বাংলাদেশের পাঠ্যবইগুলোতে ভুলের প্রবণতার বিষয়টি বেশ কয়েক বছর ধরেই সমালোচিত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে নবম শ্রেণির ব্যাকরণ বইয়ের একটি তথ্যগত ভুল ধরা পড়েছে।
যে ভুল নিয়ে আলোচনা
মাধ্যমিকের নবম-দশম শ্রেণীর ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ পাঠ্যবইয়ের ১৯৪ নাম্বার পৃষ্ঠায় ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ নামক একটি প্রবন্ধে দাবি করা হয়েছে, “বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত সরকার ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা ইউনিয়নের আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে”।
একই দাবি দেখুন দাখিলের নবম-দশম শ্রেণীর ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ পাঠ্যবইয়ের ১৯৪ নাম্বার পৃষ্ঠায়৷
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় বৈদ্যনাথতলা ইউনিয়ন ছিল না বরং সে সময় এটি বাগোয়ান ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি গ্রাম ছিল।
কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে জাতীয় দৈনিক The Daily Star এর ওয়েবসাইটে গত ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “আজ ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দিনে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। পরে এই বৈদ্যনাথতলাকেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর হিসেবে নামকরণ করা হয়।”
পরবতীতে ‘বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন’ ওয়েবসাইটে মেহেরপুর জেলা বিষয়ক পাতায় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, মেহেরপুর। শিরোনামে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে লেখা রয়েছে, “১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মেহেরপুর সদর থানার (বর্তমান মুজিবনগর উপজেলা) বৈদ্যনাথতলা গ্রামের ঐতিহাসিক আম্রকাননে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।”
তাছাড়া, ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)’ এর ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “পরের দিন ১৭ এপ্রিল। মেহেরপুর মহকুমার বাগোয়ান ইউনিয়নের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে এ সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।”
অর্থাৎ, বৈদ্যনাথতলা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ইউনিয়ন ছিল না। বরং গ্রামটি বাগোয়ান ইউনিয়নের অন্তর্গত ছিল।
বৈদ্যনাথতলা থেকে মুজিবনগর
জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’ ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত মুজিবনগর থেকেই স্বাধীন সরকার শিরোনামের এক কলামে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পরামর্শক ও বিশেষ সহায়ক হিসেবে দায়িত্বপালনকারী এম আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের সূতিকাগার হচ্ছে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এই জায়গার নামকরণ করা হয় ‘মুজিবনগর’। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই স্থানের নাম ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করেন।”
মুজিবনগরকে পরবর্তীতে ২০০০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী উপজেলা হিসেবে উন্নীত করা হয়। আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে মুজিবনগর উপজেলা মেহেরপুর জেলায় অবস্থিত সবচেয়ে ছোট উপজেলা। এই উপজেলার অধীনে বাগোয়ান ইউনিয়নটিও রয়েছে। পূর্বে বাগোয়ান মেহেরপুর সদর উপজেলার অধীনে ছিল।
মূলত, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর সদর উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নেয়। সেদিনই বৈদ্যনাথতলা বদলে স্থানটির নাম রাখা হয় মুজিবনগর। কিন্তু নবম-দশম শ্রেণীর ব্যাকরণ পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বৈদ্যনাথতলাকে ইউনিয়ন দাবি করা হয়েছে, যা মিথ্যা।
উল্লেখ্য, বৈদ্যনাথ তলায় এক সময় বিশালাকার আম বাগান ছিল। আম বাগানটির মালিক ছিলেন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের ভবের পাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথ বাবু। বৈদ্যনাথ বাবুর নামানুসারেই দিনে দিনে জায়গাটির নাম হয়ে ওঠে বৈদ্যনাথ তলা।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তখনকার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নেয়। পাশাপাশি এ দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়।
সুতরাং, মুক্তিযুদ্ধের সময় বৈদ্যনাথতলা ইউনিয়ন থাকার দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- The Daily Star: ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
- বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন: মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, মেহেরপুর
- প্রথম আলো: মুজিবনগর থেকেই স্বাধীন সরকার
- বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস): বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের তিন সাক্ষি