ছবিটি ৩২ বছর আগে মারা যাওয়া কোনো ব্যক্তির অক্ষত মৃতদেহের নয়

“তিনি ৩২ বছর আগে মারা গিয়েছিলেন,যখন তাকে কবর থেকে উঠানো হয় মনে হচ্ছিলো, তিনি কয়েক ঘন্টা আগে ঘুমিয়েছিলেন, এটি সম্মানজনক মৃত” শীর্ষক তথ্য সম্বলিত এক ব্যক্তির ছবি বিগত কয়েক বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্লাটফর্মে প্রচার হয়ে আসছে।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

একই দাবিতে ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিও দেখুন এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছবির ব্যক্তিকে ৩২ বছর আগে মারা যাওয়া অক্ষত মৃতদেহ দাবিটি সত্য নয় বরং ২০১৯ সালে বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হওয়ার পর ওই ব্যক্তিকে বাঁচাতে মাটিচাপা দেওয়ার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

অনুসন্ধানেপাকিস্তানের সামাজিক কর্মী ও লেখক আলী সেরাজি (Ali Sherazi) এর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ২০১৯ সালের ২২ জুন আলোচিত ছবিগুলো যুক্ত করে উর্দু ভাষায় লেখা একটি পোস্ট (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত পোস্ট থেকে জানা যায়, আলী সেরাজিকে এক নারী উক্ত ছবিগুলো পাঠিয়েছেন। ওই নারী জানিয়েছেন, ‘ছবিগুলো তার বাবার। তার বাবা বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়েছেন এবং অচেতন অবস্থায় রয়েছেন। আলী সেরাজিকে ওই নারী তার বাবার জন্য দোয়া করতে বলেছেন।’

এই বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিতে আলী সেরাজির সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। তিনি ঘটনাটি সত্য জানিয়ে বলেন, সে সময় উক্ত নারী তার বাবার জন্য দোয়া চেয়ে তাকে উক্ত ছবিগুলো ইনবক্সে পাঠিয়েছিলেন।

রিউমর স্ক্যানার সেই নারীকে শনাক্ত করতে না পারলেও আলী সেরাজির সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয় যে, ঐ ব্যক্তি ৩২ বছর আগে মারা যান নি এবং এটি কোনো মৃতদেহও নয়।

গুজবের সূত্রপাত

কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে ফেসবুকে ২০১৯ সালের ৯ জুলাই Mahabub Alam নামক অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত একটি পোস্টে (আর্কাইভ) আলোচিত ছবিগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। পোস্টে উল্লেখ করা হয়, “এই আশেকে রাসুলটি পাকিস্তানের, প্রায় ৩২ বছর আগে মারা গিয়েছিলো, যেমনি মারা গেছে তেমনি রয়ে গেছে, বৃষ্টির কারণে কবরটা ভেঙ্গে গিয়েছে তাই দ্বিতীয় বারের মতন দাফন দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেহটাকে মাটি স্পর্শ করেনি কিন্তু কাফনের কাপড় গুলো মাটিতে নষ্ট হয়ে গেছে তাই নিচের অংশটুকু মাটি দিয়ে সতর ডাকা দিয়ে রেখেছে।”

মূলত এই পোস্টের পরই উক্ত ছবি এবং ৩২ বছর পরও অক্ষত মৃতদেহ বিষয়ক দাবিটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে৷

এই বিষয়ের সত্যতা জানতে Mahabub Alam এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে রিউমর স্ক্যানার। কিন্তু এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো সারা পাওয়া যায়নি।

ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে কী জানা যাচ্ছে?

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এ সংক্রান্ত পোস্টগুলোতে মূলত দুইটি ছবি রয়েছে। প্রথম ছবিতে দেখা যায়, এক ব্যক্তিকে মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মাথা ব্যতীত শরীরের বাকি অংশ মাটি দিয়ে ঢাকা থাকতে দেখা যায় ছবিতে। চোখ বন্ধ থাকায় তাকে মৃত বা অচেতন বলে মনে হচ্ছে। তাকে ঘিরে আশেপাশে মানুষের ভীড়ও দেখা যাচ্ছে। জীবিত মানুষের মতো শারীরিক গড়ন দেখে এটিকে বহু বছরের মৃতদেহ হওয়ার দাবিকে মিথ্যা বলেই মনে হতে পারে যে কারো। 

Screenshot source : Facebook

দ্বিতীয় আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, একই ব্যক্তিকে ধরে রেখেছেন দুই ব্যক্তি। পাশে ছোট একটি হাড়ি রাখা। ছবি দেখে মনে হতে পারে, ঐ ব্যক্তিকে কোনো সেবা শুশ্রূষা করা হচ্ছে। 

Screenshot source : Facebook

যেভাবে এগিয়েছে অনুসন্ধান

ছবিগুলো বিশ্লেষণ করার পর প্রাপ্ত তথ্য ধরে কিওয়ার্ড সার্চ করে দেশীয় ও  আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এ সংক্রান্ত কোনো সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায় নি। রিউমর স্ক্যানার টিম উক্ত দাবির সত্যতা যাচাইয়ে একাধিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্লাটফর্মেও খুঁজে দেখে।

অনুসন্ধানে মাইক্রোব্লগিং ওয়েবসাইট টুইটারে ২০১৯ সালের ২৩ জুন True Journalism নামক একটি অ্যাকাউন্টে আলোচিত ছবিগুলোসহ একটি টুইট (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়৷ উর্দু ভাষায় লেখা ঐ টুইটে টুইটকারী জানান, “একজন বোন সকাল থেকে বারবার মেসেজ দিচ্ছেন যে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে, আমার বাবা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছেন এবং তিনি অচেতন  রয়েছেন। আপনাদের সবাইকে আমার আব্বুর জন্য দোয়া করতে বলুন। ঈশ্বরের জন্য দয়া করে. আল্লাহ আমার বাবাকে সুস্থ করে দিন।” 

এই টুইটের তথ্যগুলোর সূত্র ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আগের দিন অর্থাৎ ২০১৯ সালের ২২ জুন ফেসবুকে আলী সেরাজির পোস্টটি খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম। এই পোস্টের সাথে True journalism এর টুইটের হুবহু মিল পাওয়া যায়।

পরবর্তীতে আলী সেরাজির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে ঘটনাটির সত্যতা নিশ্চিত করেন। রিউমর স্ক্যানার টিম পরবর্তীতে ঐ ব্যক্তির মেয়েকে (যিনি তার বাবার ছবি পাঠিয়েছিলেন আলী সেরাজিকে) খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। তবে ঐ নারীকে শনাক্ত করা যায় নি।

আলী সেরাজির সাথে কথা বলে এটা নিশ্চিত করা গেছে যে, ঐ ব্যক্তি ৩২ বছর আগে মারা যান নি এবং এটি কোনো মৃতদেহও নয়। কিন্তু বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হলে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে ঐ ব্যক্তিকে মাটিতে শুইয়ে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল কেন – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অনুসন্ধানে নামে রিউমর স্ক্যানার।

জীবন্ত দেহকে মাটিতে পুঁতে রাখা বনাম বিদ্যুৎপৃষ্ঠ ব্যক্তি 

অনুসন্ধানে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম Daily Mail এর ওয়েবসাইটে ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “ভারতের উত্তর প্রদেশে ৩৪ বছর বয়সী এক নারী বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হওয়ার পর তাকে ৭২ ঘন্টা কাদা মাটিতে চাপা (পুঁতে) দিয়ে রাখা হয়। পরবর্তীতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।” উক্ত এলাকার স্থানীয় এক বাসিন্দা ডেইলি মেইল’কে বলেছে, “আমরা এই পদ্ধতিতে অনেক মানুষ ও প্রাণীর চিকিৎসা করেছি। এটা আমাদের জন্য নতুন নয়।”

তিনি মনে করেন, বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হওয়া ব্যক্তিদের জন্য কাদাই একমাত্র চিকিৎসা। ডাক্তাররা পোড়ার উপর যে ক্রিমগুলো প্রয়োগ করেন তাতে একই ঔষধি গুণ রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

Screenshot source : Daily Mail

ইউটিউবে ভারতীয় চ্যানেল Loksatta Live এ ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি ভিডিওতে একই ধরনের ঘটনার একটি ভিডিও ক্লিপ খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওতে দেখা যায়, উত্তর ভারতে বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হওয়া এক ব্যক্তিকে মাটি চাপা দিয়ে রেখে হাত ও পা ঘষছে কিছু যুবক। 

Screenshot source : Youtube

২০২০ সালের ৯ মার্চ ভারতীয় সংবাদমাধ্যম The Times of India প্রকাশিত এ সংক্রান্ত আরেকটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে দেশটির উত্তর প্রদেশের বারেইল্লি গ্রামের একই ধরনের একটি ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হওয়ার পর কোনো ব্যক্তিকে মাটি চাপা দিয়ে রাখা এই অঞ্চলে একটি পুরোনো ঐতিহ্যবাহী থেরাপি।

সংবাদমাধ্যমটিকে ঐ গ্রামের প্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা ডাঃ ভিনেত শুক্লা বলেছেন, “এটি একটি ভুল রীতি। এর মাধ্যমে ভুক্তভোগীর জীবন সংকটে পড়ার শঙ্কা থাকে। এই ধরনের সমস্যায় হার্ট প্রথমে আক্রান্ত হয়। আমরা তাই শুরুতে সিপিআর নামের একটি পদ্ধতি ব্যবহার করি।

Screenshot source : TOI

পাকিস্তানেও এই রীতির প্রচলন দেখা যায়। দেশটির পাঞ্জাবের Ali Hussain General Hospital এর ফেসবুক পেজে ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। পোস্টে সংযুক্ত ছবিতে দেখা যায়, এক ব্যক্তিকে আংশিক মাটি চাপা দিয়ে রেখে আশেপাশে লোকজন ঘিরে রেখেছে। এই ধরনের রীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়টি উল্লেখ করে পোস্টে বলা হয়, “বিদ্যুৎস্পৃষ্ট রোগীকে মাটিতে চাপা দেওয়া অবিবেচনাপূর্ণ এবং বোকামি। বৈদ্যুতিক তার কেটে অন্য অংশে যেমন কারেন্ট থাকে না, তেমনি মানবদেহে কারেন্ট থাকে না। তাই জনগণকে অনুরোধ করা হচ্ছে, এই ধরনের রোগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে স্থানান্তর করা উচিত।”

Screenshot source : Facebook

পাকিস্তানের সরকারি সংস্থা The National Electric Power Regulatory Authority (NEPRA) তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া এক সতর্কবার্তায় বলেছে, ভুক্তভোগীকে মাটিচাপা দিয়ে চিকিৎসা করা উচিত নয়। এতে করে মূল্যবান সময়ের অপচয় হয় এবং মেডিকেল চিকিৎসার অভাবে রোগী মারাও যেতে পারে।

Screenshot source : NEPRA

মূলত, পাকিস্তানি লেখক আলী সেরাজিকে ২০১৯ সালে এক নারী তার বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হওয়া বাবাকে মাটিচাপা দিয়ে রাখার কিছু ছবি পাঠিয়ে দোয়া চান। আলী সেই ছবিগুলো তার পেজে প্রকাশ করার পর থেকে বিগত বছরগুলোয় ছবিগুলোকে ৩২ বছর আগে মারা যাওয়া ব্যক্তির অক্ষত মৃতদেহ বলে দাবি করা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

উল্লেখ্য, একই দাবির বিষয়ে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান Fact cresendo এর শ্রীলঙ্কা শাখা চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারী এবং আফগানিস্তান শাখা ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু কোনো প্রতিবেদনই ঘটনাটির মূল উৎস খুঁজে পায় নি। 

প্রসঙ্গত, বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হওয়া ঐ ব্যক্তির পরবর্তী শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি রিউমর স্ক্যানার। 

সুতরাং, ৩২ বছর আগে মারা যাওয়ার ব্যক্তির অক্ষত মৃতদেহ দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img