সিঁড়ি থেকে পড়ে নয়, সলিমুল্লাহ মেডিকেলের শিক্ষার্থী অন্তর মারা যান হৃদরোগে

সম্প্রতি ‘সিঁড়ি থেকে পড়ে আহত সলিমুল্লাহ মেডিকেলের ছাত্রের মৃত্যু’ শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদন দেখুন প্রথম আলো, সমকাল

Screenshot from Samakal

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অন্তর রায় সিঁড়ি থেকে পড়ে আহত হয়ে মারা যাননি বরং অন্তর রায় জন্মগতভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং তার মৃত্যু হয়েছিল কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণে। 

অন্তরের মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে সত্যতা যাচাইয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম প্রথমেই অন্তরের একাধিক সহপাঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করে।

এদের মধ্যে অন্তরের সহপাঠী ও রুমমেট স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আকিব বসরী রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, ‘অন্তর জন্মগতভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত ছিল। এর আগেও ওর কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের হিস্ট্রি ছিল। গত ১৪ জানুয়ারি দুপুরে ক্লাসে যাওয়ার সময় ওর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে ওর শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিষ্ক্রিয় হয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়। এসময় সে কিছুটা আহত হলেও মাথায় কোনো ব্যথা পায়নি। পরবর্তীতে আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাকে সিপিআর দেয় এবং আইসিউতে ভর্তি করায়৷ আইসিউতে ও তিনদিন বেঁচে ছিল। পরবর্তীতে ১৮ জানুয়ারি রাত ২ টা ১৫ মিনিটের দিকে ওর দ্বিতীয়বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে ও আর ফিরে আসেনি।’

অন্তরের আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠী শেখ মুহাম্মদ মোশাহিদ বলেন, অন্তর রায় ক্যাম্পাসে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। অন্তরের সবকিছুই আমার জানা ছিল। অন্তরের হার্টের সমস্যাটা জন্মগত। অন্তরের এসএসসি পরীক্ষার কিছু সময় আগে ওর এ সমস্যাটা ধরা পড়ে। তখন থেকে ও হার্টের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিল। 

মোশাহিদ বলেন, ‘মেডিকেলে আমাদের ক্লাস শুরু হওয়ার পর অন্তর ও আমি আমাদের কলেজের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ খালেকুজ্জামানের কাছে যাই। তিনি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে অন্তরের মামাকে (বাবা না থাকায় অন্তরের অভিভাবক) দেখা করতে বলেন ও তার হার্টে একটা মেশিন স্থাপনের বিষয়ে বলেন। যেটা অনেক ব্যয়বহুল হওয়ায় অন্তর আপাতত আমাকে ওষুধের উপরই নির্ভর করার কথা বলে। যেটা প্রায় এক মাস আগের কথা। এরপর গত শনিবার (১৪ জানুয়ারি) আমি ও অন্তর একসাথেই হল থেকে বের হই ক্লাসে যাওয়ার জন্য। আমি একটু আগে আগে চলে আসি। ও তার রুমমেট আকিব বসরীর সাথে আসছিলো। এসময় তিন তলা থেকে দুই তলায় নামার সময় অন্তর কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ফলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। পরে আমরা অন্তরকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যাই। পরে সেখান থেকে চিকিৎসকেরা তাকে আইসিউতে নিয়ে যেতে বলে। সেখানে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা জানান তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে।’

মোশাহিদ আরও বলেন, এরপর তাকে আইসিউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এরপর ১৮ তারিখ রাত ২ টা ১৫ মিনিটের দিকে অন্তরের অবস্থা আবার খারাপ হয় এবং কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মারা যায়। গণমাধ্যমে তার মৃত্যু নিয়ে যে সংবাদগুলো হয়েছে সেগুলো সম্পূর্ণ ভুল।

অন্তরের আরেক বন্ধু রাকিবুল ইসলাম রিহাব রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, অন্তরের মৃত্যু নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদগুলো সঠিক নয়। অন্তরের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছিল। ও মারা গিয়েছে দ্বিতীয়বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণে৷

পাশাপাশি অন্তরের মৃত্যুর কারণ নিয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে দেওয়া তার মৃত্যুর প্রমাণপত্র সংক্রান্ত একটি নথিও রিউমর স্ক্যানারের হাতে এসেছে। 

নথিটি থেকে দেখা যায়, সেখানে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, নিউমোনিয়া ও সেপটিক শকের বিষয় উল্লেখ রয়েছে।

অন্তরের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে রিউমর স্ক্যানার টিম অন্তরের চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসক কাজী আলী আফতাবের সঙ্গেও যোগাযোগ করে।

তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, অন্তরের চিকিৎসার সাথে আমি প্রথম থেকেই ছিলাম। অন্তরের আগে থেকেই হার্টের সমস্যা অর্থাৎ কার্ডিওমায়োপ্যাথি ছিল। এর আগেও দুইবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। গত ১৪ জানুয়ারি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণে  ও অজ্ঞান হয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়। এরপর থেকে চিকিৎসাধীন ছিল এবং উন্নতির দিকেই ছিল। কিন্তু গত ১৮ জানুয়ারি আবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে সে মারা যায়। 

এছাড়া মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ওয়েবসাইট Medi Voice এ গত ১৮ জানুয়ারি “না ফেরার দেশে মেডিকেল শিক্ষার্থী অন্তর রায়” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot from Medivoice

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী (এসএস-৫০) অন্তর রায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মিডফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

Screenshot from Medivoice

প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, অন্তর ১৪ জানুয়ারি থেকে মিডফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল।

মূলত, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী (এসএস-৫০) অন্তর রায় জন্মগতভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন। গত ১৪ জানুয়ারি হল থেকে ক্লাস করতে যাওয়ার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে অন্তরের সহপাঠীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা জানান তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে এবং তাকে আইসিউতে ভর্তি করা হয়। সেখানেই  চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গত ১৮ জানুয়ারি পুনরায় তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে রাত ২ টা ৫০ মিনিটে মারা যান। অন্তরের মৃত্যুর এই ঘটনাটিকেই দেশের বেশকিছু গণমাধ্যমে তার হৃদরোগের কথা উল্লেখ ব্যতীত সিঁড়ি থেকে পড়ে আহত হয়ে মারা গিয়েছেন দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।

সুতরাং, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অন্তর রায়ের সিঁড়ি থেকে পড়ে আহত হয়ে মারা যাওয়ার দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যটি বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img