মদ শুল্কমুক্ত নয় এবং খেজুর আমদানিতে ২০৮ শতাংশ শুল্ক আরোপের দাবিটিও মিথ্যা

সম্প্রতি, “খেজুরে ২০৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ। মদ শুল্কমুক্ত” শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত এই বিষয়ে ভাইরাল একটি  ফেসবুক পোস্টে ৪৯ হাজার পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। এ পর্যন্ত পোস্টটি শেয়ার হয়েছে ১৪ হাজার বার। পোস্টটিতে মন্তব্যের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার পর্যন্ত পৌঁছেছে, এবং এর মধ্যে অধিকাংশ নেটিজেনই উক্ত দাবিকে সত্য ভেবে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে মদ শুল্কমুক্ত রেখে খেজুর আমদানিতে ২০৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়নি বরং পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে খেজুরের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। বর্তমানে খেজুর আমদানিতে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন শুল্ক ও করের মাধ্যমে প্রায় ৪৩ শতাংশ শুল্প-কর রিশোধ করতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে মদ আমদানির শুল্কহার ৫৯৬ থেকে ৬১১ শতাংশ।

খেজুর আমদানিতে কি ২০৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে?

খেজুরে ২০৮ শতাংশ শুল্ক আরোপের দাবির সত্যতা যাচাইয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে গত ০৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোতে “চাল, তেল, চিনি ও খেজুরের শুল্ক কমল” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে চাল, তেল, চিনি ও খেজুরের শুল্ক কমানো হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর আলাদা আলাদা প্রজ্ঞাপনে এসব পণ্যের বিভিন্ন পর্যায়ের শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিয়েছে।

এই প্রতিবেদনে খেজুর আমদানিতে শুল্ক সম্পর্কে জানা যায়, রোজার অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে। কমানোর আগে খেজুর আমদানিতে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ ছিল, তবে রমজানকে সামনে রেখে সেটি কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। খেজুর আমদানিকারকেরা ১০ শতাংশ কম শুল্কে আমদানির এ সুবিধা আগামী ৩০ মার্চ পর্যন্ত পাওয়া যাবে। 

Screenshot: Prothom Alo.

ফেব্রুয়ারির ০৮ তারিখ একই তথ্য প্রকাশ করেছে মূলধারার অন্যান্য গণমাধ্যমগুলো

এদিকে গত ০৫ মার্চ জাতীয় দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানায়, শুল্ক কমানোর আগে খেজুর আমদানিতে ব্যবসায়ীদের কাস্টমস শুল্কসহ মোট ৫৩ শতাংশের মতো বিভিন্ন শুল্ককর দিতে হতো। এর মধ্যে কাস্টমস শুল্ক পরিশোধ করতে হয় ২৫ শতাংশ, রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ এবং অগ্রিম কর ৫ শতাংশ দিতে হয়। সেখানে এখন অন্যান্য শুল্ককর ঠিক রেখে শুধু কাস্টমস শুল্ক কমানো হয়েছে ১৫ শতাংশ। তাই এখন খেজুর আমদানিতে শুল্ক কর পরিশোধ করতে হবে প্রায় ৪৩ শতাংশ।

Screenshot: Protidiner Bangladesh. 

অর্থাৎ, খেজুর আমদানিতে ২০৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার দাবিটি সঠিক নয়।

উল্লেখ্য, গত ১২ ফেব্রুয়ারি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফআইএ) জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কাস্টমস খেজুরের শুল্কায়নের জন্য যে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু (আমদানি মূল্য) নির্ধারণ করেছে, তার কারণেই খেজুরের দাম বাড়ছে বলে দাবি করেন। তারা এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজারের দাম অনুযায়ী শুল্কায়ন করার দাবি জানান। 

সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, প্রকৃত দামের ওপর অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ না করার কারণে আমদানিকারকদের অযৌক্তিকভাবে শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে। গত রোজার আগে মানভেদে প্রতি কেজি খেজুরে যেখানে শুল্ক দিতে হতো ৫.৪৫ টাকা থেকে ২১.৮৪ টাকা, সেটি এবার দাঁড়িয়েছে ৫৪ টাকা থেকে ২০৮ টাকা। 

তবে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফাইজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে খেজুরের দামের ওপর ভিত্তি করে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই বিদ্যমান অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালুকে অযৌক্তিক দাবি করার সুযোগ নেই। রমজান ঘিরে যে পরিমাণ খেজুর আমদানি হয়েছে তার ৯৫ শতাংশ ইতোমধ্যে খালাস হয়ে গেছে। 
বাংলাদেশে মদ আমদানি কি শুল্কমুক্ত?

অনুসন্ধানে জানা যায় বন্ড সুবিধায় দেশে ছয় ধরনের মদ বা অ্যালকোহল-জাতীয় পানীয় বাংলাদেশে আসে। আমদানি করা মদের মধ্যে রয়েছে- বিয়ার, স্পিরিট জাতীয় পানীয়, হুইস্কি, রাম ও টাফিয়া, গিন ও জেনিভা, ভদকা, লিকার’স ও করডিয়ালস। বন্ডের আওতায় ছয়টি লাইসেন্স রয়েছে।

মদ আমদানিতে শুল্কের বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশে মদ আমদানির শুল্কহার ৫৯৬ থেকে ৬১১ শতাংশ। অর্থাৎ, এক লিটার মদের দাম যদি ১০০ টাকা হয়, তাহলে বাংলাদেশে শুল্কসহ দাম দাঁড়াবে ৭০০ টাকার বেশি। বিয়ারের শুল্কহার ৪৪৩ শতাংশ। 

Screenshot: Prothom Alo. 

তবে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি নিয়ে বিদেশি কূটনীতিক ছাড়াও বিশেষ সুবিধাভোগী বিদেশি নাগরিক কূটনৈতিক বন্ডেড ওয়্যারহাউস থেকে ফুড স্টাফ (মদ, সিগারেট ও মদজাতীয় পণ্য) এবং অন্যান্য জিনিসপত্র শুল্কমুক্ত সুবিধায় কিনতে পারেন। কিন্তু লাইসেন্সপ্রাপ্ত কূটনৈতিক বন্ডেড ওয়্যারহাউস এই সুযোগের অপব্যবহার ও অনিয়ম করেছে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা এসব সিগারেট, মদ ও মাদক-জাতীয় পণ্য বিক্রি করে দেয়া হয় খোলাবাজারে।

অর্থাৎ, মদ আমদানি শুল্কমুক্ত হওয়ার দাবিটিও সঠিক নয়।

মূলত, বাংলাদেশে ১২ বা ১৩ মার্চ থেকে রোজা শুরু হতে পারে। এর প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে রোজার অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর আমদানিতে ২০৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে,অন্যদিকে মদ শুল্কমুক্ত রাখা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবি সত্য নয়। গত ০৮ ফেব্রুয়ারি পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে খেজুরের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। বর্তমানে খেজুর আমদানিতে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন শুল্ক ও করের মাধ্যমে প্রায় ৪৩ শতাংশ শুল্ক-কর রিশোধ করতে হবে, যা পূর্বে ৫৩ শতাংশ ছিল। পবিত্র রমজান সামনে রেখে আমদানির এ সুবিধা আগামী ৩০ মার্চ পর্যন্ত প্রযোজ্য থাকবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে মদ আমদানির শুল্কহার ৫৯৬ থেকে ৬১১ শতাংশ। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি নিয়ে বিদেশি কূটনীতিক সহ বিশেষ সুবিধাভোগী বিদেশি নাগরিক কূটনৈতিক বন্ডেড ওয়্যারহাউস থেকে ফুড স্টাফ (মদ, সিগারেট ও মদজাতীয় পণ্য) এবং অন্যান্য জিনিসপত্র শুল্কমুক্ত সুবিধায় কিনতে পারেন।

সুতরাং, মদ শুল্কমুক্ত রেখে খেজুর আমদানিতে ২০৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত বিষয়টি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

RS Team
RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img