুরে জাতীয় সংগীত গাওয়ার ব্যাপারে সন্জীদা খাতুনের চেষ্টা অব্যাহত ছিল।”

২০১৫ সালের প্রথম আলোর আরেকটি প্রতিবেদনে কম্পোজার সানি জুবায়ের এর করা জাতীয় সংগীতের একটি পূর্ণ অর্কেস্ট্রা করার কথা বলা হয়।

উক্ত প্রতিবেদনে ব্লুজ কমিউনিকেশনসের পরিচালক ফরহাদুল ইসলাম এর বক্তব্য উল্লেখ করে বলা হয়-

“একসময় সংগীতকার সমর দাস যুক্তরাজ্য থেকে জাতীয় সংগীতের যে অর্কেস্ট্রা তৈরি করিয়ে এনেছিলেন, সেটি ছিল শুধু ব্রাসব্যান্ডের। পূর্ণাঙ্গ অর্কেস্ট্রার নোটেশন নয়। বিশ্ব অঙ্গনে, বড় আয়োজনে বাজানোর মতো পূর্ণ কোনো অর্কেস্ট্রা স্বরলিপি আমাদের হাতে ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কম্পোজিশন অনুসরণ করে সম্প্রতি জাতীয় সংগীতের জন্য অর্কেস্ট্রার স্টাফ নোটেশন করেছেন আমাদের দেশের কম্পোজার সানি জুবায়ের।

২০১৬ সালে একটি ইউটিউব চ্যানেলে ‘First ever Orchestra version of Bangladesh national enthumenthum’ শিরোনামে সানি জুবায়ের এর সেই অর্কেস্ট্রা ভার্সন এর ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।

এর পূর্বে বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংগীতের আন্তর্জাতিক সংগ্রহশালা ‘ন্যাশনাল এন্থেম অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রেশন ভার্সন কাভার করেছেন। ‘The Complete National anthem of the world‘ এর ২০১৩ সালের সংস্করণে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সনও খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot from Rapzh website

এছাড়াও ইউটিউবে অনুসন্ধানের মাধ্যমে বরেণ্য গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এর পূর্বে করা জাতীয় সংগীতের একটি অর্কেস্ট্রা পরিবেশন খুঁজে পাওয়া যায়।

অর্থাৎ, এটি নিশ্চিত যে সংগীত শিল্পি সুস্মিতা আনিসের গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রা প্রকাশ করার পূর্বেও বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সন নিয়ে কাজ হয়েছে।

প্রসঙ্গত, সংগীতশিল্পী সুস্মিতা আনিস গত ৯ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সন প্রকাশ করেন। অসাধারণ ভিডিওগ্রাফি এবং উপস্থাপনের কারণে তার জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রার কাজটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।

সুতরাং, সংগীত শিল্পি সুস্মিতা আনিস কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সনটি জাতীয় সংগীতের প্রথম অর্কেস্ট্রা ভার্সন বলা হলেও রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায় এটি সর্বপ্রথম নয় বরং এর আগেও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সন নিয়ে কাজ হয়েছে এবং তা প্রকাশিত হয়েছিলো।

আরও পড়ুন

spot_img