“বাংলাদেশের ৬৮ হাজার নারীকে ভারতের যৌন পল্লীতে বিক্রি” শীর্ষক ফটোকার্ড প্রকাশ করেনি কোনো গণমাধ্যম

সম্প্রতি “বাংলাদেশের ৬৮ হাজার নারীকে ভারতের যৌন পল্লীতে বিক্রি” শীর্ষক একটি সংবাদ সম্বলিত ফটোকার্ড দেশের দুই বেসরকারি গণমাধ্যম যমুনা টিভি ও সময় টিভি প্রকাশ করেছে দাবিতে অসংখ্য পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।  

এছাড়া, বিবিসি বাংলা’য় ২০২২ সালে প্রায় একই প্রসঙ্গে প্রকাশিত একটি সংবাদের বরাত দিয়ে দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশের ১৪ হাজার নারীকে ভারতের যৌন পল্লীতে বিক্রি করা হয়েছে। 

৬৮ হাজার নারীকে ভারতের

সময় টিভি সম্পর্কিত আলোচিত দাবির ফেসবুক পোস্টগুলো দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

যমুনা টিভি সম্পর্কিত আলোচিত দাবির ফেসবুক পোস্টগুলো দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

বিবিসি বাংলা সম্পর্কিত আলোচিত দাবির ফেসবুক পোস্টগুলো দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

আলোচিত দাবি সম্বলিত ফটোকার্ড নিয়ে ইউটিউবের ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

একই দাবি সম্বলিত ফটোকার্ড নিয়ে টিকটকে ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সময় বা যমুনা টিভি “বাংলাদেশের ৬৮ হাজার নারীকে ভারতের যৌন পল্লীতে বিক্রি” শীর্ষক কোনো ফটোকার্ড প্রকাশ করেনি এমনকি এ সংক্রান্ত কোনো সংবাদ অন্য গণমাধ্যমেও সম্প্রতি আসেনি। তাছাড়া, বিবিসি বাংলার আলোচিত প্রতিবেদনেও ১৪ হাজার বাংলাদেশি নয়, বলা হয়েছে প্রায় চারশ বাংলাদেশি নারীকে ভারতের যৌন পল্লীতে বিক্রি করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত দুই ফটোকার্ড যে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে তাদের অর্থাৎ সময় টিভি ও যমুনা টিভির ফেসবুক পেজে এ সংক্রান্ত কোনো ফটোকার্ড প্রকাশ করা হয়েছে তা খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় রিউমর স্ক্যানার। গণমাধ্যম দুইটির কথিত এই ফটোকার্ড দুইটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এতে ফটোকার্ডগুলো প্রকাশের তারিখ গত ২২ এপ্রিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সূত্র ধরে শুরুতে সময় টিভি এবং পরে যমুনা টিভির ফেসবুক পেজ পর্যবেক্ষণ করে এ সংক্রান্ত কোনো ফটোকার্ডের অস্তিত্ব মেলেনি। এমনকি এই দুই গণমাধ্যমের প্রচলিত যে ফটোকার্ড রয়েছে সেগুলোতে থাকা উপাদান যেমন ফন্ট, কালার গ্রেডিংসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোতেও বেশ অমিল পাওয়া গেছে ছড়িয়ে পড়া ফটোকার্ডগুলোর সাথে। 

আমরা এই দুই গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন কিওয়ার্ড সার্চ করে দেখেছি। কিন্তু সময় বা যমুনার ওয়েবসাইটে গত কিছুদিনের মধ্যে এমন কোনো সংবাদ প্রকাশ হতে দেখা যায়নি। 

এ বিষয়ে জানতে এই দুই গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের সাথেও কথা বলেছে রিউমর স্ক্যানার। সময় টিভির জয়েন্ট নিউজ এডিটর মামুন শেখ জানিয়েছেন, “আমাদের হাউজ থেকে এরকম কোনো নিউজ করা হয়নি। এমন কোনো তথ্যও আমাদের জানা নাই।” 

যমুনা টিভির কথিত ফটোকার্ড নিয়েও প্রায় একই তথ্য দিয়েছেন গণমাধ্যমটির নিউ মিডিয়া এডিটর রুবেল মাহমুদ। তিনি বলছেন, তাদের ব্যবহৃত ফন্টের সাথে এই ফটোকার্ডের ফন্টের মিল নেই। 

অর্থাৎ, দেশের প্রথম সারির দুই গণমাধ্যমকে জড়িয়ে কথিত একটি সংবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। 

আমরা এই সংবাদ অন্যান্য গণমাধ্যমেও প্রকাশ হয়েছে কিনা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এমন কোনো খবরের হদিস মেলেনি। 

তবে প্রায়ই এ সংক্রান্ত নানা খবর গণমাধ্যমে প্রচার হয়ে আসতে দেখে আসছে রিউমর স্ক্যানার। যেমন, গত জানুয়ারিতে জাতীয় দৈনিক ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক ভিডিও প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর হাজার হাজার মেয়েকে উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার করা হয় যৌনকর্মী হিসেবে। 

জাতীয় আরেক দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় গত বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে ভারতে পাচার করা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার নারী। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার নারীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

ভারতের যৌন পল্লীতে বাংলাদেশি নারীদের পাচার হওয়া প্রসঙ্গে বিগত বছরগুলোর আরো কিছু সংবাদ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে। 

অন্যদিকে, বিবিসি বাংলার ২০২২ সালের  যে সংবাদের বরাতে বাংলাদেশের ১৪ হাজার নারীকে ভারতের যৌন পল্লীতে বিক্রি করা হয়েছে শীর্ষক দাবি করা হচ্ছে সে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে আমরা সংবাদ প্রতিবেদনটি খুঁজে বের করেছি। ভারতে পাচারের শিকার ১৪ হাজার নারীকে দিয়ে যেভাবে চলছিল যৌন ব্যবসা শীর্ষক শিরোনামের এই সংবাদটি বিবিসি বাংলা প্রকাশ করে ২০২২ সালের ০৮ ডিসেম্বর। প্রতিবেদনে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ, নেপাল, থাইল্যান্ড, রাশিয়া আর উজবেকিস্তান থেকেও নারীদের নিয়ে আসা হত খরিদ্দারকে সন্তুষ্ট করার জন্য। এরা মিলে চক্রটির সাথে জড়িয়ে ছিল প্রায় ১৪ হাজারেরও বেশি নারী। বিবিসি লিখেছে, তাদের প্রায় অর্ধেকই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা।

প্রতিবেদনে এটাও উল্লেখ আছে যে, বাংলাদেশি নারীদের সংখ্যাটা প্রায় শ চারেক বলে মনে করা হয়। 

অর্থাৎ, বাংলাদেশের ১৪ হাজার নারীকে ভারতের যৌন পল্লীতে বিক্রি করা হয়েছে দাবিতে নিজেদের প্রতিবেদনে কোনো তথ্য দেয়নি বিবিসি বাংলা। বরং লিখেছে যে বাংলাদেশিদের সংখ্যাটা এদের মধ্যে ৪০০ এর মতো। 

মূলত, সম্প্রতি “বাংলাদেশের ৬৮ হাজার নারীকে ভারতের যৌন পল্লীতে বিক্রি” শিরোনামের একটি সংবাদ সম্বলিত ফটোকার্ড দেশের দুই বেসরকারি গণমাধ্যম যমুনা টিভি ও সময় টিভি প্রকাশ করেছে শীর্ষক দাবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লেও রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দাবিটির পক্ষে সত্যতা মেলেনি। গণমাধ্যম দুইটির পক্ষ থেকেও বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া, প্রায় একই সময়ে বিবিসি বাংলা’য় ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি সংবাদের বরাত দিয়ে দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশের ১৪ হাজার নারীকে ভারতের যৌন পল্লীতে বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু বিবিসি বাংলার উক্ত প্রতিবেদনেই উল্লেখ আছে যে, এই ১৪ হাজার নারীর মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ৪০০ জন। 

সুতরাং, “বাংলাদেশের ৬৮ হাজার নারীকে ভারতের যৌন পল্লীতে বিক্রি” শিরোনামের একটি সংবাদ সম্বলিত ফটোকার্ড যমুনা টিভি ও সময় টিভি প্রকাশ করেছে শীর্ষক দাবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে;  যা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং উক্ত ফটোকার্ডগুলোও ভুয়া। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img