ইসলামিক পদ্ধতিতে গরু ও অন্যান্য পশু জবাইয়ের বিষয়ে অন্তত ২০১৯ সাল থেকে একটি গবেষণার বরাতে প্রতিবছর ঈদ উল আজহার সময় কিছু তথ্য ফেসবুকে পোস্ট আকারে প্রচার হয়ে আসছে।
উক্ত ফেসবুক পোস্টগুলোতে মূলত দাবি করা হয়, জার্মানির হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর শুলজ এবং ডক্টর হাজিমের করা এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ইসলামিক পদ্ধতিতে জবাই করলে গরু ও অন্যান্য পশু ব্যথা অনুভব করে না।

এমন কিছু পোস্ট ফেসবুকে দেখুন এখানে, এখানে, এখানে।
একই দাবির পোস্ট ইনস্টাগ্রামে দেখুন এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, গবেষণার বরাতে প্রচার হওয়া আলোচিত দাবিটি বিভ্রান্তিকর। প্রকৃতপক্ষে, প্রচারিত দাবির সাথে গবেষণাপত্রটির কিছু অমিল বা অসংগতি রয়েছে। গবেষণাটিতে ভেড়া এবং বাছুর ব্যবহার করা হয়েছে। গরু ব্যবহার করা হয়নি। একইসাথে, বর্তমান সময়ের অধিকাংশ গবেষণার তথ্যমতে, অবচেতন না করে কোনো পশুর জীবনাবসান ঘটানো হলে পশু ব্যথা অনুভব করে থাকে। তবে, এই অবচেতন করার প্রক্রিয়াটিতেও ব্যথা অনুভব হয়।
আলোচিত পোস্টগুলোতে প্রফেসর শ্যুলজ এবং ডক্টর হাজিমের যে গবেষণার কথা বলা হয়েছে, সেই গবেষণাপত্রটি মূল জার্মান ভাষায় পাওয়া না গেলেও, এটির ইংরেজি অনুবাদ অনলাইনে পাওয়া যায়। গবেষণাপত্রটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ব্রিটেনের ইসলামিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য প্রফেসর ডক্টর সাহিব মুস্তাকিম ব্লেহার। গবেষণাপত্রটির ইংরেজি শিরোনাম [Objectivization of pain and consciousness in the conventional (dart-gun anesthesia) as well as in ritual (kosher incision) slaughter of sheep and calf]. অর্থাৎ, এতে ধর্মীয় রীতি বলতে ইহুদিদের কোশার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা হয়েছিল।
গবেষণাপত্রটি ১৯৭৮ সালে জার্মান জার্নাল Deutsche Tieraerztliche Wochenschrift (German veterinary weekly) এর ফেব্রুয়ারী সংখ্যার ভলিউম ৮৫ এর ৬২ থেকে ৬৬ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টের সাথে গবেষণাপত্রটির কিছু অমিল বা অসংগতি পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার।
প্রথমত, অনুবাদকৃত রিসার্চ পেপার অনুযায়ী, ধর্মীয় পদ্ধতি এবং ক্যাপ্টিভ বোল্ট পদ্ধতিতে পশুর মৃত্যু ঘটানোর মধ্যে তুলনা করা হয়েছে। অনুবাদে ধর্মীয় পদ্ধতি (ritual cut) হিসেবে উল্লেখ করা হলেও National Library of Medicine এ গবেষণাপত্রটির ইংরেজি ভাষান্তরিত শিরোনামে ধর্মীয় পদ্ধতি হিসেবে কোশার পদ্ধতির বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। কোশার পদ্ধতি বলতে ইহুদিদের ধর্মীয় পদ্ধতি বোঝানো হয়ে থাকে, মুসলিমদের নয়। তবে, কোশার পদ্ধতি ইহুদিদের হলেও এর সাথে ইসলামিক রীতিরও মিল রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, গবেষণাটিতে ভেড়া এবং বাছুর ব্যবহার করা হয়েছে। গরু ব্যবহার করা হয়নি। গবেষকরা পূর্ণবয়স্ক গরুর ক্ষেত্রে আবারও রিসার্চ করতে বলেছেন। তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গবেষণাটিতে গরু ব্যবহার করার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে।
তৃতীয়ত, আলোচিত পোস্টগুলোতে ৩ সেকেন্ড, ৬ সেকেন্ডের সময়ে EEG এর গ্রাফ এবং গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার মতো কথাগুলো বলা হলেও গবেষণাপত্রে এরকম কিছু পাওয়া যায়নি। তবে, গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ভেড়াগুলো ৪ থেকে ৬ সেকেন্ডের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হারানোর জোরালো সম্ভাবনা আছে। অপরদিকে বাছুরের ক্ষেত্রে সময়টা ১০ সেকেন্ডের মধ্যে।
শেষের পয়েন্টের বিষয়ে যদিও গবেষণাপত্রটিতে কিছু বলা হয়নি, তবে গবেষণাপত্রটির ইংরেজি অনুবাদক ডক্টর ব্লেহারের ওয়েবসাইটে এই বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি নিজের ওয়েবসাইটে ৩ সেকেন্ড, ৬ সেকেন্ড এবং গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করেন। সেখানে রেফারেন্স হিসেবে নিজের অনুবাদ করা গবেষণাপত্রটির বিষয়ে উল্লেখ করলেও তার নিজের অনুবাদ করা গবেষণাপত্রে তার দাবির স্বপক্ষে এরকম কিছু পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, উক্ত ৩ এবং ৬ সেকেন্ডের তথ্যগুলো গবেষণাপত্রটির অনুবাদক ব্লেহারের ওয়েবসাইটের আর্কাইভ সংস্করণে পাওয়া গেলেও বর্তমান সংস্করণে পাওয়া যায়না৷ অর্থাৎ, এই ৩ সেকেন্ড এবং ৬ সেকেন্ডের উল্লেখকৃত শব্দ তিনি নিজেই পরবর্তীতে সরিয়ে নিয়েছেন।
অতঃপর, জবাই করার সময় গরু ও অন্যান্য পশু ব্যথা পায় কিনা তা নিয়ে সাম্প্রতিক বা এই দশকের গবেষণা বা নিবন্ধের অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার। অনুসন্ধানে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্পেন ভিত্তিক কাতালান ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান verificat এর একটি প্রতিবেদন খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার। উক্ত প্রতিবেদনে একাধিক গবেষণা ও বইয়ের সূত্রের উপর ভিত্তি করে তারা সিদ্ধান্ত জানায়, পশু ব্যথা অনুভব করে। এক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে পশুকে অবচেতন করে নেওয়া যেতে পারে। অবচেতন করার জন্য প্রথমে পশুটির নড়াচড়া করার শক্তি থামাতে হবে। যদিও এই প্রক্রিয়াটিও কষ্টদায়ক। তবে, অবচেতন ছাড়া জীবনাবসান ঘটানোর চেয়ে এটি তুলনামূলক কম সময় নেয় বা কম কষ্ট দেয় পশুকে। উক্ত কথাগুলো অ্যান্তোনিও ভেলার্দে নামের একজন গবেষকের বরাতে প্রকাশ করে ভেরিফিক্যাট।
তাছাড়া, পশু ব্যথা পায় শীর্ষক উক্ত দাবির স্বপক্ষে তাদের যুক্ত করা সূত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে, নিউজিল্যান্ড ভেটেরিনারি জার্নালে “Electroencephalographic responses of halothane-anaesthetised calves to slaughter by ventral-neck incision without prior stunning” শিরোনামে প্রকাশ হওয়া একটি গবেষণাপত্র, যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির Animal Science এর প্রফেসর টেম্পল গ্র্যান্ডিন এর “Improving Animal Welfare | 3rd Edition | A Practical Approach” শিরোনামের সম্পাদিত বই, বৈজ্ঞানিক ও মেডিক্যাল ডাটাবেজ সায়েন্স ডিরেক্টে “Recent concerns about stunning and slaughter” শিরোনামে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র এবং আফ্রিকান জার্নাল এবং বায়োটেকনোলজিতে “Animal welfare in multipurpose cattle production Systems and its implications on beef quality” শিরোনামে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণাপত্র।
অর্থাৎ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে যে গবেষণাপত্রের বরাতে ইসলামিক পদ্ধতিতে জবাই করলে গরু ও অন্যান্য পশু ব্যথা অনুভব করে না শীর্ষক দাবি প্রচার করা হচ্ছে তাতে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে এবং প্রচারিত দাবির সাথে গবেষণাপত্রটিরও কিছু অমিল বা অসংগতি রয়েছে। গবেষণাটিতে ভেড়া এবং বাছুর ব্যবহার করা হয়েছে। গরু ব্যবহার করা হয়নি। একইসাথে, বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ গবেষণার মতে অবচেতন না করে কোনো পশুর জীবনাবসান ঘটানো হলে পশুটি ব্যথা অনুভব করে থাকে। তবে, এই অবচেতন করার প্রক্রিয়াটিতেও ব্যথা অনুভব হয়। সুতরাং, প্রচারিত পোস্ট, দাবিকৃত গবেষণাপত্র কিংবা বর্তমান গবেষণা, সব কিছুর মধ্যেই পার্থক্য বা অমিল লক্ষ্য করা যায়।
উল্লেখ্য, আলোচিত দাবিটির বিষয়ে ২০২৪ সালে বিস্তারিত ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার। পড়ুন এখানে।