বাংলাদেশে মেয়েদের বাজারে যাওয়া নিষেধ জানিয়ে ফতোয়া জারির ভুল তথ্য ভারতীয় গণমাধ্যমে

সম্প্রতি, বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গায় মেয়েদের বাজারে যাওয়া নিষেধ জানিয়ে ফতোয়া জারি হয়েছে শীর্ষক দাবি করেছেন বিজেপির বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। তিনি গত ০৫ ডিসেম্বর তার ফেসবুক পেজ এবং এক্স অ্যাকাউন্টে একটি ভিডিও পোস্ট করে এই দাবি করেন৷ ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিনও গত ৩ ডিসেম্বর ফেসবুকে একই ভিডিওর মাধ্যমে এই দাবি তুলেছেন। 

ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে ভিডিওর এক জায়গায় বলতে শোনা যায়, এটা সাধারন কোনো মেলা না, এটা হলো দ্বীনি মাহফিল, দ্বীনি মাহফিলের পরিবেশ। এছাড়াও বলতে শোনা যায়, এখানে আমরা সওয়াব অর্জনের জন্য, সওয়াব কামাইয়ের জন্য এসেছি। হ্যা, আমাদের দুনিয়াবী ফায়দা হবে, বেচাকেনা করবো, হালাল ব্যবসা করবো কিন্তু কোনো গুণাহের কাজে জড়ানো যাবেনা।

পরবর্তীতে ভারতের একাধিক গণমাধ্যমেও একই ভিডিও ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে।

এ সংক্রান্ত ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন আজতক বাংলা (ইউটিউব), রিপাবলিক বাংলা (ইউটিউব), টিভি৯ বাংলা (ইউটিউব), জি২৪ ঘন্টা (ইউটিউব), ক্যালকাটা নিউজ (ইউটিউব), আর প্লাস (ইউটিউব), নিউজ এক্স। 

বাজারে

রিপাবলিক বাংলা’য় কলকাতার একজন গবেষক মৌমিতা চক্রবর্তীও একই দাবিতে করা মন্তব্য বিষয়টির কড়া সমালোচনা করেছেন। দেখুন ভিডিওটি।  

দাবিটি এক্সেও ব্যাপকভাবে প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গায় মেয়েদের বাজারে যাওয়ায় নিষেধ জানিয়ে ফতোয়া জারির দাবিটি সঠিক নয় বরং, গওহরডাঙ্গা মাদরাসার ৮৯তম মাহফিলে অস্থায়ী দোকানপাটে মহিলা প্রবেশ প্রসঙ্গে মাইকিংয়ের একটি ভিডিওর খন্ডিত অংশ দিয়ে আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে। তাছাড়া, এই মাহফিলে প্রতি বছরই এমন রীতি পালন হয়ে আসছে। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত দাবিটি পর্যলোচনা করে দেখা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গার বলে দাবি করা হয়েছে। এর সূত্রে ফেসবুকে ‘গওহরডাঙ্গা মাদরাসা’ নামের একটি পেজে গত ২৭ নভেম্বর ‘৮৯ তম বার্ষিক মাহফিলে দোকানদারদের উদ্দেশ্যে বিশেষ ঘোষণা।’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত মূল ভিডিওটি খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার। 

Screenshot: গওহরডাঙ্গা মাদরাসা (Facebook)

ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, ‘..এলাকার মধ্যে কোনো মহিলা প্রবেশ করবেনা। আমরা দোকানদার ভাইয়েরা কোনো মহিলার কাছে আগামিকাল থেকে কোনো কিছু বিক্রয় করবো না। কোনো জীব জানোয়ার বিক্রি করবো না। আমরা খেয়াল রাখবো এটা একটা দ্বীনি পরিবেশ, দ্বীনি মাহফিল, এটা সাধারণ কোনো মেলা না। যেখানে পশু পাখি বিক্রি হয়, যেখানে গুণাহর কাজ হয়, জুয়া হয় এইরকম পরিবেশ এটা নয়। এটা হলো আমাদের আখেরাতের সম্ভল, আখেরাতের অনুষ্ঠান, এখানে আমরা আখেরাত গড়তে এসেছি, সুতরাং এই মাহফিলে এই মার্কেট এলাকায় কোনো রকম কোনো জুয়া খেলা যাতে না হতে পারে আমরা খেয়াল রাখবো, জুয়া কেন্দ্রিক যা খেলা আছে সমস্ত খেলা এখানে করা যাবে না, এখানে নিষেধ। যদি এইরকম কোনো গ্রুপ পাওয়া যায় তাহলে আমরা তাদের বন্ধ করে দিব, তাও যদি না পারি স্বেচ্ছাসেবক দলের কাছে আমরা তাদের সমর্পণ করে দিব। দোকানদার ভাইদের দৃষ্টি আর্কষণ করা যাচ্ছে, আগামিকাল থেকে প্রত্যেক দোকানের সামনে পর্দার ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং সেই পর্দা প্রত্যেক নামাজের সময় ঝুলিয়ে দিতে হবে অর্থাৎ, প্রত্যেক নামাজের সময় বেচাকেনা বন্ধ থাকবে।” 

ভিডিওতে আরো বলতে শোনা যায়, দোকানদার ভাইদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাচ্ছে, আগামিকাল থেকে এই মার্কেট এলাকায় কোনো মহিলা প্রবেশ করবেনা। যদি কোনো মহিলা আসে আমরা তাদেরকে সুন্দর করে ‍বুঝিয়ে ফিরিয়ে দিব, তাদের কাছে আমরা কোনো কিছু কেনাবেচা করবো না। মার্কেট এলাকায় কোনোরকম কোনো জুয়া খেলা যাতে না হতে পারে আমরা সবাই দ্বীনি স্বার্থে নিজের আখেরাত গড়ার জন্য সেদিকে আমরা সজাগ দৃষ্টি রাখবো এটা সাধারণ কোনো মেলা না যেখানে জুয়া খেলা হয়, অনেক রকম, অনেক ধরনের গুণাহর কাজ হয় এইরকম এটা কোনো মেলা না। এটা হলো দ্বীনি মাহফিল, দ্বীনি মাহফিলের পরিবেশ। আমরা খেয়াল রাখবো কোনো ধরনের কোনো জীব জানোয়ার এই ধরনের কার্টুন, এই ধরনের পুতুল যা আছে আমরা এইগুলো বিক্রি করবো না। নিজেও বিক্রি করবো না এবং অন্যদেরকেও যারা বিক্রি করে তাদেরকে আমরা নিষেধ করে দিব। মাদরাসার এই ঘোষণা আমরা তাদেরকে শুনিয়ে দিব, এটা হলো একটি দ্বীনি পরিবেশ, দ্বীনি মাহফিল, এখানে আমরা সওয়াব অর্জনের জন্য, সওয়াব কামাইয়ের জন্য এসেছি। হ্যা, আমাদের দুনিয়াবী ফায়দা হবে, বেচাকেনা করবো, হালাল ব্যবসা করবো কিন্তু কোনো গুণাহের কাজে জড়ানো যাবেনা। দোকানদার ভাইদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাচ্ছে, আগামিকাল থেকে (একজন দোকানদারের উদ্দেশ্যে (হাতি) এগুলো বিক্রি করা যাবেনা) প্রত্যেক দোকানের সামনে পর্দা ঝোলানো..।”

ভিডিওটি পর্যালোচনা করে প্রতীয়মান হয়, এটি একটি মাহফিলে সাধারণত যে সব অস্থায়ী দোকানপাট বসেছে সেসবের দোকানীদের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়েছে, মহিলাদের কাছে কোনো কিছু বিক্রি না করতে এবং মহিলাদের মাহফিলের উদ্দেশ্যে বসা দোকানপাটে না আসতে। এছাড়াও, দোকানীদের জীব জন্তু বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন এবং জুয়া খেলা যাতে না হয় সেদিকেও দৃষ্টি দিতে বলেছেন। কিন্তু ভিডিওতে ফতোয়া জারি বা বাংলাদেশের বাজারে মেয়েদের যাওয়ায় নিষেধ শীর্ষক কোনো ঘোষণা ছিল না।

উক্ত ফেসবুক পেজটি পর্যবেক্ষণ করে গত ০৫ ডিসেম্বর ভারতীয় মিডিয়ার আলোচিত দাবি সম্বলিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন পোস্ট করে ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয়, ‘গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার 89 তম বার্ষিক মাহফিলের পূর্বের একটি ঘোষণা কেন্দ্র করে ইন্ডি.. টিভি চ্যানেল নিউজ করেছে। অরিজিনাল পুরো ভিডিওটি কমেন্টে রয়েছে।’ কমেন্টে দেওয়া ভিডিওটি মূলত ২৭ নভেম্বরের ভিডিওই।

Screenshot: গওহরডাঙ্গা মাদরাসা (Facebook)

এছাড়া, উক্ত ফেসবুক পেজে ০৮ ডিসেম্বর ভারতীয় মিডিয়ার দাবিটি সত্য নয় জানিয়ে যমুনা টিভির করা একটি প্রতিবেদন ভিডিও পোস্ট করে ক্যাপশনে একটি বিবৃতি দিয়েছেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার গওহরডাঙ্গা মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম মুফতি উসামা আমিন। 

Screenshot: গওহরডাঙ্গা মাদরাসা (Facebook)

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, “বিগত ২৭, ২৮ ও ২৯ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী গওহরডাঙ্গা মাদরাসার ৮৯তম মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ঐতিহ্যবাহী এই মাহফিলে লক্ষ লক্ষ তাওহিদি জনতার আগমন ঘটে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই মাহফিলে আসার একটি ঐতিহ্য রয়েছে। এতদাঞ্চলের মুসলিম জনসাধারণ এখান থেকে আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা ও সারা বছরের দ্বীনি খোরাক গ্রহণ করে থাকেন। মুসলিম নারীদের মাহফিলে অংশগ্রহণের সুবিধার্থে তাদের যাতায়াতের ভিন্ন রাস্তা ও বয়ান শোনার জন্য ভিন্ন বসার স্থানের ব্যবস্থা করে থাকে মাহফিল কর্তৃপক্ষ।” 

বিবৃতিতে জানানো হয়, “এই মাহফিলকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ও এলাকাবাসীর সম্মিলিত পরামর্শে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার লক্ষ্যে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত হল পুরুষ প্রাঙ্গনের অস্থায়ী দোকানপাটে শুধুমাত্র মাহফিলের তিন দিনের জন্য মহিলাদের নিরাপত্তার স্বার্থে, তাদের প্রবেশ নিষেধ থাকে। এই নিয়মের প্রেক্ষিতে মাহফিলের স্বেচ্ছাসেবকগণ অস্থায়ী দোকানপাটে ঘুরে ঘুরে মাইকিংয়ের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। যার একটি খন্ডিত ভিডিও চিত্র দিয়ে ভারতীয় কিছু নিউজ চ্যানেল ও পেশাদার কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের ব্যক্তি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে অপপ্রচার চালায়, মৌলবাদীরা বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে মহিলা প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার ফতোয়া জারি করেছে।” 

“অথচ ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এটা কোন বাজার নয় বরং অস্থায়ী কিছু দোকানপাট। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিদ্যমান আমাদের ভিডিও চিত্রে স্পষ্টভাবে মাইকে বলা হচ্ছে এই নিয়ম শুধু মাত্র তিন দিনের জন্য। যা এখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় দৃশ্যমাণ।

আমাদের ভিডিওটি এবং তাদের অপপ্রচারের অংশটুকু যদি কেউ মিলিয়ে দেখেন তাহলে যে কারোর কাছে বিষয়টি নিন্দনীয় ও হাস্যকর মনে হবে।” উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে। 

যমুনা টিভির এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে বলা হয়, প্রতিবছরই মাহফিলে এ সংক্রান্ত ঘোষণা দেওয়া হয়ে থাকে। যমুনা স্থানীয় বাজারে নারীদের চলাফেরার বিষয়টিও তুলে ধরেছে প্রতিবেদনে। একজন হিন্দু নারীকে বলতে শোনা যায়, বাজারে আসতে তারা কোনো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন না। 

রিউমর স্ক্যানার এ বিষয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছে। তারা ভারতীয় মিডিয়ায় প্রচারিত দাবিকে অসত্য বলে জানিয়েছেন।

সুতরাং, গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মাহফিলে অস্থায়ী দোকানপাটে মহিলা প্রবেশ প্রসঙ্গে মাইকিংয়ের একটি ভিডিওর খন্ডিত অংশ দিয়ে বাংলাদেশে মেয়েদের বাজারে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে ফতোয়া জারি শীর্ষক দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

  • গওহরডাঙ্গা মাদরাসা: Facebook Video
  • গওহরডাঙ্গা মাদরাসা: Facebook Video
  • গওহরডাঙ্গা মাদরাসা: Facebook Video & Statement
  • Rumor Scanner’s Own Analysis

আরও পড়ুন

spot_img