গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বরাবরই রাজনীতির ময়দান বেশ সরব৷ দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) – এই প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তা এবং জনসমর্থনে ভর করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে রাজনীতিতে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় দেখেছে। সময়ে সময়ে একাধিক রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটলেও এই দুই দলের মতো কোনো দলই বড় স্কেলে জনসমর্থন আদায় করতে পারেনি। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বছর বছর এই দুই দলই রাজনীতির মাঠকে সামনে থেকে গরম রেখেছেন। ২০২৩ সালও তার ব্যতিক্রম ছিল না৷ এমনিতে সকলেরই জানা ছিল, পরের বছরই (২০২৪) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই তাই বছরজুড়ে উত্তাল এক সময় দেখেছে বাংলাদেশের রাজনীতি।
রাজনীতিতে গুজবের প্রচারণা প্রতিপক্ষকে দমিয়ে দেয়ার এক পুরোনো কৌশল। সেই কৌশল কাজে লাগিয়ে পক্ষে বিপক্ষে বরাবরই গুজবের প্রচলন ছিল তৃতীয় বিশ্বের এই দেশটিতে। তবে সময়ের সাথে এই প্রচলন যেন মহামারির রূপ নিচ্ছে। না হলে ২০২২ সালে যেখানে রাজনৈতিক বিষয়ে মাত্র ৯২টি গুজব প্রচারের প্রমাণ পেয়েছিল রিউমর স্ক্যানার, ঠিক পরের বছর কিনা সে সংখ্যাটা সাড়ে ছয় গুণ বেড়ে ৫৯৭ তে গিয়ে ঠেকলো! যেহেতু পরের বছরই নির্বাচন, তাই আমাদের কাছে মনে হয়েছিল ২০২৩ সালে রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচনকেন্দ্রিক ভুল তথ্য প্রচারের হার বাড়বে। আমরা তাই বিষয়টিতে তীক্ষ্ণ নজরই রেখেছিলাম। এর ফলে আমরা দেখেছি, ছড়িয়ে পড়া ৫৯৭টি ভুল তথ্যের মধ্যে ৩২০টিই ছিল সংসদ নির্বাচন কেন্দ্রিক। অর্থাৎ, রাজনৈতিক ভুল তথ্যের মোট সংখ্যার ৫৪ শতাংশই নির্বাচন কেন্দ্রিক ছিল।

রাজনৈতিক গুজবের সংখ্যা বেড়েছে লাফিয়ে
২০২৩ সালের শুরুর মাস অর্থাৎ জানুয়ারিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে খুব একটা ভুল তথ্য প্রচারের প্রবণতা দেখিনি আমরা। সে মাসে মোট ভুল তথ্যের মাত্র ১১ শতাংশ ছিল রাজনীতি কেন্দ্রিক গুজব। পরের মাসে এই হার আরও কমেছে (৯ শতাংশ)। পরের সাত মাসে ক্রমেই এই হার বেড়েছে। অক্টোবরে হার কিছুটা কমলেও পরের দুই মাস বাড়তির দিকেই ছিল রাজনৈতিক গুজব। এর পেছনে ২৮ অক্টোবরের ঘটনাপ্রবাহ এক বড় কারণ বলে মনে হয়েছে আমাদের কাছে।
বিদায়ী বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশকে ঘিরে সৃষ্ট উত্তপ্ত পরিস্থিতির ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়া ৪০টি ভুল তথ্য (লিঙ্ক) শনাক্ত করেছিল রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে ২৮ অক্টোবর একদিনেই ১২টি ভুল তথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার। গেল বছরে কোনো ঘটনায় একদিনে এটিই ছিল সর্বোচ্চ ভুল তথ্য ছড়ানোর সংখ্যা। পরবর্তীতে এর রেশ পরের দুই মাসেও গড়িয়েছে।
তবে মাসভিত্তিক গুজবের সংখ্যায় উঠানামা থাকলেও ত্রৈমাসিক ভিত্তিক পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে, দেশে গেল বছর রাজনৈতিক গুজব ছড়ানোর প্রবণতা কখনোই কমতির দিকে যায়নি। প্রথম তিন মাসে ৪৭টি গুজব ছিল রাজনীতি কেন্দ্রিক। ১ম তিন মাসের তুলনায় ২য় তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) রাজনৈতিক গুজব প্রচারের হার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১২১ শতাংশ (১০৪টি)। তৃতীয় তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে রাজনৈতিক গুজব ছড়িয়েছে ১৭৬টি, যা পূর্বের তিন মাসের তুলনায় প্রায় ৬৯ শতাংশ বেশি। তবে এই হার মহামারি আকারে বেড়েছে পরের তিন মাসে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে নভেম্বরে। এ সময়ে ২৭০টি রাজনৈতিক গুজব শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার যা পূর্বের তিন মাস থেকে প্রায় ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। তবে এটির ভয়াবহ রূপ বোঝা যায় প্রথম তিন মাসের সাথে তুলনায়। প্রথম তিন মাসের তুলনায় শেষ তিন মাসে রাজনৈতিক গুজব ছড়িয়ে পড়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪৭৪ শতাংশ।

কারা ছিলেন রাজনৈতিক গুজবের টার্গেটে?
রিউমর স্ক্যানার টিম ২০২৩ সালে রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়ানো ভুল তথ্যগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে, এ সময়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক (১২১টি) ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে, যা মোট রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ২০ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতি তিনদিনে তিনি গড়ে একটি করে গুজবের শিকার হয়েছেন।
এই তালিকায় পরের অবস্থানে পাওয়া যাচ্ছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম, তার বিষয়ে ৩১টি গুজব প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। পরের অবস্থানেও বিএনপির আরেকজন রয়েছেন, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার বিষয়ে ৩০টি গুজব প্রচার করা হয়েছে। এই তালিকায় পরের অবস্থানগুলোতে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন, মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসিপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেত্রী রুমিন ফারহানা এবং প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।
এর বাইরে বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালকে জড়িয়ে ১৯টি এবং কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিরো আলমের বিষয়ে ২০টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। তাছাড়া, নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে ১২টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।

গুজবের রোষানল থেকে রক্ষা পায়নি রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোও। গেল বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিয়ে ৬৪টি এবং বাংলাদেশ পুলিশের বিষয়ে ছড়ানো ৩৮টি গুজব শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এই বাহিনীগুলোর সাথে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপটেই এই গুজবগুলো প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
সংসদ নির্বাচন যখন গুজবের টার্গেটে
বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছর পরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সে হিসেবে আগামী ০৭ জানুয়ারি (২০২৪) এই নির্বাচন দ্বাদশবারের মতো হতে দেখবে বাংলাদেশের জনগণ। গুজব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, যেকোনো ইভেন্ট ভিত্তিক গুজব প্রায় সব দেশেই অন্তত একটি হলেও ছড়ায়। ইভেন্টের ব্যাপকতা বুঝে সে সংখ্যা এবং হার বাড়ে বা কমে। বাংলাদেশে তার ব্যতিক্রম দেখিনি আমরা। নির্বাচন এদেশের রাজনীতির মূল অনুষঙ্গ হয়ে ওঠায় নির্বাচনের আগে ও পরে বরাবরই উত্তাল থাকে দেশের রাজনীতি। গুজবও যেহেতু রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয় সেহেতু নির্বাচন আসলে গুজব প্রচারও বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
২০১৮ সালে যখন সর্বশেষ সংসদ নির্বাচন হয়েছিল এদেশে, সেসময় ফ্যাক্টচেকিংয়ের ধারণাটি একেবারেই নতুন ছিল দেশের মানুষের কাছে। তখন গুজব যাচাইয়ের কার্যক্রমও বেশ সীমিত ছিল। ফলে নির্বাচনের আগে পরে গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে সঠিক তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ খুব একটা ছিল না৷ তবে এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। রিউমর স্ক্যানার টিম গেল বছরের শুরু থেকেই নির্বাচন বিষয়ে ভুল তথ্যের প্রচারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নজরে রেখেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখেছি, জানুয়ারিতেই নির্বাচন কেন্দ্রিক গুজব প্রচার হতে শুরু করে। প্রথম তিন মাসে সংখ্যাটা হাতেগোনা হলেও পরের তিন মাসে এটি বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় এ সংক্রান্ত গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা অবশ্য অনুমিতই ছিল। প্রথম তিন মাসে নির্বাচন বিষয়ে গুজবের পরিমাণ ছিল সাতটি। পরের তিন মাসে এটি বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩২৯ শতাংশ হারে (৩০টি)। তৃতীয় তিন মাসে এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ (৫৭টি) বাড়তে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম যা পূর্বের তিন মাসের তুলনায় প্রায় ৯০ শতাংশ বেড়েছে।

বছরের শেষ তিন মাস অর্থাৎ চতুর্থ তিন মাসে গিয়ে আগের তিন কোয়াটারের মোট সংখ্যাকে পেছনে ফেলেছে নির্বাচনী গুজব। এ সময় ছড়িয়ে পড়েছিল ২২৬টি গুজব, যা তৃতীয় তিন মাসের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৯৬ শতাংশ। তবে আপনি যদি প্রথম তিন মাসের সাথে এই সংখ্যার তুলনা করেন তাহলে অবাক না হয়ে উপায় নেই। প্রথম তিন মাসের তুলনায় শেষ তিন মাসে নির্বাচনী গুজবের ছড়িয়ে পড়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩১২৯ শতাংশ।

গেল বছর আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিদেশি গণমাধ্যম, রাষ্ট্র, কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং তাদের নেতৃত্বকে জড়িয়ে ভুয়া মন্তব্য বা তথ্য প্রচারের প্রবণতা লক্ষ্য করেছে রিউমর স্ক্যানার, সংখ্যার হিসেবে যার পরিমাণ ৪৯টি। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা বাতিল সংক্রান্ত ৩৫টি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে ৩০টি এবং রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য বিকৃত করে ৩২টি ভুল তথ্য প্রচার করতে দেখা গেছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় গুজবের এই ভয়াবহতা আরও বাড়তে পারে। নির্বাচনের দিন অর্থাৎ ০৭ জানুয়ারিও সময়ে সময়ে ভুল তথ্য প্রচারের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নির্বাচন কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।