আদম হাওয়া পাপ করল শীর্ষক পৃষ্ঠার ছবিটি শিক্ষাক্রমের কোনো পাঠ্য বইয়ের নয়

সম্প্রতি আদম হাওয়া পাপ করল শীর্ষক শিরোনামে একটি বইয়ের পৃষ্ঠার ছবিকে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম তথা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রণীত একাধিক বইয়ের পৃষ্ঠা দাবি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

দাবি ০১

আলোচিত বইয়ের পৃষ্ঠাটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রকাশিত তৃতীয় শ্রেণীর বইয়ের পৃষ্ঠার ছবি দাবিতে প্রচারিত ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এখানে, (আর্কাইভ)।

পাঠ্য বই

দাবি ০২

একই ছবিকে সপ্তম শ্রেণীর বইয়ের দাবিতে প্রচারিত ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

দাবি ০৩

নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণীর কথা উল্লেখ না করে বইটির মাধ্যমে দেশের স্কুলগুলোতে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে এমন দাবি করে ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

উক্ত দাবিগুলোতে টিকটকে প্রচারিত কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আদম হাওয়া পাপ করল শীর্ষক শিরোনামের বইয়ের পৃষ্ঠার ছবিটি এনসিটিবি কর্তৃক প্রণীত কোনো পাঠ্যবইয়ের নয় বরং, লাইট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২০২১ সালে সর্বশেষ বইটি প্রকাশ করেছিল যার সাথে এনসিটিবি বা দেশের শিক্ষাক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই।

অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ছবিটির উৎসের খোঁজ করার চেষ্টা চালিয়েছে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

ফেসবুকের মনিটরিং টুল এবং ম্যানুয়াল সার্চ করে আলোচিত ছবি সম্বলিত প্রথম পোস্টের সন্ধান মেলে গত বছর (২০২৩)।   আশরাফ আলী ফয়েজি (Ashraf Ali Foyji) নামে এক ব্যক্তি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত প্রথম পোস্ট (আর্কাইভ) করেন।

জনাব ফয়েজি তার পোস্টে দুইটি ছবি যুক্ত করেছেন। একটি আদম হাওয়া পাপ করল শীর্ষক শিরোনামের আলোচিত সেই পৃষ্ঠার ছবি আর অন্যটি এই পৃষ্ঠা যে বইতে রয়েছে তার ভেতরের পরিচিতি পাতার ছবি। 

এই পরিচিতি পাতা থেকে জানা যাচ্ছে,  বইটির নাম আলোর দিশারি, যা শিক্ষার্থীদের অনুশীলন বই হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বইটির প্রকাশনায় রয়েছে ‘লাইট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালে প্রথম প্রকাশ হওয়ার পর সর্বশেষ এটি প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের নভেম্বরে। বইটি কোন শ্রেণির সে বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ নেই এই পাতায়। 

জনাব ফয়েজি তার এই পোস্টের ক্যাপশনে লিখেছেন, “বাংলাদেশের মুসলমান নিষ্পাপ শিশুদেরকে এগুলো কি শিক্ষা দেওয়া হইতেছে? বিশেষ করে অশিক্ষিত অভিভাবক নিজের সন্তানকে বর্তমানে জেনারেল শিক্ষা দেওয়া থেকে বিরত রাখা ফরজ।” 

অর্থাৎ, তিনি ধরেই নিয়েছেন দেশের স্কুলগুলোতে এই বইটি পড়ানো হচ্ছে। 

তার পোস্টে একজন জানতে চেয়েছেন, এটি কোন স্কুলে পড়ানো হচ্ছে। জবাবে তিনি জানালেন, সেদিন সকালে বাসা থেকে বের হতেই তিনি দেখেন পাশের বাসার একটা মেয়ের হাতে এই বই। তিনি ভেবেছেন এটা নতুন বছরের বই। তখন এই ছবি দুটো তুলেছেন তিনি। 

Screenshot collage: Rumor Scanner 

অথচ, ডিসেম্বরে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই পৌঁছায় না। রেওয়াজ অনুযায়ী পহেলা জানুয়ারি বই উৎসবের মাধ্যমে সারা দেশে নতুন পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়। তাই জনাব ফয়েজির ভাবনা ভুল বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তাছাড়া, দেশের স্কুলগুলোতে যে সকল পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়ে থাকে সেসব বইয়ে স্পষ্ট করেই শ্রেণির নাম উল্লেখ থাকে। কিন্তু আলোচিত এই বইতে সেটির উল্লেখ নেই। 

‘লাইট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ নামক প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে অনুসন্ধানে বাংলাদেশি এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের বিষয়ে জানা যায়নি। 

আমরা পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত দাবিগুলো নিয়ে ধাপে ধাপে অনুসন্ধান করেছি। 

দাবি ০১: তৃতীয় শ্রেণির বইতে রয়েছে এই পৃষ্ঠা 

অনুসন্ধানে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রণীত ২০২৪ সালের তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ্যবইগুলো পর্যবেক্ষণ করে কোনো বইতেই আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পৃষ্ঠাটির উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

অর্থাৎ, আলোচিত পৃষ্ঠার ছবিটি তৃতীয় শ্রেণীর কোনো পাঠ্যবইয়ের নয়।

দাবি ০২: সপ্তম শ্রেণির বইতে রয়েছে এই পৃষ্ঠা 

অনুসন্ধানে এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত সপ্তম শ্রেণীর ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের সপ্তম শ্রেণীর (মাধ্যমিকদাখিল) বইগুলো পর্যবেক্ষণ করেও আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পৃষ্ঠাটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

অর্থাৎ, আলোচিত পৃষ্ঠার ছবিটি সপ্তম শ্রেণীর ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ের নয়।

দাবি ০৩: নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণীর কথা উল্লেখ না করে বইটির মাধ্যমে দেশের স্কুলগুলোতে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম তৃতীয় এবং সপ্তম শ্রেণি বাদে অন্য শ্রেণিগুলোর পাঠ্যবইগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে। এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় ও প্রাথমিক স্তরের সকল বই এবং মাধ্যমিক স্তর ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সকল বই পর্যবেক্ষণ করেও আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পৃষ্ঠাটির উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

তাছাড়া, এ সংক্রান্ত ছবিটি যেহেতু গত ডিসেম্বরে পোস্ট করা হয়েছে ফেসবুকে এবং বইটিতে দেখা যাচ্ছে এটি সর্বশেষ ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে, সেহেতু গেল বছর এবং ২০২১ সালের পাঠ্যবইগুলোও পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। কিন্তু উক্ত বছরগুলোর পাঠ্যবইতে প্রচারিত পৃষ্ঠাটির অস্তিত্ব মেলেনি। 

আলোচিত পৃষ্ঠার ছবিটির বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলছেন, আলোর দিশারি শিক্ষার্থীদের অনুশীলন বই-১ নামে এনসিটিবির কোনো বই নেই। এনসিটিবির বইয়ের তালিকা ওয়েবসাইটেই দেওয়া আছে। লাইট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সঙ্গেও এনসিটিবির কোনো সম্পর্ক নেই।

মূলত, আদম হাওয়া পাপ করল শীর্ষক শিরোনামের একটি বইয়ের পৃষ্ঠার ছবি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রকাশিত বইয়ের পৃষ্ঠার ছবি দাবি করে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২৩ সালে প্রথম ছড়িয়ে পড়া এই বইয়ের ছবিটির সাথে দেশের শিক্ষাক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। আলোচিত বইয়ের ছবিটিও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রকাশিত কোনো বইয়ের নয়। প্রকৃতপক্ষে, বইটি ‘লাইট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০২১ সালে সর্বশেষ প্রকাশিত হয়েছিল।

সুতরাং, আদম হাওয়া পাপ করল শীর্ষক শিরোনামের একটি বইয়ের পৃষ্ঠার ছবি  এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত বইয়ের পৃষ্ঠার ছবি দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img