গত ০৯ এপ্রিল জান্নাত বাণী নামে এক নারীর মোবাইলে একটি খুদে বার্তা বা মেসেজ আসে। মেসেজটি ছিল এরকম, “Jannat apu, ami tomar khub kacher keo. Lojjai porichoy dete parchi na. Amader barite onek ovab jacche, khub baje obostha. Edike samne Eid ki hobe jani na. Abbur haat e o tk nai, tomader Fitra ba Zakat er kisu tk pathale khub upokar hobe. Plz Plz. 01836714650 Bkash+Nagad send money korbe plz.” (বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত)
এই মেসেজ পেয়ে তিনি ভেবে নিয়েছেন, তার আত্মীয় কেউই হয়ত মেসেজটি পাঠিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে তিনি মেসেজে দেওয়া নাম্বারে কিছু টাকা পাঠিয়েও দেন। আমরা নাম্বারটির বিষয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন কিওয়ার্ড সার্চ করে গত ১২ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানের অন্তত ২৩ জন ব্যক্তির অভিযোগ দেখেছি, যারা একই মেসেজ পেয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মেসেজের শুরুতে তাদের নাম উল্লেখ দেখে। তবে এদের অনেকেই নিজেরাই প্রাথমিক কিছু অনুসন্ধানের পর বুঝে নিয়েছেন যে মেসেজদাতারা হয়ত প্রতারণা করছেন। তাই টাকা পাঠাননি।
তবে সকলের ক্ষেত্রেই যে প্রাথমিক সতর্কতা পালন করা হয় বিষয়টা মোটেও এমন নয়। রিউমর স্ক্যানারের ইনভেস্টিগেশন ইউনিট বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেছে, অন্তত ২০২১ সাল থেকে একই মেসেজ ভিন্ন ভিন্ন নাম্বার থেকে অসংখ্য ব্যক্তিকে পাঠানো হয়েছে। মেসেজের ভাষা এবং অসহায়ত্বের আকুতিতে বিশ্বাস করে একাধিক ব্যক্তি মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে সহায়তার হাতও বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে প্রমাণ পেয়েছি আমরা।
ঈদকে ঘিরে প্রতারণার ফাঁদ
চলতি বছর বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর পালিত হয় গত ১১ এপ্রিল। ফিতরা এবং জাকাতের অর্থ সহায়তা হিসেবে চেয়ে পাঠানো মেসেজগুলো পেয়ে কেউ তাদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে কিনা তা দেখতে ঈদের আগে অন্তত এক সপ্তাহ রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট নজর রেখেছিল ফেসবুকে৷ আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এই সময়ে অন্তত ১১ টি ভিন্ন ভিন্ন মোবাইল নাম্বার থেকে একই মেসেজ পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তিদের। এর মধ্যে ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ দেখা গেছে +8801872703502 এই নাম্বারটির বিষয়ে। কমপক্ষে ৪০ জন ব্যক্তি অন্তত গত ০৯ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত এই নাম্বার থেকে একই মেসেজ পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্ট এবং কমেন্টে।

আমরা এ সংক্রান্ত ফেসবুকে যেসব নাম্বারের সন্ধান পেয়েছি এদের সবগুলো ট্রু কলার অ্যাপে দিয়ে দেখা গেছে, সেখানে সবচেয়ে বেশি (অন্তত ৮৪ টি) স্প্যাম রিপোর্ট করা হয়েছে +8809617609850 এই নাম্বারে। শুধু এই বছরই নয়, অন্তত ২০২৩ সাল থেকে এই নাম্বার থেকে একই মেসেজ পাওয়ার অভিযোগ দেখা গেছে অ্যাপটিতে। এসব অভিযোগের সবচেয়ে পুরোনো তিনটি এসেছে ঈদুল ফিতরের আগের দিন, গত বছরের ২১ এপ্রিল। পরের দুইদিনও একাধিক ব্যক্তি একই নাম্বার থেকে টাকা চেয়ে একই কায়দায় মেসেজ পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। এরপর জুলাই এবং সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে এই নাম্বার থেকে অর্থ চাওয়ার অভিযোগ এসেছে ট্রু কলারে।

গত ০৭ এপ্রিল মোহাম্মদ ফাহিম আহমেদ নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকের একটি পাবলিক গ্রুপে এই নাম্বারটির বিষয়ে সকলকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে লেখেন, তাকে গত বছর ঈদুল ফিতরের আগের দিন এই নাম্বার থেকে একই মেসেজ দিয়ে +8801911756867 নাম্বারে বিকাশ বা নগদের মাধ্যমে অর্থ সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। জনাব ফাহিম বলছেন, “এরা মানুষের আবেগ কে কেন্দ্র করে এই রকম কারসাজি করে। আমি প্রথমে বিষয়টা বিশ্বাস করলেও পরে উক্ত নাম্বারে কল করলে কল রিসিভ করে না।”
এসব ছাপিয়ে একক এবং নিয়মিত একই কায়দায় অর্থ সহায়তা চেয়ে আসছে এমন একটি নাম্বারের সন্ধান মিলেছে। +8801905479586 এই নাম্বারটি ট্রু কলারে নাম দেখাচ্ছে ‘সীমা’। অন্তত ২০২২ সাল থেকে এই নাম্বার থেকে মেসেজ পেয়ে আসছেন, ট্রু কলারে এমন অভিযোগে স্প্যাম রিপোর্ট করা হয়েছে ৬২ টি৷ ৪১ জন ব্যক্তি নাম্বারটির বিষয়ে নিজেদের অভিযোগ জানিয়েছেন, যার সবচেয়ে পুরোনোটি এসেছে ২০২২ সালের পহেলা জুন৷ তবে সেসময় কোনো ঈদ ছিল না৷ মোস্তাবির শামীম নামে যে ব্যক্তি সেদিন অভিযোগ করেন তার বক্তব্য এমন, “টাকার জন্য প্রতারণা করছে৷ বিশ্বাস করবেন না।” জনাব শামীমকে ঠিক কী মেসেজ লিখে পাঠানো হয়েছিল তা জানা সম্ভব না হলেও এই নাম্বার থেকে পরবর্তীতে একই মেসেজ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে যাওয়ার স্ক্রিনশট পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। স্ক্রিনশটে দেখা যায়, মেসেজ পাঠানো ব্যক্তি নিজেকে সীমা বলে পরিচয় দিয়ে ১০০ বা ২০০ টাকা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নগদে পাঠাতে অনুরোধ করছেন৷

এই নাম্বারটির বিষয়ে ট্রু কলার অ্যাপের অভিযোগগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুন, আগস্ট এবং নভেম্বরে অনিয়মিতভাবে নাম্বারটির বিষয়ে অভিযোগ আসলেও ২০২৩ সালের মে থেকে চলতি এপ্রিল পর্যন্ত প্রতি মাসেই অর্থ চেয়ে মেসেজ পাওয়ার অভিযোগ এসেছে৷
উপরোক্ত তিন নাম্বার বাদে চলতি বছর ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে ফিতরা বা জাকাতের অর্থ সহায়তা চেয়ে আরো যে ০৮টি নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে এগুলো হলো +8801836714650, +8801617740109, +8801832453496, +8801831703438, +8801877693312, +8801833861130, +8801870943701 এবং +8801957278937। এসব নাম্বারের প্রতিটির বিরুদ্ধেই ট্রু কলার অ্যাপে স্প্যাম রিপোর্ট এবং অভিযোগ দেখতে পেয়েছি আমরা। এই ১১টি নাম্বার থেকে অন্তত দেড় শতাধিক অভিযোগ এসেছে ফেসবুকেই৷ এর বাইরে ট্রু কলার অ্যাপে স্প্যাম রিপোর্ট পড়েছে প্রায় আড়াই শতাধিক, অভিযোগ এসেছে তার প্রায় অর্ধেক।

গেল বছর (২০২৩) ঈদুল ফিতর পালিত হয় ২২ এপ্রিল। সেদিন এবং তার আগের দিন একাধিক ব্যক্তির (১, ২, ৩) ফোনে +8809617609850 এই নাম্বার থেকে মেসেজ পাঠিয়ে একই পদ্ধতি অবলম্বন করে +8801911756867 এই নাম্বারে অর্থ সহায়তা পাঠাতে বলা হয়। একই নাম্বার (+8809617609850) থেকে একই মেসেজ পাঠিয়ে ভিন্ন আরেকটি নাম্বারেও (+8801912099081) অর্থ সহায়তা পাঠানোর অনুরোধ পাওয়ার প্রমাণ মিলেছে।
২০২৩ সালে এর বাইরে অন্য কোনো নাম্বার থেকে বহুল আলোচিত এই মেসেজ পাওয়ার কোনো অভিযোগ ওপেন সোর্স অনুসন্ধানে পায়নি রিউমর স্ক্যানার। তবে এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে অন্তত ১১টি ভিন্ন নাম্বারের মাধ্যমে এই প্রতারণা চেষ্টার প্রমাণ পেয়েছি আমরা। এই ঘটনাগুলো প্রায় সবগুলোই ঘটেছে সে বছরের রমজান এবং ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে। এসব নাম্বারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে +8801616727641 নাম্বারটি নিয়ে। বাকি ১০টি নাম্বার হচ্ছে, +8801615751185, +8801616727635, +8801616730400, +8801616727629, +8801615751094, +8801614255318, +8801616604959, +8801616727637, +8801615751155 এবং +8801616727636। সে সময় অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘ডেইলি বাংলাদেশ’ এ বিষয়ে খবরও প্রকাশিত হয়েছিল। গণমাধ্যমটির পক্ষ থেকে সে সময় চট্টগ্রামের সিআইডির এক কর্মকর্তার বক্তব্যও নেওয়া হয়েছিল। বক্তব্যে তিনি জানান, ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতারকরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে তারা কাজ করছেন।
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রতারণার এই নতুন ফাঁদ পাতা শুরু হয় আরও অন্তত এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২১ সালে। সে বছরও ঈদুল ফিতরের সময়ই জাকাত বা ফিতরার অর্থ চেয়ে মেসেজ এসেছে এমন অন্তত পাঁচটি নাম্বারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে ফেসবুকে। নাম্বারগুলো হচ্ছে +8801762029987, +8801864405536,+8801755350231, +8801864405874 এবং +8801864405865। এর মধ্যে ১২ মে একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ জানিয়ে পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। তারা বলছেন, সেদিন এবং এর আগের দিন তারা এমন মেসেজ পেয়েছেন। দাতব্য সংস্থা ইনসানিয়াত ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল ফারুক ১২ মে একটি পোস্টে জানান, তাকে সেদিন রাত ১২ টায় এমন মেসেজ দেওয়া হয়। তার কাছে সন্দেহ হওয়ায় তিনি ট্রু কলার অ্যাপের মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে এরা প্রতারক চক্র।
একই ব্যক্তিই কি এসবের পেছনে?
চলতি বছর (২০২৪) যে ১১টি নাম্বারের মাধ্যমে অর্থ সহায়তা চাওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ৭টি রবি, ২টি বাংলালিংক এবং একটি এয়ারটেল সিমের নাম্বার। বাকি একটি দেশীয় কোনো অপারেটরের নয়। এই নাম্বারগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এদের একটির সাথে অন্যটির সিরিয়াল বা প্যাটার্নে মিল নেই৷ গত বছর (২০২৩) যে দুই নাম্বার একই কাজে ব্যবহার হতে দেখা গেছে সেগুলো বাংলালিংক নাম্বার। এই দুই নাম্বারও একটি অপরটির সাথে সিরিয়াল বা প্যাটার্নে মিল নেই। তবে ২০২২ সালের নাম্বারগুলো বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের কাছে মনে হয়েছে, সে সময় একই ব্যক্তি বা চক্র এই প্রতারণার সাথে জড়িত ছিল। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সে বছর যে ১১টি নাম্বারের খোঁজ আমরা পেয়েছি তার সবগুলোই ছিল এয়ারটেলের। এর মধ্যে একটি সিরিজে তিনটি নাম্বারের প্রথম আটটি ডিজিটে এবং আরেকটি সিরিজে থাকা পাঁচটি নাম্বারের প্রথম নয়টি ডিজিটে মিল পাওয়া গেছে। সিরিজ এবং ডিজিটের মধ্যে মিল থাকা একই ব্যক্তি বা চক্রের কাজ বলেই সন্দেহ বাড়িয়েছে।

২০২১ সালে আমরা যে পাঁচটি নাম্বারের মাধ্যমে প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছি তার মধ্যেও তিনটি নাম্বার (+8801864405536, +8801864405865, +8801864405874) একই সিরিজের এবং এদের প্রথম আট ডিজিট হুবহু একই।
ফাঁদে পা দিয়েছেন কেউ কেউ
রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় একটি কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন সাব্বির আহমেদ শাকিল নামে এক ব্যক্তি। গত বছর (২০২৩) ঈদুল ফিতরের সময় তিনি +8809617609850 এই নাম্বার থেকে মেসেজ পান। তাকে একই কায়দায় সাহায্যের অনুরোধ জানানো হয়। বিকাশ/নগদ অ্যাকাউন্ট হিসেবে দেওয়া হয় +8801911756867 এই নাম্বার। জনাব শাকিল ঈদের আগের দিন (২১ এপ্রিল) রাতে নগদের মাধ্যমে উক্ত নাম্বারে দেড় হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন (ট্রানজেকশন আইডি: 71U6T68Y)। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট শাকিলের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছে। তিনি বলছিলেন, তার কাছে মনে হয়েছে তার পরিচিত কেউই হয়ত বিপদে পড়েছে। তিনি তাই টাকা পাঠিয়ে দেন৷ পরবর্তীতে উক্ত নাম্বার থেকে আর কোনো মেসেজ আসেনি। তিনিও আর যোগাযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন আমাদের।
একই দিন (২১ এপ্রিল, ২০২৩) একই নাম্বার থেকে (+8809617609850) মেসেজ পান আজরাফ ফাহিম নামে এক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। ফাহিম রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটকে বলছিলেন, ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় এই মেসেজ পাওয়ার পর পরদিন সকালেই তিনি উক্ত মেসেজে দেওয়া নাম্বারে (+8801911756867) ৫০০ টাকা পাঠিয়ে দেন (ট্রানজেকশন আইডি: ADM5Q7A4GR)।
একই নাম্বার (মেসেজকৃত এবং অর্থ পাঠাতে দেওয়া বিকাশ/নগদ নাম্বার) থেকে এর আগের বছরও (২০২২) মেসেজ পাওয়ার প্রেক্ষিতে টাকা পাঠিয়েছেন এমন আরো একজনকে খুঁজে বের করেছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। তানভীর রেজভী রোহান নামে এই ব্যক্তি সে সময় উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। রোহান আমাদের টাকা পাঠানোর অভিজ্ঞতা বলছিলেন এভাবে, “তখন আমার অনেক জুনিয়র আমার কাছে বিভিন্ন সহায়তা চাইত। আমিও এইরকম এই মনে করে টাকাটা পাঠিয়ে দেই। এবং পরে আমি টাকা গিয়েছে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে তাকে ম্যাসেজ করেছিলাম টাকা পেয়েছে কিনা। সে আর কোন উত্তর দেই নি। তখন ব্যাপারটা বুঝতে পারি নি। উল্টো মনে হলো লোকটি কেমন অকৃতজ্ঞ।”
প্রতারণার শিকার হয়েছেন, এই বিষয়টি রোহান বুঝতে পেরেছেন বেশ কিছুদিন পর। রোহান বলছেন, “গত কিছু দিন আগে একজনের ফেইসবুক পোস্টে বুঝতে পারি আমার সাথে স্ক্যাম হয়েছে। সেইটা আরো দুই বছর আগেই। গত সোমবার (০৮ এপ্রিল) দেখি একেই ধরনের ম্যাসেজ একটি রবি নম্বর থেকে আবার এসেছে।” প্রথমবার ৫০০ টাকা দেওয়ার পর দ্বিতীয়বার আর ফাঁদে পা দেননি তিনি।
মেসেজে সংশ্লিষ্টদের নাম উল্লেখের নেপথ্যে
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান চলাকালে অসংখ্য ভুক্তভোগীর একটি প্রশ্ন পেয়েছে, যাদের মেসেজ পাঠানো হয় তাদের নাম জানছে কীভাবে প্রতারকরা। এক্ষেত্রে প্রতারকদের কাছে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে ট্রু কলার অ্যাপ। সুইডেন ভিত্তিক এই উদ্যোগের শুরু ২০০৯ সালে। অ্যাপটির কারিগররা এমন একটি পরিষেবা তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা সহজেই অজানা নম্বর থেকে আসা কলগুলোকে শনাক্ত করবে। এর পেছনের মানুষরা নিজেদের আজ সফল ভাবতেই পারেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রায় সাড়ে ৩৭ কোটি মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে গেছে অ্যাপটি। তাদের কাছে কলার আইডি এবং স্প্যাম ব্লক করার জন্য এটি প্রথম পছন্দের অ্যাপ। তবে এর ক্ষতিকারক দিকটিও ভাবাচ্ছে মানুষকে। মেসেজ সংক্রান্ত আমাদের এই গবেষণাকেই উদাহরণ হিসেবে দেখুন না! ২০২১ সাল থেকে পরের তিন বছরে অন্তত ২৯ টি ভিন্ন ভিন্ন ফোন নাম্বারের মাধ্যমে যারাই আলোচিত মেসেজটি পাওয়ার অভিযোগ করেছেন তাদের সকলকেই নাম ধরে সম্বোধন করা হয়েছে। আমাদের বিশ্লেষণ বলছে, সকলে এদের ফাঁদে পা না দেওয়ার বড় কারণ ছিল ট্রু কলার অ্যাপ। যাদের ফোনে এই অ্যাপ ইনস্টল করা আছে তারা প্রযুক্তি সচেতন হিসেবে অপরিচিত নাম্বার দেখে নাম্বারটি ট্রু কলারের মাধ্যমে যাচাই করে দেখেছেন যে এরা আসলে প্রতারক। তাদের কাছের কোনো আত্মীয় নয়। তাই টাকা পাঠানো থেকে বিরত থেকেছেন।
প্রতারকরাও ঠিক এভাবেই সংশ্লিষ্টদের নাম বের করেছেন বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এক্ষেত্রে দৈবচয়নভিত্তিতে কোনো নাম্বার নির্বাচন করে প্রতারকরা সেটি ট্রু কলারে ইনপুট দিয়ে নাম বের করে থাকতে পারেন। এতে করে টার্গেটের কাছে বিশ্বস্ততা অর্জনের চেষ্টা করেছেন তারা। সফলও যে হয়েছেন তা অনেকের এই ফাঁদে পা দেওয়া থেকেই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ট্রু কলারে নাম্বারের বিপরীতে উক্ত নাম্বারের মালিকের নাম ভেসে ওঠে কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে অ্যাপটির ওয়েবসাইটেই। তার আগে আমরা দেখার চেষ্টা করেছি এই সুবিধা কতটা কার্যকরী। আমরাও দৈবচয়নভিত্তিতে বিভিন্ন সিম অপারেটরের কিছু নাম্বার বেছে নিয়ে তা ট্রু কলারে দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি এই নাম্বারগুলোর মালিক কারা। এর প্রেক্ষিতে সাতটি নাম্বার যাচাই করে পাঁচটিতে নাম্বারের বিপরীতে মালিকের নাম পাওয়া গেছে। দুইটিতে কারো নাম আসেনি। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, এর বাইরে আমাদের ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের একজন সদস্য তার পরিচিত একজনের নাম্বার ট্রু কলারে দিয়ে উক্ত ব্যক্তির নামের পরিবর্তে একটি লাইব্রেরির নাম ভেসে ওঠতে দেখেছেন৷ আমরা উক্ত ব্যক্তির সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছি। তিনি বলছিলেন, উক্ত লাইব্রেরিটি তিনি যে বিল্ডিংয়ে থাকেন সে বিল্ডিংয়েই অবস্থিত। তবে ট্রু কলারে কেন এই লাইব্রেরির নাম আসছে তা তিনি জানাতে পারেননি।

অর্থাৎ, নাম্বার দিয়ে নাম খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে ট্রু কলার অ্যাপ শতভাগ কার্যকরী কোনো উপায় নয়৷ এক্ষেত্রে নাম্বারের বিপরীতে ভিন্ন ব্যক্তির নাম জানিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগও থেকে যাচ্ছে।
ফেরা যাক ট্রু কলারে নাম্বারের বিপরীতে উক্ত নাম্বারের মালিকের নাম ভেসে ওঠার পদ্ধতি প্রসঙ্গে। ট্রু কলারে রিভার্স ফোন লুকআপ নামে একটি ফিচার রয়েছে। এই ফিচার ব্যবহার করেই অপরিচিত নাম্বারের মালিক শনাক্তে মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় নেয় অ্যাপটি। এই নাম আপনাকে দেখাতে পরামর্শ নেওয়া হয় আপনার মতোই অগণিত ট্রু কলার ব্যবহারকারীদের কাছ থেকেই৷ অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে ট্রুকলার এর ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে পাওয়া নামের পরামর্শ যাচাই করার মাধ্যমে ট্রু কলার কোনও কলারের নাম নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ: যদি একটি বিমা সংস্থার বিরক্তকারী নম্বর এই উদ্যোগের নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যবহারকারীর দ্বারা ‘বিমা স্প্যাম’ হিসাবে রিপোর্ট করা হয়, তাহলে রিভার্স ফোন লুকআপে সেই নম্বরটিকে ‘বিমা স্প্যাম’ হিসেবেই দেখাবে। অর্থাৎ, অ্যাপটি পুরোপুরি ইউজার নির্ভর পদ্ধতিতে চলছে। ইউজাররাই কোনো নাম্বারের বিপরীতে নাম দিচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি যে নাম উক্ত নাম্বারের জন্য ইউজাররা দেন সেটিই রিভার্স ফোন লুকআপে দেখাবে। তবে প্রতারকরা যে ট্রু কলারের মাধ্যমেই নাম বের করছেন তা শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলার সুযোগ নেই।
বিকাশ নগদে সংশ্লিষ্ট নাম্বারগুলোর অদ্ভুতুড়ে নাম
ইউজাররাই ট্রু কলারে সংশ্লিষ্ট নাম্বারগুলোর অধিকাংশগুলোরই নাম দিয়েছেন মেয়ে ফ্রেন্ড (Meye fr.) নামে। এর মধ্যে ২০২৪ সালে ১১টির মধ্যে নয়টিই এই নামে ট্রু কলারে দেখা যাচ্ছে। এই বছর বাকি যে দুই নাম্বার এই প্রতারণার সাথে জড়িয়েছে সেগুলোর একটির নাম সীমা (+8801905479586) এবং অন্যটি ‘fake taka chay’ (9617609850) নামে ট্রু কলারে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া, ২০২৩ ও ২০২২ সালে তিনটি করে নাম্বার মেয়ে ফ্রেন্ড নামেই পাওয়া যাচ্ছে অ্যাপটিতে। তবে ২০২১ সালে তিনটি নাম্বার (+8801755350231, +8801864405874,+8801864405865) ফারিয়া নামে পাওয়া যাচ্ছে৷
অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে বিকাশ ও নগদে নাম্বারগুলোর পরিচয়ের ক্ষেত্রে। যেমন, এই বছর দুইটি নাম্বারের বিপরীতে বিকাশে ‘গুপিন হাজডা’ (Gupin Hajda) নাম দেখা যাচ্ছে। এছাড়া, বাকি নাম্বারগুলোর ক্ষেত্রেও বিকাশের অ্যাপে বাংলাদেশে সচরাচর ব্যবহৃত হয়না এমন নাম যেমন লক্ষ্মণ হাজডা, দিলীপ হেমব্রম, সুমলা হেমরম, লক্ষ্মী হেমরম, শিল্পী টুডু, সোহেল মারডি, সৌরভী রানী দেওয়া হয়েছে বিকাশে৷ এক্ষেত্রেও ২/৩ টি নাম্বারের ক্ষেত্রে নামের শেষের অংশগুলোয় মিল (হেরব্রম, হাজডা) পাওয়া যাচ্ছে৷ ২০২৩ এবং ২০২২ সালের নাম্বারগুলোর ক্ষেত্রে অবশ্য বিকাশে নামের প্যাটার্নে মিল পরিলক্ষিত হয়নি। তবে ২০২২ সালে সিরিয়ালের দুইটি নাম্বারের (+8801616727636, +8801616727637) ক্ষেত্রে বিকাশে একই নাম (মোঃ শফিকুল) পাওয়া যাচ্ছে। ২০২১ সালের নাম্বারগুলোর ক্ষেত্রে বিকাশে কারো নাম জানা সম্ভব হয়নি।
বিকাশ অ্যাপে কিছু নাম্বারের বিপরীতে নামের বা নামের কিছু অংশের মিল পাওয়া গেলেও আরেক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নগদের ক্ষেত্রে দুইটি বাদে বাকি নাম্বারগুলোর নামের সাথেই অন্য নাম্বারের নামের মিল পাওয়া যায়নি। এই দুই নাম্বারের ক্ষেত্রে চলতি বছর +8801831703438 নাম্বারের বিপরীতে নগদে মনিকা সরেন নাম এবং +8801870943701 নাম্বারের বিপরীতে ডমনিকা সরেন নাম উল্লেখ রয়েছে।

কিছু ক্ষেত্রে এমনও ঘটেছে, বিকাশ অ্যাপে একটি নাম্বার হিন্দু নামের ব্যক্তির নামে উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু নগদ অ্যাপে একই নাম্বার মুসলিম নামের ব্যক্তির নামে উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। এমন নজির ২০২৪ সালে চারটি, ২০২৩ সালে দুইটি রয়েছে। উল্টো নজিরও পাওয়া যাচ্ছে একটি (২০২২ সালে)। কিন্তু একই নাম্বার দুই অ্যাপে দুইজন ভিন্ন ধর্মের অনুসারীর নামে হওয়া বেশ অদ্ভুতই বটে!
সচেতনতাই পরামর্শ
আলোচিত এই প্রতারণার বিষয়টি নিয়ে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট কথা বলেছে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি মোঃ রেজাউল মাসুদের সাথে।
রেজাউল মাসুদ বলছেন, “অনলাইনের ট্রানজেকশন বিশেষ করে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস লেনদেন বেড়ে যাওয়াতে এই ধরনের প্রতারণা অনেক বেড়েছে। প্রতারক চক্র ঈদ মৌসুম অথবা কোন ধরনের বিশেষ উৎসবকে টার্গেট করে। কেউ বলে আমাদের এলাকায় এক বিধবা মা তার তিনটা সন্তান বিয়ে দিতে পারছেন না আপনার ঈদের জাকাত দিতে পারেন উনাকে। কেউ বলে আমাদের এলাকায় এক দরিদ্র পরিবার আছে সে পরিবারে বড় ছেলের জন্য একটা রিকশা কিনে দিতে হবে জাকাত দিতে পারেন। আবার নিজের জন্য আপনি যেভাবে মেসেজ দিয়েছেন এভাবে চায়। মোটকথা হলো একটা বিশ্বাস একটা আস্থা একটা ধর্মীয় বিষয়কে পুঁজি করে এ সমস্ত লোক জাকাতের নাম বলে বিভিন্ন জনের কাছে টাকা হাতিয়ে নেয়।”
তারা এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নে জনাব মাসুদ জানাচ্ছেন, “টাকার পরিমান খুব বেশি থাকে না ৫০০-১ হাজার দুই হাজার। ভিক্টিমরা এই অল্প পরিমাণ টাকা দিয়ে খুব যে বেশি প্রতারিত হইছে সেটা বেশি নিজে মনে করে না। আবার প্রতারিত হওয়ার কথা ভাবলেও কম টাকার কারণে সে পুলিশের কাছে অভিযোগ করে না।” পুলিশের এই কর্তার মতে, এই সুযোগে জাকাত ফিতরা বিভিন্ন আর্থিক সহায়তার নাম বলে এ প্রতারক চক্র অনেক জনের কাছে প্রতারণা করে যাচ্ছে। “আমরা এমন তথ্য পাই অভিযোগ পায় যাচাই বাছাই করে দেখি কিন্তু আমাদের কাছে কেউ যদি সাইবারে অভিযোগ করে কিংবা এই ধরনের কোন মামলা করে তখন আমাদের জন্য কাজটা করতে আরো সুবিধা হয়।”
জনাব মাসুদের কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম এ বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কী পরামর্শ থাকছে। তিনি বলেন, “আপনি যাকে টাকা দিবেন তাকে যেন আপনি ব্যক্তিগতভাবে চিনেন জানেন তার মোবাইল নাম্বার। টাকাটা কোন খাতে যাচ্ছে এটা ডিটেলস জেনে তারপর টাকাটা দেবেন।”